ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঈদুল ফিতরের আর্থসামাজিক গুরুত্ব ও বাংলাদেশ

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজানের শেষে শাওয়ালের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। এক মাস কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের পর আসে ঈদ, যা রোজাদারদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনন্য উপহার। অন্য দিকে, ঈদ-এর আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা; অর্থাৎ রমজান মাসের বিশেষ নিয়ম-কানুন পালন থেকে ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসা’। মূলত এ উৎসবের তাৎপর্য হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ ও সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা শুরু হয় ১৩৮০ সৌর বছর আগে, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরেই। তখন থেকেই মুসলমানরা এ ঈদ উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশে রোজা পালন এবং ঈদুল ফিতর উদযাপনের ইতিহাস বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে আসার বেশ আগ থেকেই।

ঈদের অন্যতম সামাজিক গুরুত্ব হলো, উন্মুক্ত ময়দানে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু এবং সাদা-কালোর সব ভেদাভেদ ভুলে জামাতে শামিল হওয়া। এতে পাড়া-পড়শি থেকে শুরু করে সব পরিচিত-অপরিচিতের সাথে একত্র হওয়ার সুযোগ ঘটে। নামাজ শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে সবাই সব ভেদাভেদ ও মনোমালিন্য ভুলতে চেষ্টা করে। ঈদের দিনে সবাই সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরিধান করে থাকে। পুরনো বিবাদ-বিসংবাদ, দুঃখ-কষ্ট থেকে নতুন জীবনবোধ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রতীকী প্রকাশ ঘটে এর মধ্যে। একে অন্যের বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ ও যাতায়াতের মাধ্যমে সামাজিক সখ্যের ভিত্তি দৃঢ় হয়। ঈদুল ফিতর ইসলামের ধর্মীয় উৎসব বলে প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই এটা সীমিত থাকে। তবে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার সাথে যোগ হয় প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা।

পৃথিবীর সব ধর্ম ও সমাজে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও অবকাঠামোর অবয়বে উদযাপিত উৎসবাদিতে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণা, সখ্য-সৌহার্দ্য প্রকাশের অভিষেক ঘটে থাকে। নানা উপায় এবং উপলক্ষে সম্প্রীতি বোধের বিকাশ লাভ ঘটে, মনোমালিন্যের পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সৃষ্টিকর্তার ইবাদত তার সৃষ্টির সেবা ও সন্তুষ্টি বিধান। সংহার নয়, সেবাই পরম ধর্ম। সব অশান্তি কলহ-বিবাদে। শান্তির সম্ভাবনা শুধু সহযোগিতা-সমঝোতাতেই।

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর সামাজিক তাৎপর্য ছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। ঈদ উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য কেনাকাটার প্রস্তুতি, আপ্যায়নের তোড়জোড়। শহরে আলো ঝলমলে, সুসজ্জিতকরণে ব্যস্ত থাকেন অনুষ্ঠান আয়োজকেরা। সেইসাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠান, আলোচনা এবং ঘনিষ্ঠজনদের সংশ্লিষ্টতা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কে কত প্রতিযোগিতা করতে পারে, বিনোদনের আয়োজনে সফল হতে পারে তার একটি প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি।

পুরো অর্থব্যবস্থা আবর্তিত হয় এ দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের বাজারে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতি বছর বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্যাংক খাতও। এ উপলক্ষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়।

ঈদের এ আনন্দ-উৎসবে শরিক হওয়ার সামর্থ্য সবার সমানভাবে থাকে না। সে জন্য ইসলামে সমাজের ধনী ও বিত্তবান সদস্যদের ওপর নির্দেশ রয়েছে দরিদ্র ও বিত্তহীনদের মধ্যে জাকাত ও ফিতরা প্রদানের। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, বিত্তবানদের সম্পদের ওপর বিত্তহীনদের হক বা অধিকার আছে।-সূরা আজ জারিয়াত-এর ১৯ নম্বর আয়াত। ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে সদকা প্রদান করা উচিত। বিধান রয়েছে, ঈদের নামাজ আদায়ের আগেই ফিতরা প্রদান করতে হবে।

পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ মহান ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। ধনী শ্রেণীর মানুষের সাথে সাথে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এ জন্য সাদকাতুল ফিতর দেয়া ওয়াজিব করা হয়েছে। ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এ দ্বারা গরিবদের জীবন যাপনে কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসে। এর মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পায় এবং সহযোগিতার মানসিকতার বিস্তার ঘটে। একে অন্যের সাথে সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়।

ঈদুল ফিতরের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ শিল্পের প্রসার। গত কয়েক বছর ভ্রমণপিপাসু মানুষের আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঈদ উপলক্ষে ভ্রমণ। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যায়। তারা পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করে।

