বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাজধানীর সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো যেন ছারপোকা ও তেলাপোকা উৎপাদনের কারখানা। ছারপোকা ও তেলাপোকার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীরা। এসব উটকো যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না সেখানকার কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি ও বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেও তার প্রমাণ মিলেছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজনরা জানান, ছারপোকার যন্ত্রণায় রাতে ঘুমানো যায় না। শয্যায় ম্যাট্রেস নেই। অনেকেই এই শীতের মধ্যেও পাটি বিছিয়ে রাত্রিযাপন করেন। এদের কেউ কেউ বাড়ি থেকে তোষক ও কম্বল নিয়ে এসেছেন। মাদকাসক্ত চার নম্বর ওয়ার্ডে সাত নম্বর শয্যায় আছেন রাকিব। তিনি বলেন, ছারপোকার কামড়ে থাকা যায় না। তার ওপর আছে তেলাপোকা। ৪০৭ নম্বর কক্ষে ভর্তি আছেন গোলাম কিবরিয়া। তার স্ত্রী রেকসোনা বলেন, শয্যায় তোষক না থাকায় বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।
রাতে ছারপোকা বিছানার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ওয়ার্ডের কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স মাহফুজা খাতুন, ফাতেমা বেগম, তৃষ্ণা বাড়ৈ এ কথা স্বীকার করেন। তারা জানান, ছারপোকা নির্মূলের জন্য ছয় মাস ধরে সব শয্যার ম্যাট্রেস ছাদে রাখা আছে। এতে রোগীর কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই। শীত আরেকটু বেশি পড়লে হাসপাতাল থেকে কম্বল দেওয়া হবে। ছারপোকার যন্ত্রণার কথা স্বীকার করে তারা বলেন, শুধু বিছানায় নয়, চেয়ার-টেবিলেও আছে ছারপোকা। শরীরের কাপড়েও উঠে আসে। মাঝেমধ্যে বাড়িতেও বহন করে নিয়ে যেতে হয় ছারপোকা। তেলাপোকা-ছারপোকা নির্মূল করতে হলে হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন রকম বিষজাতীয় ওষুধ দিয়ে দমন করা যায়। তবে সরকারি হাসপাতাল বন্ধ রাখার নিয়ম নেই। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারুক আলম বলেন, নিয়মিত ওষুধ ও পাউডার দিয়েও কোনোভাবেই এসব ছারপোকা সরানো যাচ্ছে না। তাই বেডগুলো তুলে রাখা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে রোগীদের শয্যায় ম্যাট্রেস দেওয়া হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেপাটাইটিস ও লিভার বিভাগের ৩১৪ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে ২০ দিন ধরে ভর্তি আছেন ময়মনসিংহের আবদুল আজিজ। তার ছেলে জানান, এখানে ছোট ছোট তেলাপোকা আছে। এরা প্রতিনিয়ত খাবারে বসে। আর ছারপোকার জন্য শয্যায় থাকাই দায়। ছারপোকা শরীরের রক্ত খাওয়ার পর বিছানায় বিচরণ করে। ধরতে গেলে রক্ত বের হয়। রক্তাক্ত বেডশিট ও দেয়াল দেখিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ঝিনাইদহের বশির ভর্তি আছেন একই ওয়ার্ডে। তার স্ত্রী সুমি বলেন, ‘আমরা এক মাস যাবত এখানে আছি। ভর্তির পর থেকে ছারপোকা নিধনের বিষ দিতে দেখিনি। কামড় এড়ানোর জন্য শয্যায় নিমপাতা দিয়েছি।’ আরেক রোগী জাহিদ জানান, তিনি রাতের বেলায় ছারপোকার যন্ত্রণায় মেঝেতে ঘুমান। রেসপেরিটরি মেডিসিন ওয়ার্ডের ওয়ার্ডবয় আবদুল হক ও একাধিক নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে নিয়মিত ফিনাইল দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করা হতো এবং ফিনিশ পাউডার দেওয়া হতো। কিন্তু তিন মাস যাবত ছারপোকার নিধনের জন্য বিশেষ পাউডার সরবরাহ নেই। ছারপোকা হাসপাতাল থেকে নিজেদের বাসাবাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তিন নম্বর মহিলা ওয়ার্ডের জান্নাত বলেন, তেলাপোকার কারণে বক্সে খাবার রেখে শান্তি নেই। ওয়ার্ডে সবগুলা বক্সেই তেলাপোকা আছে। অধিকাংশ ভাঙাচোরা বক্সে তেলাপোকা বংশবিস্তার করছে।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সিনিয়র নার্স শাবনুর বলেন, এ হাসপাতাল অন্যান্য হাসপাতাল থেকে পরিপাটি। তবু এখানে ছারপোকা, তেলাপোকা আছে। ছারপোকা ও তেলাপোকাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ নিধনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তা কাজে আসে না। একইভাবে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, শ্যামলী টিবি হাসপাতাল, জাতীয় ইনস্টিটিউট (পঙ্গু হাসপাতাল), ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতীয় বক্ষব্যাধি গবেষণা হাসপাতাল ঘুরেও তেলাপোকা ও ছারপোকার উপদ্রব দেখা গেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে লিভার বিভাগে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তেলাপোকা খাবারে বসলে বা খাবারের ওপর ঘোরাঘুরি করেছে এমন খাবার খেলে ফুড পয়জোনিং, আমাশয়, টাইফয়েড ও কৃমিরোগ হতে পারে। এ ছাড়াও শরীরে বিভিন্ন রকম র্যাশসহ চর্মরোগ ও হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ছারপোকা থেকে প্রায় ৩৩ ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগব্যাধি ছড়ায়। আর এসব কীটপতঙ্গের কীটনাশক সহ্য করার ক্ষমতা আগের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পয়েছে। প্রচলিত কীটনাশক এখন আর ছারপোকা ধ্বংসে কাজ করছে না। ৩০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ দিয়ে ছারপোকা নিধন সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু তা সম্ভব না। ছারপোকা রক্তপান না করে এক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর একটি স্ত্রী ছারপোকা বছরে প্রায় এক লাখবার প্রজনন ঘটাতে পারে। তাই এদের নির্মূল একেবারে করা যায় না বলে এ গবেষণায় উল্লেখ আছে।