ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর: সমাধান কোন পথে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি দিন দিন জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায় চায় রোহিঙ্গারা সম্মানের সঙ্গে দ্রুত স্বদেশে ফিরে যাবে। এ জন্য জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘ গত সোমবার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনারা যা করেছে তা জেনোসাইড। এ জন্য জাতিসংঘ মিয়ানমারের ছয় সেনা কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করেছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যত দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায় ততই ভালো। তবে তাদের ফেরত পাঠানোর আগে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি মিয়ানমার করেছে সেখানে অনেক লুকোচুরি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে চুক্তি করেছে তা কার্যকরে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গারা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে মিয়ানমারের ওপর সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায়। এ জন্য তারা রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়ে মধ্যমেয়াদি (চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্ব সম্প্রদায় ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। এ জন্য জাতিসংঘ একটি প্ল্যান তৈরি করেছে। এর নাম হচ্ছে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)।

রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পের আশপাশের প্রান্তিক লোকজনকে ওই সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পের আওতায় আনা হচ্ছে। সে হিসাবে আশ্রিত রোহিঙ্গা (কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬) এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার সোয়া ২ লাখ স্থানীয় বাসিন্দাকে নিয়ে মোট ১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় ৯৪ কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে বলে প্রাক্কলন তৈরি করেছে জাতিসংঘ। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৮ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের মধ্যমেয়াদি ওই পরিকল্পনা বা প্রাক্কলিত ব্যয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মাত্র ৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিশেষত তহবিল সংগ্রহে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এখন ৩ হাজার কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক দেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সূত্র মতে, জেআরপির খসড়ায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় প্রান্তিক লোকজনের সুরক্ষার সমন্বিত ১২টি খাত চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। যার মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয়দের মিলে ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৫২০ জনের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ খাতের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা। এ খাতের জন্য প্রয়োজন ১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তৃতীয়ত, কেবল বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বর্ষা মৌসুম উপযোগী মোটামুটি কাঠামোর আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ।

প্রায় ৮ লাখ ১৩ হাজার ২৮৯ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর জন্য ধাপে ধাপে তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ওয়াশ প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৫ জনকে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে খসড়ায়। যাতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার। নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, সাইট ব্যবস্থাপনার জন্য ১২ কোটি ৫০ লাখ, শিক্ষায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ, পুষ্টি খাতের উন্নয়নে ৩ কোটি ৮০ লাখ, কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগসহ অন্য খাতে আরও প্রায় এক কোটি ডলার ধরা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যা। এ জন্য মিয়ানমারের সেনারা সেখানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করেছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। রাখাইনে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে। গত সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে অন্তত ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এ ছাড়া প্রতিবেদন তৈরিতে তারা ভিডিও ফুটেজ, স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ রাখাইনে অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ছাড়া পাঁচ জেনারেলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন- উপ-সেনাপ্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সোয়ে উইন, বিশেষ অভিযান-ব্যুরোর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিউ জ, পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল মং মং সোয়ে, ৩৩ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং এবং ৯৯ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান ও। রাখাইনের পাশাপাশি শান ও কাচিন অঞ্চলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশকিছু চৌকিতে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে। নির্বিচারে গ্রাম পোড়ানো, হত্যা আর ধর্ষণের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তারা। কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ঢলের পর থেকে এসেছে ৭ লাখ ২ হাজার। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরের কয়েক মাসে এসেছিল ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। অন্যরা আগে থেকেই অবস্থান করছে বাংলাদেশে।

মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে

এম হুমায়ূন কবীর, সাবেক রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে যত দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব তারা (রোহিঙ্গারা) যত দিন এখানে (বাংলাদেশে) থাকবে তত দিন তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। আশা করছি তারা দ্রুত যাবে।

তারপরও যদি দ্রুত না যায় তখন চিন্তা করে দেখতে হবে কি করা যায়। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে কাজটি করছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে তো তাই প্রমাণিত হয়। চুক্তি কার্যকরে মিয়ানমারের অগ্রগতি নেই।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য করতে হবে 

ড. আমেনা মহসিন, অধ্যাপক, ঢাবি

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি জটিল। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমারকে বাধ্য না করতে পারি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কোনো ভরসায় সে দেশে যাবে।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। কেননা নগরিকত্বের সঙ্গেই মানুষের সব মৌলিক অধিকারগুলো জড়িত। তা ছাড়া তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘ আমাদের জন্য যা করছে এ জন্য আমরা জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাই। রোহিঙ্গারা যাতে নাগরিকত্ব নিয়ে সে দেশে ফিরে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহলকে এখন সে কাজটিই করতে হবে।

চুক্তি কার্যকরে মিয়ানমারের অগ্রগতি নেই

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন, অধ্যাপক, চবি

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই বাংলাদেশ যেভাবে করতে চাচ্ছে মিয়ানমার কিছুতেই সেভাবে করতে রাজি হয়নি। মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে আবার জাতিসংঘের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে সেখানে মিয়ানমার অনেক লুকোচুরি করেছে।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তা কার্যকরের কোনো অগ্রগতি নেই অথচ মিয়ানমার বলে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। মিয়ানমার যে এই কথাটি বারবার বলছে জাতিসংঘে তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশের নেই। মিয়ানমারে জেনোসাইড হয়েছে। এর বিচার করার ক্ষমতা আইসিসির নেই। কেননা মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। জাতিসংঘ এর বিচার করতে পারে। এর জন্য জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যদের সর্বসম্মতভাবে একটি রেজ্যুলেশন পাস করতে হবে। চীন এবং রাশিয়াও জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য। সেখানে তারা যদি ভেটো দেয় তাহলে সে রেজুলেশন হবে না। তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচার করা কঠিন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর: সমাধান কোন পথে

