বাঙালী কন্ঠ ডেস্কঃ পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম ডাক্তার ও দার্শনিকদের সঠিক মর্যাদা এবং অবস্থান অনুধাবন করতে পেরেছে। তাই তারা রাজি, ইবনে নাফিস, বাগদাদি, ইবনে রুশদ প্রমুখকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের অবদান দেখে তারা হতভম্ব। তাদের রেখে যাওয়া জ্ঞানবিজ্ঞান দ্বারা তারা উপকৃত হয়েছে। ইউরোপীয়দের যখন চিকিৎসা ও অপারেশনে আরবে ক্ষেত্র তৈরি করা প্রয়োজন হয়েছিল, তখন তারা মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমা ইসলামি বিশ্ব আন্দালুসিয়ার এক ডাক্তারের চিকিৎসা অভিজ্ঞতা, তার রচনাবলি এবং তার উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলোর শরণাপন্ন হয়। বিগত এক হাজার বছরে চিকিৎসা শাস্ত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনে যার দখল ছিল বিরাট। সেই যুগ বিবেচনায় তার পুরো জীবন ও কর্মই ছিল জ্ঞানের ভা-ার। সেই ক্ষণজন্মা মহামনীষী পশ্চিমা বিশ্বে নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার নাম আবুল কাসেম যাহরাওয়ি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আবুল কাসেম খালফ বিন আব্বাস যাহরাওয়ি আনসারি কর্ডোভা শহরের নিকটবর্তী আন্দালুসিয়ার (স্পেনের) নতুন রাজধানী ‘যাহরাহ’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন উমাইয়া শাসক গভর্নর আবদুর রহমান নাসির এ শহরটি নির্মাণ করেন। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন টানা ৫০ বছর। প্রশাসন, পরিচালনা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি এ নগরকে আন্দালুসের মধ্যমণি বানাতে চেয়েছিলেন। আবুল কাসেম শহরটি উদ্বোধনের প্রথম বছর ৩২৫ হিজরি মোতাবেক ৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ সেখানে জন্মগ্রহণ করেন; তাই সেদিকেই তাকে সম্বন্ধ করা হয়।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যাহরাওয়ি তার সমকালীন লোকদের মাঝে তেমন কোনো বিবেচ্য ছিলেন না। নেতৃবর্গ ও এলিট শ্রেণির কথা বাদ দিলেও এরকম বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ, ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব উমাইয়া রাজদরবারের অনুচরদের ডাক্তারও ছিলেন না। তাদের নিকটবর্তীও কেউ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অভাবী, নিঃস্ব ও অসহায়দের ডাক্তার।
বিজ্ঞজনের মূল্যায়ন
সর্বপ্রথম তার সম্পর্কে আলোচনা উঠে আসে সমকালীন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট দার্শনিক ও ফকিহ, আল্লামা ইবনে হাজম (রহ.) এর পক্ষ থেকে। যিনি যৌবনে তাকে বিশিষ্ট পুরোধা হিসেবে পেয়েছিলেন। তার চিকিৎসার অভিনবত্ব দেখেছেন। তিনি তার ও তার কিতাব ‘আত-তাসরিফ’ সম্পর্কে বলেন ‘আবুল কাসেম খালফ বিন আব্বাস যাহরাওয়ির রচিত গ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’ আমরা দেখেছি, পড়েছি। যদি আমরা বলি চিকিৎসা শাস্ত্রে ইতঃপূর্বে তার চেয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি, তাহলে অবশ্যই আমাদের সত্যায়ন করা হবে।’
ফরাসি গবেষক, প্রাচ্যবিদ জ্যাক রেসলর নিজ গ্রন্থ ‘আরব সভ্যতা’য় লিখেছেন ‘সিনিয়র সার্জন আবুল কাসেম যাহরাওয়ি অপারেশন শাস্ত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এ শাস্ত্রে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। মুসলিম স্পেনের সীমা ছাড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত তার সফলতা ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টজগতের সব প্রান্ত থেকেই লোকজন অপারেশনের জন্য কর্ডোভায় যেত।’
