ঢাকা , শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরজুড়ে শুধুই কান্না

হাওরে কান্নার রোল। কাঁদছে হাওর পাড়ের মানুষ। চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। একমুঠো ফসলও ঘরে তোলার সম্ভাবনা নেই। দিন দিন পানি বাড়ছেই। একই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ-শঙ্কা। প্রকৃতির এই বাস্তবতায় নির্বাক মানুষ। সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ মিলে বিশাল হাওর। দেশে বোরো ধানের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার ওই এলাকা। গোটা বছরই হাওর থাকে পানির নিচে। জানুয়ারির দিকে একটু শুকায়। আর এতেই জন্মে বোরো ফসল। এই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল কোটি মানুষ। হাওরের স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা শুরু এক সপ্তাহ আগে। সিলেট অঞ্চলে অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ঝড়-ঝাপটা। গোটা রাতই হচ্ছে বৃষ্টি। দিনেও সূর্যের দেখা মিলে কদাচিৎ। সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। ওই পাহাড়ি এলাকায়ও অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঢল নেমেছে উজান থেকে। আর সিলেটের বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গোটা সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। গতকালও সিলেটে অঝোরধারায় বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরও কোনো সুখবর দিতে পারেনি। গতকালের পূর্বাভাসে জানান দিয়েছে, আরও বৃষ্টিপাত হবে। তবে ৫ই এপ্রিল থেকে কিছুটা কমে যেতে পারে। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। সিলেট অঞ্চলের হাওরের শতকরা ৯৫ ভাগই তলিয়ে গেছে। এখনো আসেনি বোরো ধানের ‘থোড়’। এক সপ্তাহের মধ্যে থোড় আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে হাওরের অথৈ জলে। সুনাগঞ্জেই রয়েছে শতাধিক হাওর। এছাড়া হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট মিলিয়ে রয়েছে ছোট বড় আরো শতাধিক হাওর। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকলে সিলেটে জনপদও তলিয়ে যাবে। পাহাড়ি ঢলও আসছে প্রবল গতিতে। বোরো শস্যভাণ্ডার সুনামগঞ্জে শুরু হয়েছে হাহাকার। সবচেয়ে বড় হাওর শনির হাওর, দেখার হাওর, মাটিহানি হাওর, আলী হাওর, মুইল্লা হাওর, করছার হাওর, টগা হাওর সবই তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সবুজ ধানের কোনো অস্বিত্ব নেই। চারদিকে পানিতে একাকার। কৃষকরা জানিয়েছেন, শনিবার পর্যন্ত হাওরে থাকা ধান কিছুটা দেখা গেছে। এখন আর দেখা যায় না। পানির এক থেকে দেড় ফুট নিচে তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিক্ষোভ করেছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জে গত দুদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে অবস্থান নিয়েছে কৃষকরা। চোখের সামনে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দায়ী করেছে বাঁধকে। বলেছেন, সুনামগঞ্জের একটি হাওরে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। তাদের দাবি, বন্যার জন্যই অপেক্ষায় ছিল প্রশাসন। হাওরের ঢল থেকে ফসল রক্ষা করতে প্রতিবছরই সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ  নেয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাওরের বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের তরফ থেকে শুধু সুনামগঞ্জেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনো, ময়মনসিংহ মিলিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এসব বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল জানুয়ারির দিকে। আর ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনেক বাঁধের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। কার্যাদেশের পত্রে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে জানুয়ারি মাসের। এত বড় গাফলায় কৃষক হতাশ। ক্ষোভ বেড়েছে সুনামগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও। তাদের অবহেলাকেই দায়ী করছে কৃষক। নতুন করে নির্বাচিত হয়েছেন বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেন। কৃষকের কান্না দেখে তিনিও হতাশ। গেল কয়েকদিন তিনি নিজেই ঘুরে বেড়িয়েছেন হাওর পাড়ে। কৃষকের কান্না শুনেছেন। নিজেও কেঁদেছেন। আর প্রশাসনের খামখেয়ালিপনায় তিনি নিজেও অবাক হয়েছেন। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করার কারণেই এবার একটি হাওরকেও অকাল বন্যা থেকে রক্ষা করা যায়নি। এমন দাবি জোরালোভাবেই উপস্থাপন করছেন হাওর পাড়ের মানুষেরা। এ কারণেই তাদের ক্ষোভ। গতকাল সুনামগঞ্জ ও সিলেটে মানববন্ধন হয়েছে। আর এসব মানববন্ধন থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ না করলে ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হাওরজুড়ে শুধুই কান্না

আপডেট টাইম : ০৮:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ এপ্রিল ২০১৭

