বাঙালী কন্ঠঃ দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাত এখন চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে। অসম ও অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে তৈরী পোশাকের রফতানিমূল্য প্রতিনিয়ত কমছে। অথচ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত এক হাজার ৩০০ কারখানা। আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও হাতে কাজ না থাকায় সাময়িকভাবে উৎপাদনে নেই আরো অন্তত দেড় হাজার কারখানা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ শ্রমিক। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রফতানি আয়ে।
রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরী পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রা অবমূল্যায়ন হলেও বাংলাদেশে স্থিতিশীল রয়েছে। এসবের প্রভাবে দুর্যোগের ঘনঘটা বাজছে রফতানি বাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী দেশের সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্পখাতে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে; অর্থাৎ ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বিজিএমইএ গবেষণা সেলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ এই চার বছরে এক হাজার ২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকায় প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, তৈরী পোশাক শিল্পখাতের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা শ্রমিক অসন্তোষ। এ সমস্যাও ততটাও জটিল হতো না যদি শ্রমিক অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে পানি ঘোলা করায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পক্ষ তৎপর না থাকত। দ্বিতীয় যে সমস্যার কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প ধুঁকছে তা হলোÑ পণ্যের উপযুক্ত দাম না পাওয়া। শ্রমিকের মজুরি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশীদের শর্ত পূরণে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে গিয়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও তৈরি পণ্যের দাম বাড়ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানোর এই দুই প্রধান সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে চার মাস আগে উদ্যোক্তাদের বৃহত্তম সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হতাশার সুর বাজছে তার কণ্ঠেও।
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আসার ঘটনায় বিরক্ত বিজিএমইএ সভাপতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা আর পারছি না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মালিকেরা ২৫ হাজার শ্রমিককে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ সেক্টরকে টিকিয়ে রাখা কঠিন। বায়ারদের ওপর সমন্বিতভাবে চাপ দিতে হবে দাবি করে রুবানা বলেন, তারা কমপ্লায়েন্সের কথা বলবেন, কিন্তু পোশাকের দাম বাড়াবেন না তা হলে আমরা কিভাবে টিকে থাকব? তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে আমার সাক্ষাতে তিনি বলছিলেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে বায়াররাও নিশ্চয় কথা শুনবেন। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
রুবানা হকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে বিজিএমইএর বিদায়ী সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত চার বছরে (২০১৪-১৮) এক হাজার ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সদ্যবিদায়ী বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৮ সালে যখন পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়, তখন আমাদের একান্ত অনুরোধ ছিল, ব্যয়ের ক্ষেত্রগুলো যতটা সম্ভব কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা। সরকারের পক্ষ থেকে তখন এ ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল কিন্তু তা পূরণ করা হয়নি। তিনি বলেন, তিতাস গ্যাস কোম্পানি তার শেয়ারহোল্ডারদের ৩৫ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে, অথচ আমরা তো ২ শতাংশও ব্যবসা করতে পারছি না। তিতাসের কাছে আমার প্রশ্ন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কিভাবে এত মুনাফা দিতে পারে, যেখানে বলা হয় যে, ভর্তুকি নিয়ে তিতাস চলছে। আমরা মনে করি, বিইআরসি নির্ধারিত ভর্তুকি সরকার না দিলে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে অলস পড়ে থাকা অর্থ থেকে ঋণ নিয়ে বিতরণ কোম্পানিকে চালানো যেতে পারে কিন্তু শিল্পকে ধ্বংস করে নয়। শিল্প থাকলে কর্মসংস্থান হবে, দেশের অর্থনীতি বেগবান হবে।
এ দিকে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, উৎপাদিত পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় নীতি- নৈতিকতা ভুলে গিয়ে বায়াররা অস্বাভাবিক কম দাম অফার করে। কাজ না নিয়েও উপায় নেই। চলমান খরচের কথা ভেবে অনেক সময় বাধ্য হয়েই কম দরে অর্ডার নিচ্ছি, কখনো ফিরিয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া আমি রিফিউজ করলে কী হবে? অর্ডার তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। হয় আমার দেশেরই অন্য কোনো ফ্যাক্টরি নিয়েছে অথবা অন্য কোনো দেশে অর্ডার চলে গেছে। তিনি বলেন, কম দামে যারা অর্ডার নিচ্ছে তারা অর্ডার নিয়ে হয়তো লস করেছে ২৫ লাখ। আর না নিলে লস হতো এক কোটি টাকা।