বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নদী, সমুদ্র, প্রাকৃতিক বন আর চোখ জুড়ানো মায়াবী হরিণের দেশ হাতিয়ার ‘নিঝুম দ্বীপ’। তাই শহরের যান্ত্রিকতা থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেতে অনেক প্রকৃতিপ্রেমীই পাড়ি জমান নোয়াখালীর এই দ্বীপাঞ্চলে; কিন্তু তীব্র খাদ্যাভাব, বন্য কুকুরের আক্রমণ, মিঠাপানির সংকট, প্রভাবশালীদের অত্যাচার আর রেঞ্জ কর্মকর্তাদের অবহেলায় এখানকার প্রায় ৪০ হাজার হরিণের জীবন আজ বিপন্ন।বিপুল পরিমাণ বৃক্ষনিধন, অধিক হারে বসতি নির্মাণ ও বন উজাড় হওয়ায় হরিণের খাদ্য সংকট। তা ছাড়া দিন দিনই বেড়ে উঠছে বনের গাছগুলোও। হরিণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তাদের প্রধান খাবার গাছের পাতা।
হরিণ গাছেও উঠতে পারে না। মূলত বনের বানরই হরিণকে গাছ থেকে খাবার পেরে দেয়; কিন্তু কেওড়া, গেওয়া ও বাইনগাছবেষ্টিত এ দ্বীপে কোনো বানর নেই। তবে হরিণের খাদ্য সংকট দূর করার জন্য কয়েকটি বানর চেয়ে বন বিভাগকে বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছেন বিট কর্মকর্তা। এ বিষয়ে নিঝুম বিটের বন কর্মকর্তা মো. জাবের হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নিঝুম দ্বীপের বনে এখন আর আগের মতো হরিণ নেই। খাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সেগুলো বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। বনের গাছগুলোও বড় হয়ে যাওয়ায় হরিণের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে পাতা। তাই হরিণের জন্য প্রয়োজন বেশ কিছু বানর। কয়েকটি বানর চেয়ে এর আগে বন বিভাগকে বেশ কয়েকবার চিঠিও লিখেছি।
৭টি বরাদ্দ দিলেও সেগুলো এখনো পাওয়া যায়নি।বন ঘুরে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে ওঠা দেশের মূল ভূখ- থেকে বিছিন্ন এ দ্বীপে মিঠাপানির বড়ই অভাব। চার দিক বেষ্টিত মেঘনা নদীতেও অধিকাংশ সময়জুড়ে থাকে লবণ পানি; কিন্তু হরিণ কখনো লোনা পানি পান করে না। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুটি মিঠা পানির পুকুর খনন করলেও পলি জমে তা এখন বিলিন। তাই প্রাণ বাঁচাতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে প্রতিদিনই হরিণগুলো ছুটে আসে লোকালয়সহ নদীতীরে।
তখন আবার স্থানীয়রা এগুলোকে ধরার জন্য ধাওয়া করে। বন ও জলদস্যুরাও রাতের আঁধারে নির্বিচারে হরিণ নিধন করে তা বিক্রি করছে একটি প্রভাবশালী চক্রের কাছে, যেন দেখার কেউ নেই। আবার থাকলেই বা কী করার আছে। ২ হাজার ১০০ বর্গমিলোমিটার আয়তনের নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের হরিণ পাহারা ও বন রক্ষায় রয়েছেন মাত্র ৭ থেকে ৮ প্রহরী।তা ছাড়া নিঝুম দ্বীপের হরিণের চিকিৎসায় বন বিভাগের কোনো পশু হাসপাতাল নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। এমনকি দুর্যোগ মুহূর্তে হারিণের আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো উঁচু জায়গাও নেই। তাই বিগত সময়ে বয়ে যাওয়া বহু দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার হরিণ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে।
এ দ্বীপে ১৯৭৩ সালে জনবসতি শুরু হলেও হরিণ আসে ১৯৭৮ সালে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছেড়ে দেওয়া চার জোড়া চিত্রা হরিণ থেকেই বেড়ে আজ হরিণের সংখ্যা ৪০ হাজারের ওপরে। তবে বন বিভাগ থেকে জানা যায়, একটি মা হরিণ বছরে দুবার কমপক্ষে দুটি করে মোট চারটি বাচ্চা দেয়। আর নিঝুম দ্বীপে এখন মা হরিণ রয়েছে প্রায় ১৫ হাজারের মতো। এ হিসাবে প্রতিবছর ৬০ হাজারের মতো বাচ্চা জন্মানোর কথা। এর এক-তৃতীয়াংশ বেঁচে থাকলেও বছরে বৃদ্ধি পায় ২০ হাজার হরিণ; কিন্তু চিত্রটা তার উল্টো।
দুবছর আগে বন বিভাগের জরিপে এ দ্বীপে ৪০ হাজার হরিণ পাওয়া গেলেও এখন সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।স্থানীয়রা বলছেন, বছরদুয়েক আগেও দ্বীপের বিস্তীর্ণ বনে, ফসলের মাঠে, রাস্তাঘাট ও লোকালয়ে চোখ ফেরালেই দেখা মিলত হাজার হাজার মায়াবী হরিণের পাল। এদের জন্য জমিতে ফসল রাখা যেত না। জাল ও মাটি দিয়ে ঘেরাও করে তা রক্ষা করা হতো; কিন্তু বর্তমানে ফসল নষ্টতো দূরের কথা, বেড়াতে আসা পর্যটকরাও হরিণের দেখা পাচ্ছেন না। হরিণের অভয়ারণ্যেই হরিণ যেন এখন ‘সোনার হরিণ’। মূলত বিচরণস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ায় পার্শ্ববর্তী ভোলার কুকরি-মুকরি, ঢালচর, চর উড়িল, বদনারচর, সাকুচিয়া, হাজিরহাট ও চর পাতিলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে চলে যাচ্ছে নিঝুম দ্বীপের হরিণ। হাতিয়ার দমারচর, জাগলাচর, ডেগারচর, ঠেঙ্গারচর, কাজিবাজার, রহমতবাজার, কালামচরসহ চারপাশের চরাঞ্চলগুলোতেও নিঝুম দ্বীপ থেকে হাজার হাজার হরিণ চলে যাচ্ছে। তবে সেখানেও হরিণগুলো ভালো নেই।