প্রতিদিন অগণিত মিনিবাস চলে কলকাতার রাজপথে। হেলপারের তারস্বর চিৎকার, মিনিবাসের দরজায় মানুষের ঝুলতে থাকা, এসব চিত্র সবার কাছেই পরিচিত। এমনই অজস্র লাল-হলুদ মিনিবাসের মধ্যে একটি বাসের দৃশ্যপট একটু হলেও আলাদা। সেখানেও আছে কন্ডাক্টরের চিৎকার, বাসের দরজা ধরে মানুষের ঝুলতে থাকা, ভারি জিনিসপত্র রাখা নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে দর-কষাকষি, এ সবের মাঝেই লুকিয়ে আছে প্রতিমা! হ্যাঁ, তিনি প্রতিমা পোদ্দার; কলকাতার প্রথম নারী বাস চালক। বিশ্বাস করবেন কি? তিনিই এবার পূজার ‘থিম’ হয়ে উঠেছেন।
বিষয়টি অনেকের কাছে অবাক করা হলেও, এটাই আলোচনার বিষয়। সে সঙ্গে আরো বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। এই যেমন, ঢাক বাজানোর পেশায় নারীদের আগমন। একটা সময় ছিল, ঢাকের কাঠি শুধুই পুরুষের হাতে দেখা যেত। এবার নারীদের হাতে সেই ‘দায়িত্ব’ দেখে চমকে উঠছেন অনেকেই। নারীদের মণ্ডপ বানাতে কখনো দেখেছেন? পশ্চিমবঙ্গের নারীরা মিলে এবার পুরুষকেন্দ্রিক দুর্গাপূজার চিরাচরিত প্রথা কিছু ক্ষেত্রে হলেও ভাঙ্গা দিয়েছে।
প্রতিমা পোদ্দার ও তার স্বামী
প্রতিমা পোদ্দার ও তার স্বামী
‘স্টিয়ারিং’ প্রতিমা যখন মূল থিম
কলকাতার একমাত্র মহিলা বাস ড্রাইভার প্রতিমা। বাসের হেলপার তার স্বামী শিবেশ্বর। গত সাত বছর ধরে বাস চালাচ্ছেন প্রতিমা। এ নিয়ে মানুষ কত কথা বলে তার হিসেব নেই। কখনো কখনো মন খারাপ হতো তার। কিন্তু এই পূজায় প্রতিমার মন একেবারেই ভালো। পুরো বিষয়টাকে তিনি অবিশ্বাস্যও বলছেন! এবার তাকে ঘিরে কলকাতার একটি মণ্ডপের মূল থিম করা হয়েছে।
নব্বই দশক থেকেই দুর্গাপূজার একেকটা মণ্ডপ সাজানো হয় কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। ২০/৩০ বছর আগেও সেগুলোকে বলা হতো ‘আর্টের ঠাকুর’ আর চিরাচরিত, পুরাণে আখ্যায়িত রূপে যেসব প্রতিমা তৈরি হতো সেগুলো ‘সাবেকী ঠাকুর’। এরপর বিষয়টা আর শুধু প্রতিমা তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। প্রতিমা-মণ্ডপসজ্জা-আলোকসজ্জা, সব মিলে গড়ে উঠত একটা বিষয়কেন্দ্রিক ভাবনা। সেটারই চালু নাম ‘থিমের পূজা’।
সাধারণত কোনো চলতি সামাজিক বিষয় বা ক্রীড়া ক্ষেত্রের কোনো বিষয়, অথবা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা কোনো সময়ে আবার রাজনৈতিক-কূটনৈতিক এসব বিষয়ও উঠে আসে ‘থিমের পূজা’য়। কিন্তু কখনো প্রতিমা পোদ্দারের মতো একেবারে সাধারণ নারী পূজার ‘থিম’ হয়ে উঠেছেন, এমনটা আগে শোনা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিমা বলেন, যখন এরা প্রথম জানালেন যে আমাকে পূজার থিম করতে চান তারা, খুব অবাক হয়েছিলাম। এর আগে কয়েকটা টিভি অনুষ্ঠানে গিয়েছি- তাই অনেক মানুষ হয়তো আমার কথা জানেন। কিন্তু পূজার থিম হব আমি- এটা খুব অবাক করেছিল।