এ ছাড়াও, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হচ্ছে, আর পর্যটন শিল্প তারই অংশ। বর্তমান সময়ে ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বিশেষ অফার দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর সংগঠন ঈদের আগে পর্যটন মেলার আয়োজন করে থাকে। এতে দেশী-বিদেশী অনেক সংগঠন অংশগ্রহণ করে থাকে। ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হচ্ছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

ঈদে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের জায়গায় রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের নানা কর্মসূচি। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ঈদে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ পর্যটক ভ্রমণ করে কক্সবাজার। অন্য দিকে, সারা বছর কক্সবাজার ভ্রমণে আসে মোট ১৫ থেকে ২০ লাখ পর্যটক। এই সময় সব হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট পর্যটকে থাকে পরিপূর্ণ। পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির সবুজঘেরা পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে ঢল নামে মানুষের। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় স্থাপনা এবং সবুজ চা-বাগান পর্যটকদের বারবার আকর্ষণ করে। তা ছাড়া কুয়াকাটা, খুলনা এবং কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য জেলার দর্শনীয় স্থানে ঈদে পর্যটকের উপস্থিতি অনেক বেড়ে যায়। ঢাকার আশপাশে বিশেষ করে গাজীপুরে ব্যাপকহারে রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পার্ক ও অ্যামিউজমেন্ট পার্কে পর্যটকের উপস্থিতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

ঈদে বিদেশে ভ্রমণের প্রতিও মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপত্তা সুযোগসহ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে দেশে ঈদনির্ভর পর্যটন আরো বাড়বে। পর্যটন বিকাশে স্থানীয় মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পর্যটন থেকে সরাসরি লাভবান হয়- সে দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। এতে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নতি লাভ করবে।

ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের ফলে সমাজ যাচ্ছে তলিয়ে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’। ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়; সবাই কেমন মরিয়া হয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। বাড়তি চাহিদা থাকায় অধিক মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রকম প্রতারণার আশ্রয় নেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদিকে সম্মানিত করে তাদের যে ঈদ দান করেছেন, তা বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ। এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসবের সাথে সাথে জগতের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সুসজ্জিত করতে পারলে ঈদের তাৎপর্য আরো বেশি উদ্ভাসিত হবে ইনশা আল্লাহ্।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

ঈদুল ফিতরের আর্থসামাজিক গুরুত্ব ও বাংলাদেশ

আপডেট টাইম : ০৯:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ মে ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজানের শেষে শাওয়ালের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। এক মাস কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের পর আসে ঈদ, যা রোজাদারদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনন্য উপহার। অন্য দিকে, ঈদ-এর আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা; অর্থাৎ রমজান মাসের বিশেষ নিয়ম-কানুন পালন থেকে ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসা’। মূলত এ উৎসবের তাৎপর্য হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ ও সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা শুরু হয় ১৩৮০ সৌর বছর আগে, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরেই। তখন থেকেই মুসলমানরা এ ঈদ উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশে রোজা পালন এবং ঈদুল ফিতর উদযাপনের ইতিহাস বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে আসার বেশ আগ থেকেই।

ঈদের অন্যতম সামাজিক গুরুত্ব হলো, উন্মুক্ত ময়দানে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু এবং সাদা-কালোর সব ভেদাভেদ ভুলে জামাতে শামিল হওয়া। এতে পাড়া-পড়শি থেকে শুরু করে সব পরিচিত-অপরিচিতের সাথে একত্র হওয়ার সুযোগ ঘটে। নামাজ শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে সবাই সব ভেদাভেদ ও মনোমালিন্য ভুলতে চেষ্টা করে। ঈদের দিনে সবাই সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরিধান করে থাকে। পুরনো বিবাদ-বিসংবাদ, দুঃখ-কষ্ট থেকে নতুন জীবনবোধ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রতীকী প্রকাশ ঘটে এর মধ্যে। একে অন্যের বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ ও যাতায়াতের মাধ্যমে সামাজিক সখ্যের ভিত্তি দৃঢ় হয়। ঈদুল ফিতর ইসলামের ধর্মীয় উৎসব বলে প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই এটা সীমিত থাকে। তবে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার সাথে যোগ হয় প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা।

পৃথিবীর সব ধর্ম ও সমাজে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও অবকাঠামোর অবয়বে উদযাপিত উৎসবাদিতে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণা, সখ্য-সৌহার্দ্য প্রকাশের অভিষেক ঘটে থাকে। নানা উপায় এবং উপলক্ষে সম্প্রীতি বোধের বিকাশ লাভ ঘটে, মনোমালিন্যের পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সৃষ্টিকর্তার ইবাদত তার সৃষ্টির সেবা ও সন্তুষ্টি বিধান। সংহার নয়, সেবাই পরম ধর্ম। সব অশান্তি কলহ-বিবাদে। শান্তির সম্ভাবনা শুধু সহযোগিতা-সমঝোতাতেই।

