বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে অভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ছোট একটি ট্রাক থেকে খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হচ্ছিল। সেখান থেকে যারা খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন তাদের মধ্যে হাজেরা বিবি (৩৭) নামের একজন ছিলেন। তিনিও প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ভিড় ঠেলে খাবার সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু ট্রাকটির কাছে যেতেই সেখানে খাবার শেষ হয়ে যায়।
খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় ট্রাকটিও চলে যেতে শুরু করে। ট্রাকের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অসহায় হাজেরা বিবি হঠাৎ করেই থেমে গিয়ে শুরু করেন কান্না। ততোক্ষণে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি। সামান্য খাবারের জন্য হাজেরা বিবির প্রাণপণ ছোটাছুটির এই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন পূর্বপশ্চিমের প্রতিবেদকরা। দুই শিশুকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে তাকে এক ঘরের চাউনিতে নিতেই শুরু করলের নিজের দুর্দশার কথা।
তিনি বলেন, খাবার বলতে কিছুই নেই আমার কাছে। নিজে খেতে না পারলে বাচ্চা কিভাবে বুকের দুধ পাবে?
রাখাইন রাজ্যের বুচিদংয়ের উত্তরাঞ্চলের কোলাদং গ্রামে হাজেরার বাড়ি ছিল। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তারা। রাখাইনের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ওখানে সব জায়গায় নির্যাতন চলছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে গ্রামের অন্যদের সাথে আমিও পালিয়ে এসেছি।
শফিকার স্বামী মিয়ানমার শহরে কাজ করতেন। স্বামীকে ফেলে রেখেই তিনি বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। স্বামীর ভাগ্য কি ঘটেছে সে সম্পর্কে কিছু জানেন না তিনি। পাহাড় ও জঙ্গল দিয়ে পাঁচ দিন হাঁটার পর নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে পালংখালী সীমান্ত পার হয়ে তিনি বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে পৌঁছান।
শনিবার দুপুরে অনুপ্রবেশ করা জাফর আহমেদ বলেন, তার গ্রাম তুলাতলী এলাকায়। আগের দিন সৈন্যরা রীতিমতো ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালিয়েছে তার গ্রামে। যাকে পেয়েছে তাকে মেরেছে। গুলি করেছে, কুপিয়েছে, ঘরে আগুন দিয়েছে। তার আপন ছোট ভাইকে সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। কেবল প্রাণে বাঁচতেই তারা এপারে এসেছেন। তাদের আর কোনো চাওয়া নেই। কেবল থাকার জায়গাটুকু দিলেই তারা খুশি।
এদিকে সীমিত সাধ্যের মধ্যেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বস্ব দিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য করছে। যদিও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন যে কেউই। ফলে প্রাণে বাঁচতে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের।
টেকনাফ-উখিয়া সড়কের দু’পাশে এরকম লড়াইরত হাজার হাজার রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। সামান্য আশ্রয়ের জন্য তারা ছুটছে এদিকে থেকে ওদিক। এরমধ্যে উখিয়া টেকনাফের সামাজিক বনায়নের জায়গায় থাকার জায়গা দিতে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠছে স্থানীয় অসাধু লোকজনের বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন আন্তজাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গত ১১ দিনে কমপক্ষে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রবেশ করেছে অন্তত ৫০ হাজার। যদিও জাতিসংঘের অনুমান, গত ২৫ অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। আরো ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা জিরো পয়েন্ট ও নো ম্যানস ল্যান্ডে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষমান।
গত কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। নিবন্ধিত দু’টি ক্যাম্পে আরো ৩২ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যার পাশাপাশি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের গ্রামগুলো। এর ফলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে তারা। বাংলাদেশেও ভালো নেই রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, অনেকেই খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছেন। দিনের পর দিন হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসা এই লোকজনের জরুরি খাবার ও পানির প্রয়োজন।