হাওরে কান্নার রোল। কাঁদছে হাওর পাড়ের মানুষ। চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। একমুঠো ফসলও ঘরে তোলার সম্ভাবনা নেই। দিন দিন পানি বাড়ছেই। একই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ-শঙ্কা। প্রকৃতির এই বাস্তবতায় নির্বাক মানুষ। সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ মিলে বিশাল হাওর। দেশে বোরো ধানের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার ওই এলাকা। গোটা বছরই হাওর থাকে পানির নিচে। জানুয়ারির দিকে একটু শুকায়। আর এতেই জন্মে বোরো ফসল। এই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল কোটি মানুষ। হাওরের স্বপ্নভঙ্গের যাত্রা শুরু এক সপ্তাহ আগে। সিলেট অঞ্চলে অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ঝড়-ঝাপটা। গোটা রাতই হচ্ছে বৃষ্টি। দিনেও সূর্যের দেখা মিলে কদাচিৎ। সিলেটের উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। ওই পাহাড়ি এলাকায়ও অঝোরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঢল নেমেছে উজান থেকে। আর সিলেটের বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গোটা সিলেটের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। গতকালও সিলেটে অঝোরধারায় বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরও কোনো সুখবর দিতে পারেনি। গতকালের পূর্বাভাসে জানান দিয়েছে, আরও বৃষ্টিপাত হবে। তবে ৫ই এপ্রিল থেকে কিছুটা কমে যেতে পারে। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। সিলেট অঞ্চলের হাওরের শতকরা ৯৫ ভাগই তলিয়ে গেছে। এখনো আসেনি বোরো ধানের ‘থোড়’। এক সপ্তাহের মধ্যে থোড় আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে হাওরের অথৈ জলে। সুনাগঞ্জেই রয়েছে শতাধিক হাওর। এছাড়া হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট মিলিয়ে রয়েছে ছোট বড় আরো শতাধিক হাওর। অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত থাকলে সিলেটে জনপদও তলিয়ে যাবে। পাহাড়ি ঢলও আসছে প্রবল গতিতে। বোরো শস্যভাণ্ডার সুনামগঞ্জে শুরু হয়েছে হাহাকার। সবচেয়ে বড় হাওর শনির হাওর, দেখার হাওর, মাটিহানি হাওর, আলী হাওর, মুইল্লা হাওর, করছার হাওর, টগা হাওর সবই তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সবুজ ধানের কোনো অস্বিত্ব নেই। চারদিকে পানিতে একাকার। কৃষকরা জানিয়েছেন, শনিবার পর্যন্ত হাওরে থাকা ধান কিছুটা দেখা গেছে। এখন আর দেখা যায় না। পানির এক থেকে দেড় ফুট নিচে তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিক্ষোভ করেছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জে গত দুদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে অবস্থান নিয়েছে কৃষকরা। চোখের সামনে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দায়ী করেছে বাঁধকে। বলেছেন, সুনামগঞ্জের একটি হাওরে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। তাদের দাবি, বন্যার জন্যই অপেক্ষায় ছিল প্রশাসন। হাওরের ঢল থেকে ফসল রক্ষা করতে প্রতিবছরই সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ  নেয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাওরের বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের তরফ থেকে শুধু সুনামগঞ্জেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনো, ময়মনসিংহ মিলিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এসব বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল জানুয়ারির দিকে। আর ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনেক বাঁধের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। কার্যাদেশের পত্রে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে জানুয়ারি মাসের। এত বড় গাফলায় কৃষক হতাশ। ক্ষোভ বেড়েছে সুনামগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও। তাদের অবহেলাকেই দায়ী করছে কৃষক। নতুন করে নির্বাচিত হয়েছেন বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেন। কৃষকের কান্না দেখে তিনিও হতাশ। গেল কয়েকদিন তিনি নিজেই ঘুরে বেড়িয়েছেন হাওর পাড়ে। কৃষকের কান্না শুনেছেন। নিজেও কেঁদেছেন। আর প্রশাসনের খামখেয়ালিপনায় তিনি নিজেও অবাক হয়েছেন। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করার কারণেই এবার একটি হাওরকেও অকাল বন্যা থেকে রক্ষা করা যায়নি। এমন দাবি জোরালোভাবেই উপস্থাপন করছেন হাওর পাড়ের মানুষেরা। এ কারণেই তাদের ক্ষোভ। গতকাল সুনামগঞ্জ ও সিলেটে মানববন্ধন হয়েছে। আর এসব মানববন্ধন থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ না করলে ভবিষ্যতেও এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।