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর সামাজিক তাৎপর্য ছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। ঈদ উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য কেনাকাটার প্রস্তুতি, আপ্যায়নের তোড়জোড়। শহরে আলো ঝলমলে, সুসজ্জিতকরণে ব্যস্ত থাকেন অনুষ্ঠান আয়োজকেরা। সেইসাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠান, আলোচনা এবং ঘনিষ্ঠজনদের সংশ্লিষ্টতা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কে কত প্রতিযোগিতা করতে পারে, বিনোদনের আয়োজনে সফল হতে পারে তার একটি প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি।

পুরো অর্থব্যবস্থা আবর্তিত হয় এ দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের বাজারে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতি বছর বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্যাংক খাতও। এ উপলক্ষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়।

ঈদের এ আনন্দ-উৎসবে শরিক হওয়ার সামর্থ্য সবার সমানভাবে থাকে না। সে জন্য ইসলামে সমাজের ধনী ও বিত্তবান সদস্যদের ওপর নির্দেশ রয়েছে দরিদ্র ও বিত্তহীনদের মধ্যে জাকাত ও ফিতরা প্রদানের। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, বিত্তবানদের সম্পদের ওপর বিত্তহীনদের হক বা অধিকার আছে।-সূরা আজ জারিয়াত-এর ১৯ নম্বর আয়াত। ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে সদকা প্রদান করা উচিত। বিধান রয়েছে, ঈদের নামাজ আদায়ের আগেই ফিতরা প্রদান করতে হবে।

পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালনের পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ মহান ঈদের আনন্দ প্রদান করেছেন। ধনী শ্রেণীর মানুষের সাথে সাথে গরিবরাও যাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এ জন্য সাদকাতুল ফিতর দেয়া ওয়াজিব করা হয়েছে। ফিতরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বসবাসকারী ধনীদের অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং এ দ্বারা গরিবদের জীবন যাপনে কিছুটা হলেও গতি ফিরে আসে। এর মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পায় এবং সহযোগিতার মানসিকতার বিস্তার ঘটে। একে অন্যের সাথে সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়।

ঈদুল ফিতরের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ শিল্পের প্রসার। গত কয়েক বছর ভ্রমণপিপাসু মানুষের আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঈদ উপলক্ষে ভ্রমণ। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যায়। তারা পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করে।

এ ছাড়াও, ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হচ্ছে, আর পর্যটন শিল্প তারই অংশ। বর্তমান সময়ে ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বিশেষ অফার দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর সংগঠন ঈদের আগে পর্যটন মেলার আয়োজন করে থাকে। এতে দেশী-বিদেশী অনেক সংগঠন অংশগ্রহণ করে থাকে। ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হচ্ছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

ঈদে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের জায়গায় রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের নানা কর্মসূচি। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ঈদে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ পর্যটক ভ্রমণ করে কক্সবাজার। অন্য দিকে, সারা বছর কক্সবাজার ভ্রমণে আসে মোট ১৫ থেকে ২০ লাখ পর্যটক। এই সময় সব হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট পর্যটকে থাকে পরিপূর্ণ। পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির সবুজঘেরা পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে ঢল নামে মানুষের। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় স্থাপনা এবং সবুজ চা-বাগান পর্যটকদের বারবার আকর্ষণ করে। তা ছাড়া কুয়াকাটা, খুলনা এবং কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য জেলার দর্শনীয় স্থানে ঈদে পর্যটকের উপস্থিতি অনেক বেড়ে যায়। ঢাকার আশপাশে বিশেষ করে গাজীপুরে ব্যাপকহারে রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পার্ক ও অ্যামিউজমেন্ট পার্কে পর্যটকের উপস্থিতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

ঈদে বিদেশে ভ্রমণের প্রতিও মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরাপত্তা সুযোগসহ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে দেশে ঈদনির্ভর পর্যটন আরো বাড়বে। পর্যটন বিকাশে স্থানীয় মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পর্যটন থেকে সরাসরি লাভবান হয়- সে দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। এতে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নতি লাভ করবে।

ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের ফলে সমাজ যাচ্ছে তলিয়ে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’। ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়; সবাই কেমন মরিয়া হয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। বাড়তি চাহিদা থাকায় অধিক মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন রকম প্রতারণার আশ্রয় নেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদিকে সম্মানিত করে তাদের যে ঈদ দান করেছেন, তা বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ। এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসবের সাথে সাথে জগতের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সুসজ্জিত করতে পারলে ঈদের তাৎপর্য আরো বেশি উদ্ভাসিত হবে ইনশা আল্লাহ্।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক