ঢাকা , শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার চেতনা ও মুসলিম মানস

বাংলাদেশের সমাজ জীবনে যেমন দুর্নীতি ও ভেজালের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তেমনিভাবে আরেকটি ব্যাধির আক্রমণও দৃশ্যমান। তা হলো ইতিহাস-বিকৃতি। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ভূমিকা রাখছে শাসকগোষ্ঠী ও ক্ষমতাবানেরা। দেখা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো নিয়ে নানা বিভ্রান্তি। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ’৭১ সালের ১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিলের ঘোষণায় যে চারটি চেতনা উল্লিখিত হয়েছিল, তা ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতা। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অজানা কারণে ওই চেতনাগুলো প্রায় পরিত্যক্ত হয় এবং নতুন চেতনা তার পরিবর্তে গৃহীত হয়ে গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়। সেই নব্যচেতনাগুলো ছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এগুলো মূলত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। কারণ এগুলো ছিল আরোপিত ও বৃহত্তর গণমানুষের মূল্যবোধের বিপরীত। বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষ জানে, কার্ল মার্কস, লেনিন এবং মাও সে তুংয়ের প্রবর্তিত সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ তার মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্রকে ত্যাগ করেছে। তাই সমাজতন্ত্র হলো একটি পরিত্যক্ত মতবাদ। এ ছাড়া বিশ্বসমাজে কোথাও সম্প্রদায়বিহীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে বলে জানা নেই। মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে এবং নিজেদের পরিচয় ব্যক্ত করতে সম্প্রদায়ের প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ দ্বারা সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ে বৈষম্য, জুলুম ও বঞ্চনার সৃষ্টি করা ঘৃণাভরে পরিত্যক্ত। এরই প্রতিফলন দেখি মহান মদিনা সনদে, যা রাসূলুল্লাহ সা:-এর নেতৃত্বে মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিফলিত। ধর্মনিরপেক্ষতাও রাষ্ট্রমণ্ডলে পরিত্যাজ্য। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধ শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হবে এটাই স্বাভাবিক কাম্য ও গণতন্ত্রসম্মত। কিন্তু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস বা মূল্যবোধেও হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য। এটাই আল কুরআনের এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছেÑ ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’ (সূরা কাফিরুন)। সবাই তাদের ধর্মবিশ্বাসে স্বাধীন। কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। এ নির্দেশ মদিনা সনদে প্রতিফলিত হয়েছে এবং সে রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন সরকারের ঘোষিত চেতনাগুলো ছিল এক দিক দিয়ে মদিনা সনদ দ্বারা প্রভাবিত এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গণতন্ত্র : বাংলাদেশের মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সংগ্রাম করে আসছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। এ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইসলামি মূল্যবোধ ও মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘আমরুকুম বিশ্শ্যূরা বাইনাকুম’ অর্থাৎ তোমাদের জাগতিক বিষয়গুলোতে (রাষ্ট্র পরিচালনায়) পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সুরাহা করবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাসূলে খোদা (সা:) মদিনায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যার ভিত্তি ছিল পূর্বোল্লিখিত মদিনা সনদ। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন শাসকদের জবাবদিহিতা। ইসলামি সমাজব্যবস্থায় জবাবদিহিতার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের প্রথম যুগে রাষ্ট্রপ্রধান খলিফা থেকে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সব শাসকের জবাবদিহি করা বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া হাদিসে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণকে জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

সাম্য : আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে একজন নর ও একজন নারী থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তাই তারা পরস্পরের ভাই। তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। এটাই হলো ইসলামের শিক্ষা। আর এ শিক্ষাকে সমাজে বাস্তবায়নে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনার অনুষ্ঠানাদিতে সাম্য প্রতিষ্ঠার কার্যকর রীতিনীতি প্রবর্তন করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সালাত, সাওম, হজ ও জাকাত প্রতিপালনে। তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সবাইকে মর্যাদাবান করে সৃষ্টি করেছেন। তাই বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের কোনো স্থান নেই ইসলামি সমাজব্যবস্থায়। বলা হয়েছেÑ ‘ওয়া লাকাদ কাররাসনা বনি আদাম’। অন্য আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের এক নর ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে করে একে অপরের পরিচয় লাভে সমর্থ হও। আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সম্মানিত, যে হবে আল্লাহর অনুগত। (হুজুরাত-১৩ ও নিসা-১)।