তার ইন্তেকালের এক শতাব্দী বা তারও অনেক পরে ইসলামি বিশ্বের সর্বত্র তার প্রসিদ্ধি বিস্তৃত হতে থাকে। প্রাচ্যের চিকিৎসাবিষয়ক ঐতিহাসিক ‘ইবনে আবি উসাইবিয়া’ তার সম্পর্কে বলেন, ‘খালফ বিন আব্বাস যাহরাওয়ি ছিলেন শ্রেষ্ঠ ডাক্তার। ওষুধ ও তার পদার্থ বিষয়ে অভিজ্ঞ। সুচিকিৎসক। চিকিৎসা শাস্ত্রে তার বহু গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো ‘আল-মারুফ বিয-যাহরাওয়ি’ গ্রন্থটি। তবে সর্বাধিক বড় ও প্রসিদ্ধ হচ্ছে ‘কিতাবুত তাসরিফ লিমান আযাযা আনিত তালিফ’ কিতাবটি। গ্রন্থটি স্বীয় ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতার দাবি রাখে।
যাহরাওয়ি দরিদ্র ডাক্তার হিসেবেই দিনাতিপাত করতেন। তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। মেডিকেল শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি তার কিতাবের ভূমিকায় তাদের ‘সন্তান’ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি সময় ও শ্রম অসুস্থ রোগীদের সেবায় ব্যয় করেছেন। ‘কিতাবুত তাসরিফ লিমান আযাযা আনিত তালিফ’ কিতাবে চিকিৎসা, অপারেশন, ফার্মেসি, ওষুধ তৈরি ইত্যাদি বিষয়ক প্রায় ৩০টি প্রবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অপারেশন বিষয়ক ৩০নং প্রবন্ধটি। যাকে তৎকালে যাহরাওয়ির চিকিৎসা বিপ্লব ও উন্নয়নের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়।
আবিষ্কার ও গবেষণার উজ্জ্বল সাফল্য
যাহরাওয়ির চিকিৎসা দর্শন ছিল; অপারেশন বিদ্যা পূর্ণ অর্জন ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ডাক্তারই হতে পারে না। তিনি বলেন চিকিৎসা শিল্প অনেক বিস্তৃত। তাই ডাক্তার হতে ইচ্ছুক প্রত্যেককেই অপারেশন বিদ্যায় বিচরণ করে আসতে হবে। কেননা আমাদের বর্ণিত বিষয়গুলোর জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে খুব সম্ভব, সে এমন ভুলে লিপ্ত হয়ে যাবে, যা রোগীর মৃত্যুর কারণ হবে।
অপারেশন বিদ্যার প্রতি তার মনোযোগ ও গবেষণা এ শাস্ত্রে তার অর্জিত বিরাট সফলতার কারণ। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন ধরনের অপারেশন সামগ্রী আবিষ্কার করেন। লক্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তার পূর্বে অপারেশন বিষয়টি তুচ্ছ একটি বিদ্যা ছিল। যাহরাওয়ি এসে এ ধারণা পাল্টে দেন। তিনি ছিলেন নিজ হাতে অপারেশন কার্যক্রম সম্পন্নকারী ডাক্তারদের প্রথমসারির একজন। তার পূর্বে ডাক্তাররা নার্সদের দিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করাতেন।
প্রায় অর্ধশতাব্দী বা তারও বেশি সময়কাল নিজ হাতে করা অপারেশনের ফলে তার বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছিল। যার অধিকাংশই তিনি প্রায় অর্ধযুগে রচিত ‘আত-তাসরিফ’ নামক গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম অঙ্গ ও মানবদেহের কঙ্কালের আকৃতি তার বইয়ে এঁকেছেন। সর্বপ্রথম তিনিই তার বইগুলোতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও তার ব্যবহার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। প্রায় ২০০টি আকৃতি তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেন।
যাহরাওয়ি চিকিৎসা শাস্ত্রে বহু কিছু আবিষ্কার করেছেন। তার হাতে তৈরি হয়েছে আধুনিক চিকিৎসার বহু থিউরির স্তম্ভ। তিনিই সর্বপ্রথম মজবুত সুতা দিয়ে স্পঞ্জের সাহায্যে খাদ্যনালির ভেতর থেকে অতিরিক্ত মাংসপি- বের করে আনার পদ্ধতি চালু করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বিকলাঙ্গ অপারেশনের পদ্ধতিকে সংশোধন করেন। ইতঃপূর্বে ডাক্তাররা শুধু সমস্যাযুক্ত অংশটা কাটতেন। অসুস্থ অংশ থেকে একটু দূরে, সুস্থ অংশও কেটে ফেলার পরামর্শ দেন তিনি। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনটিই করা হচ্ছে। পুঁজজনিত প্রদাহ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি জোড়ার কাছাকাছি দৃশ্যমান ফোঁড়াগুলো কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। হাড়ের প্রদাহের ক্ষেত্রে অসুস্থ সব অঙ্গ কেটে ফেলার নির্দেশ দেন।