প্রতিমা পোদ্দার কলকাতা শহরে খুবই পরিচিত একজন। যে পূজাতে প্রতিমা পোদ্দারকে থিম করা হয়েছে, তা এক দেখাতেই চিনে ফেলবেন যে কেউ। পূজার ওই প্যান্ডেলে রয়েছে পোদ্দার যে বাসটি চালান তার প্রতিকৃতি, রুট ম্যাপ আর আস্ত একটি মূর্তি। পুরো মণ্ডপেই ছড়িয়ে আছে নারীশক্তির এই জীবন্ত চিহ্ন। এর মাধ্যমে পুরুষকেন্দ্রিক দুর্গাপূজার চিরাচরিত প্রথা ভেঙেছে।
ঢাক বাজাচ্ছেন নারীরা। ছবি: বিবিসি
ঢাক বাজাচ্ছেন নারীরা। ছবি: বিবিসি
ঢাকের কাঠি হাতে নারী
এই সময়ে কলকাতাজুড়ে পুরুষ ঢাকিদের বিচরণ। কিন্তু গত দু-তিন বছরে কিছু মণ্ডপের দৃশ্য বদলে দিয়েছে নারীরা। ঢাকের কাঠি হাতে নেয়ার দায়িত্বটা নিজেরাই নিয়েছেন। দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান পার্ক দুর্গা পুজার মণ্ডপে গেলেও দেখা মিলবে পুরুষকেন্দ্রিক দুর্গাপূজার চিরাচরিত প্রথা ভাঙার দৃশ্য। ঢাকের কাঠি হাতে নিতে পেরে ওই মেয়েরা বেশ সপ্রতিভ এবং হাসিখুশি।
নদীয়া জেলার হরিনঘাটার বাসিন্দা সন্ধ্যা দাস। কলকাতার পুজায় ঢাক বাজাচ্ছেন গত তিন বছর ধরে। জানা গেল, সন্ধ্যার পরিবারই ঢাকি পরিবান। বাবা ঢাক বাজান, বড়দা ঢাক বাজান। তারাই ওর শিক্ষাগুরু। কিন্তু হঠাৎ ঢাক বাজানোর ইচ্ছে হলো কেন? সন্ধ্যা কোনো রাখঢাক না করেই জানালেন, নানান আর্থিক সমস্যা আছে, যে জন্য এই লাইন বেছে নিয়েছি। দেখলাম পুজোর সময় মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক বাজানো যাচ্ছে, আবার আনন্দও পাওয়া যাচ্ছে৷ মায়ের দর্শনও পাচ্ছি।
মানসী দত্ত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মসলন্দপুরের নারী ঢাকিলের অন্যতম সদস্য। ঢাক বাজানোর মতো একটা পুরুষালি পেশায় এলেন কী করে? জবাবে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি যে ছেলেরাই ঢাক বাজায়। আমি যে কোনোদিন বাজাবো, ভাবিনি। বেশ কয়েকবছর আগে আমাদের শিক্ষক আর গুরু শিবপদ দাস একদিন এসে বললেন যে তিনি মেয়েদের নিয়ে ঢাকের দল গড়বেন। আমি শিখব কি না! রাজী হয়ে গেলাম। ব্যাস.. তারপর থেকে এটাই পেশা আমার।
এখন কলকাতা শহরের একাধিক মঞ্চে চোখে পড়ছে এই নারী ঢাকিদের। এমন নয় যে পুরুষ ঢাকিদের পেশা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তারা। বরং পুরুষদের সঙ্গেই ঢাক বাজাচ্ছেন তারা, যেটা সম্পূর্ণভাবে পুরুষশাসিত এক পেশার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে বিরোধিতাও যে আছে, সেটা বোঝা যায়। পুরুষ ঢাকিরা এখনো সহজ হতে পারেননি এই মেয়েদের উপস্থিতিতে। বরং তাদের একটু দূরত্বেই রাখেন পুরুষ ঢাকিরা।
মণ্ডপ সাজাচ্ছেন এক নারী। ছবি: বিবিসি
মণ্ডপ সাজাচ্ছেন এক নারী। ছবি: বিবিসি