মানবতা : মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি চেতনা হচ্ছে মানবতাবোধ, যা ইসলামি মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও তার কার্যকারণ ইসলামি সমাজে অবশ্যপালনীয়। তাই ইসলাম দারিদ্র্যকে জঘন্য ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বলেছেÑ (হাদিসে রাসূল) ‘দারিদ্র্য মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।’ ইসলামি সমাজব্যবস্থায় আল্লাহ তায়ালা জাকাতের মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের জন্য ২.৫ শতাংশ কর অপরিহার্য হিসেবে প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া বলা হয়েছে, ধনীদের সম্পদে রয়েছে সাহায্য প্রার্থী ও সর্বহারাদের অংশ (সূরা জারিয়াত-১৯)। বলা হয়েছে- ‘ওয়া ফি আমওয়ালিকুম হাক্কান লি মাসায়েলে ওয়াল মাহরুম।’ ইসলামি ব্যবস্থায় হালালভাবে সম্পদ অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেনতেনভাবে তা ব্যয়ের অধিকার দেয়া হয়নি। অপব্যয়কে হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা প্রতিপালক হিসেবে সব জীবের রক্ষা ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যদি তোমরা ভূপৃষ্ঠের জীবদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করো, তবে যিনি আসমানে রয়েছেন তিনি তোমাদের প্রতি মেহেরবানি করবেন (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।

ন্যায়পরায়ণতা : এটি ১৯৭১-এ মুজিবনগরে ঘোষিত চেতনার অংশ। ইসলামের প্রথম চুক্তি যা মদিনাবাসী মুসলিম, মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুহাজিরদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল; যা মদিনা সনদ হিসেবে খ্যাত- তার প্রধান বক্তব্য হলো ন্যায়নীতি ও ন্যায়পরায়ণতা। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান। আর এটাই মদিনা সনদের প্রতিটি ছত্রে ব্যক্ত হয়েছে। রাসূলে করিম সা: জীবিত থাকাকালীন একটি ঘটনা। বনি মাখজুম গোত্রের ফাতিমা নামের এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। তাকে রাসূল সা:-এর সামনে বিচারের জন্য হাজির করা হয়। কুরাইশদের কাছে বিষয়টি বড়ই বিব্রতকর হিসেবে দেখা দিলো। তাই তাদের পক্ষ থেকে শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করা হয়। রাসূল সা: এতে ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে একত্রিত করে বললেন- ‘তোমাদের আগের জাতিগুলো ধ্বংস হওয়ার প্রধান কারণ ছিল, তাদের দৃষ্টিতে যারা অভিজাত ছিল, তাদের কেউ অপরাধ করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো আর দুর্বল শ্রেণিভুক্ত কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! চুরির অপরাধে ধৃত এই ফাতিমা যদি মুহাম্মদ সা:-এর কন্যা ফাতিমা হতো, তবুও আমি তার হাত না কেটে ছাড়তাম না।’ তাই দেখা যায়, মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর আহ্বান হলোÑ ‘ইন্নাল্লাহা ইয়ামুরুকুম বিল আদলে ওয়াল ইহসান’, এর মানে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়বিচার ও সহমর্মিতার নির্দেশ দিচ্ছেন।
ইসলামি সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস। কিছু লোক দেশের মানুষকে সার্বভৌম বলে প্রচার চালাচ্ছেন এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসীদের মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করছেন। এ দেশের মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে এবং আরো বিশ্বাস করে, আল্লাহপ্রদত্ত নীতি-বিধান তার রাসূল আ:দের মাধ্যমে প্রেরিত, যা সমাজে বাস্তবায়নের দায়িত্ব আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের। তার বিধিবিধান সর্বজনীন ও ন্যায়নীতিভিত্তিক। আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা। তিনিই একমাত্র মানুষের প্রয়োজনীয় কল্যাণকর বিধিবিধান ও ক্ষতিকর বিধিবিধান (হালাল-হারাম) নির্দিষ্ট করতে পারেন। মানুষের দ্বারা তা অসম্ভব। কারণ মানুষ ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। তাই দেখা যায় শূকর, শরাব, জুয়া, গে ম্যারেজ ইত্যাদি মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয় পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক আইনসিদ্ধ করা হয়। এমনকি সোভিয়েত রাশিয়ায় সূচনাতে জঘন্য INCEST বা অজাচারকে বৈধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে সরকার আবার নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আজো অতি প্রগতিশীল কিছু ব্যক্তি বৃহত্তর অংশের মূল্যবোধকে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ তারা পৌত্তলিক ভাবধারার প্রদীপ ও মুখোশ শোভাযাত্রাকে এ দেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি বলে সমাজে প্রচলনের উৎসাহ দিচ্ছেন। তারা সত্যের প্রতি অন্ধ, মূক ও বধির।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

স্বাধীনতার চেতনা ও মুসলিম মানস

আপডেট টাইম : ০৪:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ এপ্রিল ২০১৭

