বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শুধু শীতকালে দেশে পরিযায়ী পাখি আসে, এত দিন কম–বেশি সবাই এটাই জানত। কিন্তু নতুন এক শুমারিতে দেখা গেছে, খাবার ও নিরাপদ আবাসস্থল পেলে শীতকাল শেষে আরও প্রায় দুই মাস পাখি থেকে যায়। শুধু রাশিয়ার সাইবেরিয়া নয়, এ বছর পরিযায়ী পাখি এসেছে তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকেও। সিলেটের হাওর এলাকায় গত মাসেও সীমিতসংখ্যক পরিযায়ী পাখি অবস্থান করছিল।
বাংলাদেশ জলচর পাখিশুমারি-২০১৯–এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী পাখি দেখা গেছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। গত জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩০টি পরিযায়ী পাখি দেখা যায়, যা গত বছরের তুলনায় ৮৬ হাজার বেশি। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার আওতাধীন হাওরটিতে ছোট–বড় ১২০টি বিল রয়েছে। ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার।
এর মধ্যে ২ হাজার ৮০২ দশমিক ৩৬ হেক্টর জলাভূমি। টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়লেও দেশের অন্য এলাকায় এবার পাখি সেভাবে দেখা যায়নি। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাইক্কার বিল এবং মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার আওতাধীন হাকালুকি হাওরে পাখির সংখ্যা কমেছে। কবে উপকূলীয় এলাকা ও সোনাদিয়া দ্বীপে গতবারের চেয়ে পাখি কিছুটা বেশি দেখা গেছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত পাখি শুমারিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বার্ড ক্লাব ও আইইউসিএনের গবেষকেরা বলছেন, গত বছর তুলনায় এ বছর প্রায় এক লাখ পরিযায়ী পাখি দেশে এসেছে। এর প্রায় ৯০ শতাংশ পাখিই গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
আইইউসিএনের বন্য পাখি পর্যবেক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলম সাংবাদিককে বলেন, পরিযায়ী পাখির বিচরণের জন্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত এলাকা টাঙ্গুয়ার হাওর। এবার তেমন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সেখানে পানি কম। এতে জলজ উদ্ভিদ, পোকাসহ নানা প্রাণী পানিতে ভেসে থাকছে। এসব খাবারের লোভে শীত চলে যাওয়ার পরেও পাখি সেখানে থাকছে।
জলচর পাখি শুমারি ২০০০ সাল থেকে হচ্ছে। সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। পাখির বিচরণ এলাকায় মানুষের বসতি ও তৎপরতা বেড়ে যাওয়া এবং নানা ধরনের দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে। গবেষকেরা জানান, ২০০০ সালে শুমারির সময় পাখি ছিল ৫ লাখের বেশি। ২০১৯–এর শুমারিতে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ৫টি এলাকায় পরিযায়ী পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৫ টি। গত বছর দেখা গেছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৩০ টি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনাম আল হক সাংবাদিককে বলেন, হাওর এবং বনভূমির কীট–পতঙ্গ খেয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে পরিযায়ী পাখি। একই সঙ্গে পরিযায়ী পাখির বর্জ্য মাছের খাবার ও জলজ উদ্ভিদের সার। পরিযায়ী পাখি বেশি আসার অর্থ হচ্ছে হাওর এলাকার প্রকৃতি এখনো ভালো আছে।
পাখি শুমারির মূল কাজটি (গণনা) হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। এরপরও পাখির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে বার্ড ক্লাব ও আইইউসিএন। এই কাজটি এখনো চলছে। বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্বার বিল, উপকূলীয় এলাকা ও কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে পাখি শুমারি হয়।
২০১৯ এর শুমারিতে পরিযায়ী পাখিরা কোন অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে আসে সে সম্পর্কেও নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে পাখি বাংলাদেশে আসার তথ্য এবারই প্রথম জানতে পেরেছেন গবেষকেরা। এত দিন মনে করা হতো পরিযায়ী পাখিরা ডিসেম্বরে বাংলাদেশে পৌঁছায়, ফেব্রুয়ারিতে ফিরে যায়। কিন্তু নতুন জরিপে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসের শেষেও দেশের অনেক জলাশয়ে পরিযায়ী পাখিরা অবস্থান করেছে।
কোথা থেকে পরিযায়ী পাখি আসে
বার্ড ক্লাবের সদস্যরা গত জানুয়ারিতে ৪২টি পাখির শরীরে জিপিএস ট্যাগ (একধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে ভৌগোলিক অবস্থান বের করা যায়) স্থাপন করেন। জিপিএস ট্যাগের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে পাখির অবস্থান কোথায় তা বের করা হয়। এর মধ্যে আটটি পাখি ভারতের বিহার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শিকারিদের হাতে মারা পড়েছে। গবেষকেরা জানান, জিপিএস ট্যাগযুক্ত একটি পাখিকে ‘গোয়েন্দা পাখি’ ভেবে আটক করে ভারতের একটি নিরাপত্তা সংস্থা। পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রাণী বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থার হস্তক্ষেপে পাখিটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভারতের প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির তত্ত্বাবধানে পাখিটি রয়েছে।
গবেষকের জানান, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাইক্কার বিলে একটি পাখির শরীরে জিপিএস ট্যাগ পরানো হয়। পাখিটি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি হ্রদে অবস্থান করছিল। এবার সবচেয়ে বেশি জিপিএস ট্যাগ করা হয় গিরিয়া হাঁসকে। একটি গিরিয়া হাঁস ২ মে ভারতের বিহারে শিকারির গুলিতে মারা গেছে।
সরকারের বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির সাংবাদিককে বলেন, এবার পরিযায়ী পাখি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোকে পাখির অভয়াশ্রম এলাকা ঘোষণা করতে সরকারিভাবে তাঁরা উদ্যোগ নেবেন।
কর্মসূচি
আজ ১১ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। এবারের দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘পাখি সুরক্ষায় প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করি’। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর দোয়েল চত্বর থেকে শোভাযাত্রা বের করা হবে। পরে প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা হবে। এই কর্মসূচি যৌথভাবে আয়োজন করেছে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, নেচার কনজারভেশন সোসাইটি, আইইউসিএন, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।