আপডেট টাইম : ০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি দিন দিন জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায় চায় রোহিঙ্গারা সম্মানের সঙ্গে দ্রুত স্বদেশে ফিরে যাবে। এ জন্য জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘ গত সোমবার এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনারা যা করেছে তা জেনোসাইড। এ জন্য জাতিসংঘ মিয়ানমারের ছয় সেনা কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করেছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যত দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায় ততই ভালো। তবে তাদের ফেরত পাঠানোর আগে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি মিয়ানমার করেছে সেখানে অনেক লুকোচুরি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে চুক্তি করেছে তা কার্যকরে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গারা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে মিয়ানমারের ওপর সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায়। এ জন্য তারা রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়ে মধ্যমেয়াদি (চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্ব সম্প্রদায় ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। এ জন্য জাতিসংঘ একটি প্ল্যান তৈরি করেছে। এর নাম হচ্ছে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)।

রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পের আশপাশের প্রান্তিক লোকজনকে ওই সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পের আওতায় আনা হচ্ছে। সে হিসাবে আশ্রিত রোহিঙ্গা (কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬) এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার সোয়া ২ লাখ স্থানীয় বাসিন্দাকে নিয়ে মোট ১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় ৯৪ কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে বলে প্রাক্কলন তৈরি করেছে জাতিসংঘ। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৮ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘের মধ্যমেয়াদি ওই পরিকল্পনা বা প্রাক্কলিত ব্যয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মাত্র ৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিশেষত তহবিল সংগ্রহে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এখন ৩ হাজার কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক দেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সূত্র মতে, জেআরপির খসড়ায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় প্রান্তিক লোকজনের সুরক্ষার সমন্বিত ১২টি খাত চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। যার মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয়দের মিলে ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৫২০ জনের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ খাতের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা। এ খাতের জন্য প্রয়োজন ১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তৃতীয়ত, কেবল বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বর্ষা মৌসুম উপযোগী মোটামুটি কাঠামোর আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ।

প্রায় ৮ লাখ ১৩ হাজার ২৮৯ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর জন্য ধাপে ধাপে তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ওয়াশ প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৫ জনকে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে খসড়ায়। যাতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার। নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, সাইট ব্যবস্থাপনার জন্য ১২ কোটি ৫০ লাখ, শিক্ষায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ, পুষ্টি খাতের উন্নয়নে ৩ কোটি ৮০ লাখ, কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগসহ অন্য খাতে আরও প্রায় এক কোটি ডলার ধরা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যা। এ জন্য মিয়ানমারের সেনারা সেখানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করেছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। রাখাইনে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে। গত সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে অন্তত ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এ ছাড়া প্রতিবেদন তৈরিতে তারা ভিডিও ফুটেজ, স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদনে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ রাখাইনে অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ছাড়া পাঁচ জেনারেলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন- উপ-সেনাপ্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সোয়ে উইন, বিশেষ অভিযান-ব্যুরোর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিউ জ, পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল মং মং সোয়ে, ৩৩ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং এবং ৯৯ হালকা পদাতিক বাহিনী বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান ও। রাখাইনের পাশাপাশি শান ও কাচিন অঞ্চলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশকিছু চৌকিতে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে। নির্বিচারে গ্রাম পোড়ানো, হত্যা আর ধর্ষণের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তারা। কক্সবাজারে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ঢলের পর থেকে এসেছে ৭ লাখ ২ হাজার। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরের কয়েক মাসে এসেছিল ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। অন্যরা আগে থেকেই অবস্থান করছে বাংলাদেশে।

মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে

এম হুমায়ূন কবীর, সাবেক রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে যত দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব তারা (রোহিঙ্গারা) যত দিন এখানে (বাংলাদেশে) থাকবে তত দিন তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। আশা করছি তারা দ্রুত যাবে।

তারপরও যদি দ্রুত না যায় তখন চিন্তা করে দেখতে হবে কি করা যায়। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে কাজটি করছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে তো তাই প্রমাণিত হয়। চুক্তি কার্যকরে মিয়ানমারের অগ্রগতি নেই।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য করতে হবে 

ড. আমেনা মহসিন, অধ্যাপক, ঢাবি

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি জটিল। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমারকে বাধ্য না করতে পারি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কোনো ভরসায় সে দেশে যাবে।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। কেননা নগরিকত্বের সঙ্গেই মানুষের সব মৌলিক অধিকারগুলো জড়িত। তা ছাড়া তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও তো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘ আমাদের জন্য যা করছে এ জন্য আমরা জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাই। রোহিঙ্গারা যাতে নাগরিকত্ব নিয়ে সে দেশে ফিরে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহলকে এখন সে কাজটিই করতে হবে।

চুক্তি কার্যকরে মিয়ানমারের অগ্রগতি নেই

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন, অধ্যাপক, চবি

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই বাংলাদেশ যেভাবে করতে চাচ্ছে মিয়ানমার কিছুতেই সেভাবে করতে রাজি হয়নি। মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে আবার জাতিসংঘের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে সেখানে মিয়ানমার অনেক লুকোচুরি করেছে।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তা কার্যকরের কোনো অগ্রগতি নেই অথচ মিয়ানমার বলে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। মিয়ানমার যে এই কথাটি বারবার বলছে জাতিসংঘে তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশের নেই। মিয়ানমারে জেনোসাইড হয়েছে। এর বিচার করার ক্ষমতা আইসিসির নেই। কেননা মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। জাতিসংঘ এর বিচার করতে পারে। এর জন্য জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যদের সর্বসম্মতভাবে একটি রেজ্যুলেশন পাস করতে হবে। চীন এবং রাশিয়াও জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য। সেখানে তারা যদি ভেটো দেয় তাহলে সে রেজুলেশন হবে না। তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচার করা কঠিন।