বাংলাদেশের সমাজ জীবনে যেমন দুর্নীতি ও ভেজালের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তেমনিভাবে আরেকটি ব্যাধির আক্রমণও দৃশ্যমান। তা হলো ইতিহাস-বিকৃতি। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ভূমিকা রাখছে শাসকগোষ্ঠী ও ক্ষমতাবানেরা। দেখা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো নিয়ে নানা বিভ্রান্তি। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ’৭১ সালের ১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিলের ঘোষণায় যে চারটি চেতনা উল্লিখিত হয়েছিল, তা ছিল গণতন্ত্র, সাম্য, মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতা। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অজানা কারণে ওই চেতনাগুলো প্রায় পরিত্যক্ত হয় এবং নতুন চেতনা তার পরিবর্তে গৃহীত হয়ে গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়। সেই নব্যচেতনাগুলো ছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এগুলো মূলত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। কারণ এগুলো ছিল আরোপিত ও বৃহত্তর গণমানুষের মূল্যবোধের বিপরীত। বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষ জানে, কার্ল মার্কস, লেনিন এবং মাও সে তুংয়ের প্রবর্তিত সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ তার মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্রকে ত্যাগ করেছে। তাই সমাজতন্ত্র হলো একটি পরিত্যক্ত মতবাদ। এ ছাড়া বিশ্বসমাজে কোথাও সম্প্রদায়বিহীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে বলে জানা নেই। মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে এবং নিজেদের পরিচয় ব্যক্ত করতে সম্প্রদায়ের প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ দ্বারা সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ে বৈষম্য, জুলুম ও বঞ্চনার সৃষ্টি করা ঘৃণাভরে পরিত্যক্ত। এরই প্রতিফলন দেখি মহান মদিনা সনদে, যা রাসূলুল্লাহ সা:-এর নেতৃত্বে মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিফলিত। ধর্মনিরপেক্ষতাও রাষ্ট্রমণ্ডলে পরিত্যাজ্য। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধ শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হবে এটাই স্বাভাবিক কাম্য ও গণতন্ত্রসম্মত। কিন্তু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস বা মূল্যবোধেও হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য। এটাই আল কুরআনের এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছেÑ ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়াদ্বীন’ (সূরা কাফিরুন)। সবাই তাদের ধর্মবিশ্বাসে স্বাধীন। কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। এ নির্দেশ মদিনা সনদে প্রতিফলিত হয়েছে এবং সে রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন সরকারের ঘোষিত চেতনাগুলো ছিল এক দিক দিয়ে মদিনা সনদ দ্বারা প্রভাবিত এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গণতন্ত্র : বাংলাদেশের মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সংগ্রাম করে আসছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। এ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইসলামি মূল্যবোধ ও মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘আমরুকুম বিশ্শ্যূরা বাইনাকুম’ অর্থাৎ তোমাদের জাগতিক বিষয়গুলোতে (রাষ্ট্র পরিচালনায়) পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সুরাহা করবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাসূলে খোদা (সা:) মদিনায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যার ভিত্তি ছিল পূর্বোল্লিখিত মদিনা সনদ। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন শাসকদের জবাবদিহিতা। ইসলামি সমাজব্যবস্থায় জবাবদিহিতার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের প্রথম যুগে রাষ্ট্রপ্রধান খলিফা থেকে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সব শাসকের জবাবদিহি করা বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া হাদিসে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণকে জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

সাম্য : আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে একজন নর ও একজন নারী থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তাই তারা পরস্পরের ভাই। তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। এটাই হলো ইসলামের শিক্ষা। আর এ শিক্ষাকে সমাজে বাস্তবায়নে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনার অনুষ্ঠানাদিতে সাম্য প্রতিষ্ঠার কার্যকর রীতিনীতি প্রবর্তন করেছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সালাত, সাওম, হজ ও জাকাত প্রতিপালনে। তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সবাইকে মর্যাদাবান করে সৃষ্টি করেছেন। তাই বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের কোনো স্থান নেই ইসলামি সমাজব্যবস্থায়। বলা হয়েছেÑ ‘ওয়া লাকাদ কাররাসনা বনি আদাম’। অন্য আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের এক নর ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে করে একে অপরের পরিচয় লাভে সমর্থ হও। আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সম্মানিত, যে হবে আল্লাহর অনুগত। (হুজুরাত-১৩ ও নিসা-১)।