নারীদের বানানো মণ্ডপ
পূজার কমপক্ষে এক মাস আগে থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়। তখন থেকে দেখা যায় পুরুষদের সরব উপস্থিতি। কেমন হবে পূজার মণ্ডপ, সেটাও ঠিক করেন পুরুষরা। কিন্তু দক্ষিণ পূর্ব কলকাতার একটি নামকরা পূজার প্যান্ডেল সবার চিন্তাধারা পাল্টে দিয়েছে। নারীরাও যে মণ্ডপের ডেকোরেশন করতে পারে তা দেখেছে সবাই। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম থেকে আসা নারীরাই ওই মণ্ডপের অঙ্গসজ্জা হাতে তৈরি করেছেন।
বেশ কয়েকজনের একটি দল আলোচিত কাজটি করেছেন। এই দলের অন্যতম সদস্য পার্ভতী দেবী। সোহরাই আর কোভার পেইন্টিং নামে স্বল্প পরিচিত এই আর্টফর্মে চার রঙের মাটি দেয়ালের গায়ে লেপে তার ওপরে চিরুনি দিয়ে ছবি এঁকেছেন তিনি। তিনি বলেন, পুরুষদের যে ক্ষমতা আছে, আমরাও সেই সব কাজই করতে পারি। আমাদের হাত থেকেও শিল্প বেরোয়। কোনো অংশেই পুরুষদের থেকে কম নই আমরা। আর গ্রামের বাড়িতে তো মেয়েরা এভাবেই দেয়াল ছবি আঁকি!
শিল্পী অনিতা দেবীর কথায়, এত বড় প্যান্ডেল বানানোর ক্ষমতা যে আমাদেরও আছে, সেই সাহসে ভর করেই এত বড় কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকদিন বাড়ি ছেড়ে থাকতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য পরিবারের কেউ কখনও বাঁধা দেয় না। তবে নিয়মিত ভিডিও কলে বাড়ির সঙ্গে কথা হয়- তারা আমাদের কাজ দেখে। আর শুধু কলকাতা নয় – দেশ বিদেশের নানা জায়গাতেই তো যাই আমরা শিল্পকলা দেখাতে।
কথায় আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আদিবাসি এই নারীদের জন্য কথাটি যেন ষোল আনা সত্য। নারীদের পরিচালিত ওই পূজা মণ্ডপের অন্যতম উদ্যোক্তা পুতুল গুপ্তের কাছে প্রশ্ন ছিল, ঘর-সংসার সামলিয়েও পূজার ব্যবস্থা করেন কীভাবে? জবাবে জানান, পূজার আগে আমরাই অনেকটা দশভুজা হয়ে উঠি। সবারই সংসার আছে, তারমধ্যেই মিটিং করে ঠিক করে নিই কে কোন কাজটা করবে। তারপরে আছে চাঁদা তুলতে বেরনো। প্রতিমা নিয়ে আসার কাজটা অবশ্য ছেলেরাই করে- আমরা পাশে থাকি। তারপরে পূজার দিনগুলোতে অনেক ভোরে উঠে সব আয়োজন করতে হয়। কিন্তু সারাদিনে যত মানুষ আসেন আমাদের পূজাতে, তাদের আনন্দ দেখে আমরা যেন আরও বেশি উৎসাহ পাই প্রতিবছর পূজার কাজে আরো জড়িয়ে পড়তে।
গল্পগুলোর বিষয় আলাদা আলাদা হলেও, একটি ক্ষেত্রে এক। সর্বজনীন দুর্গাপূজা মূলত হয়ে ওঠে পুরুষকেন্দ্রিক। ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে পুরোহিত কিংবা ঢাকি- সবাই পুরুষ। কিন্তু এই তিনটি গল্পই বলে দিচ্ছে, সময় পাল্টেছে। নারীরাও সব পারে। দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে নারীশক্তির যে জাগৃতি-ভাবনা, বাস্তবে তা ক্রমশই সাকার হচ্ছে।