ফ্রান্সিস ‘আম্ব্রোজ বেরি’র পূর্বেই তিনি রক্ত বন্ধের জন্য শিরাকে সংযোগ স্থাপনের থিউরি আবিষ্কার করেন।
অথচ যাহরাওয়িকে কৃতিত্ব বঞ্চিত এ বিষয়টি ‘বেরি’র দিকে সম্বন্ধ করা হয়ে থাকে। তিনিই সর্বপ্রথম অপারেশনের নীতিমালা, সম্পাদনের পদ্ধতি, এক্ষেত্রে সতর্কতা বিষয়ক নির্দেশনা নিজ বইয়ে আলোচনা করেন। প্রতিটি অনুচ্ছেদেই তিনি তার পূর্ব জ্ঞানের সঙ্গে এক্ষেত্রে তার অনুসৃত পদ্ধতি ও মন্তব্যগুলোও সবিস্তারে উল্লেখ করেন।
তিনি তেল, পানীয় বা সিরকা ও পানীয় এবং দিয়াশলাই দ্বারা ক্ষত অবশকরণের উৎকৃষ্ট মাধ্যম গ্রহণ করেন। তার বই ‘আত-তাসরিফে’র কয়েকটি অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে রোগীকে বেহুঁশ করার বিভিন্ন পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। তিনি অ্যালকোহল মিশ্রিত পানীয় দ্বারা জখম অবশ করার নীতিমালা প্রণয়ন করেন। বর্তমান যুগেও এ পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়। তাছাড়া যাহরাওয়ি দন্তচিকিৎসা ও গরুর হাড় দিয়ে নতুন দাঁত বানানো এবং রোগীর মুখে তা স্থাপনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘গরুর একটি হাড় কর্তন করা হবে। অতঃপর তা দ্বারা মাড়ির দাঁতের মতো একটি দাঁত বানানো হবে। অতঃপর পড়ে যাওয়া দাঁতের যায়গায় তা প্রতিস্থাপন করা হবে। আমাদের বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া হবে। এটা এভাবেই থাকবে এবং সে তা উপভোগ করবে ইনশাআল্লাহ।’ তিনিই প্রথম মুসলিম ডাক্তার, যিনি এক হাজার বছর পূর্বে দাঁত প্রতিস্থাপন বিষয়ে কথা বলেছেন।
যাহরাওয়িই সর্বপ্রথম অপারেশনের পর শিরাগুলোর সংযোগ স্থাপনে রেশমের সুতা ব্যবহার করেন। তিনি অনেকগুলো সফল অপারেশন সম্পন্ন করেছেন। নাকের পলিপাস, কণ্ঠনালির বিভিন্ন টিউমার, পুরুষের নারীসদৃশ বক্ষ সংশোধন, মহিলাদের বুকের অতিরিক্ত স্ফীতি সংশোধন, ক্যান্সারের চিকিৎসা, শ্বেত রোগের চিকিৎসা, যেসব শিশুর জন্মের পর দৃশ্যমান প্রস্রাবের নল নেই বা আছ; কিন্তু ছোট বা সঠিক স্থানে নেই, তাদের চিকিৎসা ইত্যাদি। যার সম্পূর্ণ বিবরণ তার বইয়ে দিয়েছেন।
বাস্তব কথা হলো, যাহরাওয়ি যে কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, জটিল ও সূক্ষ্ম অপারেশন এবং চিকিৎসার যে থিউরি তিনি আবিষ্কার করেছেন, চিকিৎসা শাস্ত্রে অপারেশনের যে যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছেন সবগুলো বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সংক্ষিপ্ত একটি প্রবন্ধে সম্ভব নয়। বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, পর্যাপ্ত উদ্ভাবনদক্ষতা, গবেষণা, অভিজ্ঞতা, মনোনিবেশ, স্বহস্তে অপারেশন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে হাজার বছর পূর্বে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়কালের ধারাবাহিক পরিশ্রম সবগুলোই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেছে। তাকে সম্মানের উচ্চ শিখরে পৌঁছিয়েছে। তাকে ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সার্জন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি বর্ণাঢ্য জীবন শেষে নিজ শহর কর্ডোভায় ৪০৪ হিজরি মোতাবেক ১০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইহজগত ত্যাগ করেন।