মানবতা : মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি চেতনা হচ্ছে মানবতাবোধ, যা ইসলামি মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও তার কার্যকারণ ইসলামি সমাজে অবশ্যপালনীয়। তাই ইসলাম দারিদ্র্যকে জঘন্য ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বলেছেÑ (হাদিসে রাসূল) ‘দারিদ্র্য মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।’ ইসলামি সমাজব্যবস্থায় আল্লাহ তায়ালা জাকাতের মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের জন্য ২.৫ শতাংশ কর অপরিহার্য হিসেবে প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া বলা হয়েছে, ধনীদের সম্পদে রয়েছে সাহায্য প্রার্থী ও সর্বহারাদের অংশ (সূরা জারিয়াত-১৯)। বলা হয়েছে- ‘ওয়া ফি আমওয়ালিকুম হাক্কান লি মাসায়েলে ওয়াল মাহরুম।’ ইসলামি ব্যবস্থায় হালালভাবে সম্পদ অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেনতেনভাবে তা ব্যয়ের অধিকার দেয়া হয়নি। অপব্যয়কে হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা প্রতিপালক হিসেবে সব জীবের রক্ষা ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যদি তোমরা ভূপৃষ্ঠের জীবদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করো, তবে যিনি আসমানে রয়েছেন তিনি তোমাদের প্রতি মেহেরবানি করবেন (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।

ন্যায়পরায়ণতা : এটি ১৯৭১-এ মুজিবনগরে ঘোষিত চেতনার অংশ। ইসলামের প্রথম চুক্তি যা মদিনাবাসী মুসলিম, মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুহাজিরদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল; যা মদিনা সনদ হিসেবে খ্যাত- তার প্রধান বক্তব্য হলো ন্যায়নীতি ও ন্যায়পরায়ণতা। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান। আর এটাই মদিনা সনদের প্রতিটি ছত্রে ব্যক্ত হয়েছে। রাসূলে করিম সা: জীবিত থাকাকালীন একটি ঘটনা। বনি মাখজুম গোত্রের ফাতিমা নামের এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। তাকে রাসূল সা:-এর সামনে বিচারের জন্য হাজির করা হয়। কুরাইশদের কাছে বিষয়টি বড়ই বিব্রতকর হিসেবে দেখা দিলো। তাই তাদের পক্ষ থেকে শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করা হয়। রাসূল সা: এতে ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে একত্রিত করে বললেন- ‘তোমাদের আগের জাতিগুলো ধ্বংস হওয়ার প্রধান কারণ ছিল, তাদের দৃষ্টিতে যারা অভিজাত ছিল, তাদের কেউ অপরাধ করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো আর দুর্বল শ্রেণিভুক্ত কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! চুরির অপরাধে ধৃত এই ফাতিমা যদি মুহাম্মদ সা:-এর কন্যা ফাতিমা হতো, তবুও আমি তার হাত না কেটে ছাড়তাম না।’ তাই দেখা যায়, মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর আহ্বান হলোÑ ‘ইন্নাল্লাহা ইয়ামুরুকুম বিল আদলে ওয়াল ইহসান’, এর মানে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়বিচার ও সহমর্মিতার নির্দেশ দিচ্ছেন।
ইসলামি সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস। কিছু লোক দেশের মানুষকে সার্বভৌম বলে প্রচার চালাচ্ছেন এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসীদের মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করছেন। এ দেশের মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে এবং আরো বিশ্বাস করে, আল্লাহপ্রদত্ত নীতি-বিধান তার রাসূল আ:দের মাধ্যমে প্রেরিত, যা সমাজে বাস্তবায়নের দায়িত্ব আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের। তার বিধিবিধান সর্বজনীন ও ন্যায়নীতিভিত্তিক। আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা। তিনিই একমাত্র মানুষের প্রয়োজনীয় কল্যাণকর বিধিবিধান ও ক্ষতিকর বিধিবিধান (হালাল-হারাম) নির্দিষ্ট করতে পারেন। মানুষের দ্বারা তা অসম্ভব। কারণ মানুষ ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। তাই দেখা যায় শূকর, শরাব, জুয়া, গে ম্যারেজ ইত্যাদি মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয় পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক আইনসিদ্ধ করা হয়। এমনকি সোভিয়েত রাশিয়ায় সূচনাতে জঘন্য INCEST বা অজাচারকে বৈধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে সরকার আবার নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আজো অতি প্রগতিশীল কিছু ব্যক্তি বৃহত্তর অংশের মূল্যবোধকে সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ তারা পৌত্তলিক ভাবধারার প্রদীপ ও মুখোশ শোভাযাত্রাকে এ দেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি বলে সমাজে প্রচলনের উৎসাহ দিচ্ছেন। তারা সত্যের প্রতি অন্ধ, মূক ও বধির।