বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাদের নিবন্ধনে যুক্ত করতে এবার ত্রাণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এদিকে কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন জানিয়েছে, নতুন রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৯ জনের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮১০ জনকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে বলে কক্সবাজার সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখো শরণার্থীর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাদের নিবন্ধনে যুক্ত করতে ত্রাণ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের বাংলাদেশ সরকারের দেয়া বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এই নিবন্ধন কার্ড দেখিয়েই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত টেকনাফ এবং উখিয়ার ১২টি পয়েন্ট থেকে তাদের ত্রাণ সংগ্রহ করতে হবে। উখিয়াতে এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সফল না হলেও ইতোমধ্যে টেকনাফে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা নতুনভাবে বাংলাদেশে এসেছে বলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাগুলো জানালেও প্রকৃত সংখ্যা কত তা কেউ জানে না। এ অবস্থায় প্রকৃত সংখ্যা জানার জন্য সরকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করলেও এ ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিরুৎসাহিত ভাব রয়েছে। নিবন্ধনের আওতায় আনা না গেলে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেকটা দুরূহ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ইনচার্জ রেজাউল করিম বলেন, এখন আমরা জানতে পারছি না যে, ঠিক কতজন রোহিঙ্গা এখানে আছে। নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হলে তাদের সংখ্যা জানার পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণও সহজ হবে।
রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতেই নিবন্ধনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করে উখিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান বলেন, তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হলে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি সহজ হবে।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনী যুক্ত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের একটি করে টোকেন দেয়া হতো। দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের ছবিযুক্ত রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখন টেকনাফের ছয়টি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে রেশন কার্ডের পাশাপাশি নিবন্ধন কার্ডকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে জানিয়ে টেকনাফের নয়াপাড়া ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন তানজুম বলেন, ত্রাণ বিতরণের জন্য যে কার্ড দেয়া হচ্ছে সেগুলোতে আঙুলের ছাপ নেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে আলাদাভাবে রেশন কার্ড বিতরণ করা হবে।
রোহিঙ্গারা বলছে, এই কার্ডের পর তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাচ্ছে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত নিবন্ধন কার্ড পায় সে জন্য ৭০টি বুথে পাসপোর্ট অধিদফতর রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানিয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সালমান তারিক বলেন, ছয়টি ক্যাম্পে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। সরকার আরো ক্যাম্প বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন মিয়ানমারের ৫ লাখ ৯১ হাজার নাগরিক। এর মধ্যে রোববার (২২ অক্টোবর) পর্যন্ত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৯ জন। অবশিষ্ট রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন। উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে মিয়ানমার নাগরিকদের পাসপোর্ট অধিদফতরের মাধ্যমে ৬টি ক্যাম্পে নিবন্ধন করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শুধু রোববার (২২ অক্টোবর) ১২ হাজার ৩১৯ জন রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে। এর মধ্যে কুতুপালং-১ ক্যাম্পে ১ হাজার ৫৬২ পুরুষ ও ১ হাজার ৩ নারী মিলে ২ হাজার ৫৬৫ জন, কুতুপালং-২ ক্যা¤েপ ১ হাজার ১৮৯ পুরুষ ও ৮২১ নারী মিলে ২ হাজার ১০ জন, নোয়াপাড়া ক্যাম্পে ৩৬৫ পুরুষ ও ৪৭৮ নারী মিলে ৮৪৩ জন, থাইংখালী ক্যাম্পে ১ হাজার ৪৯৯ পুরুষ ও ১ হাজার ৪৫০ নারী মিলে ২ হাজার ৯৪৯ জন, বালুখালী ক্যাম্পে ১ হাজার ১৬৭ পুরুষ ও ১ হাজার ৭১ নারী মিলে ২ হাজার ২৩৮ জন, লেদা ক্যাম্পে ৭৪৪ পুরুষ ও ৯৭০ নারী মিলে ১ হাজার ৭১৪ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা: কক্সবাজার সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে ৩৬টি মেডিকেল টিম ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮১০ জনকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১০০ জনকে হাম রুবেলার টিকা, ৭৫ হাজার ৪৪০ জনকে ওপিভি টিকা, ৭৩ হাজার ৩২০ জনকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল, ৭ লাখ ৪৮৭ জনকে কলেরা টিকা দেয়া হয়েছে। ৩০ হাজার গর্ভবতী নারীকে এএনসি সেবা ও ৩০ হাজার নারীকে প্রসূতিসেবা দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক ২০ হাজার ১২৫ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে। এসব শিশুর ডাটা বেইজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ১১টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। কক্সবাজার থেকে উদ্ধার করা ২৯ হাজার ৪৫২ জন ও অন্যান্য জেলা থেকে উদ্ধার করা ৭০৯ জন রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। নৌকাডুবিসহ নৌ-দুর্ঘটনায় ১৮৬ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে। বান্দরবানে থাকা ১৭ হাজার মিয়ানমার নাগরিকের মধ্যে ৭ হাজার জনকে উখিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি ১০ হাজার জনের স্থানান্তর প্রক্রিয়া চলছে বলেও সমাজসেবা অধিদফতর জানিয়েছে।