আমরা বাংলাদেশিরা স্টেরিওটাইপিং-এ আক্রান্ত একটা রেইসিস্ট দেশ। এইটাও কি একটা স্টেরিওটাইপড রেইসিস্ট মন্তব্য হইলো? মনে হয় না।
আমারে একজন ইনবক্সে জিগাইলেন, আমার বাঙ্গালীদের উপর এত ‘গোস্সা’ ক্যানো? বাঙ্গালীদের এত এত ভালো জিনিস রাইখা আমি ক্যানো খালি খারাপ জিনিসটাই দেখি? আমার ক্যানো শরীর ভর্তি এত রাগ? নিশ্চয় আমার ‘স্বামী’ আমারে দুইবেলা পেটান, তাই আমি ফেইসবুকে আইসা ‘লাইক’এর আশায় নিজের রাগ ‘ভালোমানুষ’ বাঙ্গালীদের উপর ঝাড়ি!
আমি মনে করি, আমাদের যা ‘ভালো’ তা অন্যেরা বলুক, আমরা বীরের জাতি, আমরা হেন্ আমরা তেন্ এইসব নিয়া আমাদের জাতীয়তাবাদি লাফানো তো অনেক হইলো, এইবেলা আমাদের যা ‘খারাপ’, আমাদের যা ‘সমস্যা’ তা আমরাই আগে আইডেন্টিফাই করি! চোখ বন্ধ কইরা গর্তে মাথা ঢুকাইয়া পাছা বাইর কইরা ‘আমি ভালো’, ‘আমি ভালো’ এই কথা আমরা আর কতদিন নিজেদের বলবো?
আমরা কি আসলেই ভালো?
লন্ডনে প্রচুর বাংলাদেশিরে আমি বিদেশি বিয়া করতে দেখছি। এই বিদেশিরা সকলেই সাদা চামড়ার অধিকারী। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কাউরে এই যাবৎকালে কোনো বাংলাদেশি বিয়া করছেন বইলা আমি শুনি নাই। আর করবেনই বা কীভাবে? বাংলাদেশে এখনো ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি মার্কা সাদা চামড়ার পা-চাটা ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ বিক্রি হয়। এখনো বিয়ার সময় দুই পক্ষ ফর্সা ছেলে বা ফর্সা মেয়ে খোঁজেন। মানুষ এখনো বলেন, ‘কালো হলেও ওর মনটা কিন্তু ভালো!’ যেন, কালো মানুষের মন ভালো হওয়ার কথা না। উনারটা যে হইছে, সেইটা একটা সপ্তম আশ্চর্য্য! বাংলাদেশের কালো মেয়েরা নিজেদের হীনমন্যতা ঢাকার জন্য গান শিখেন, নাচ শিখেন, রান্না শিখেন, পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করেন, কারণ উনি জানেন, উনার কাছে বিয়ার যৌতুকের জন্য গায়ের ‘ফর্সা’ রঙ নাই! মানুষ এখনো কালো রংরে ‘ময়লা’ এবং সাদা রংরে ‘পরিষ্কার’ ধরেন। মানুষ এখনো আফ্রিকানদের ‘নিগ্রো’ ডাকেন। টিভিতে, নাটকে, ফিল্মে এখনো কালো রঙ্গের নায়ক নায়িকা দেখা যায় না!
শুধু গায়ের রঙ না, আমরা অঞ্চল মারফতও রেইসিস্ট। আমাদের বরিশালের লোকেরা নাকি ডাকাত, আমাদের চিটাগং-এর লোকেরা নাকি অহংকারী, আমাদের কুমিল্লার সব লোকেদের মন নাকি ‘কু’ দিয়া বানানো, আমাদের জামালপুরের লোকেরা নাকি বদরাগী, আমাদের ময়মনসিংহের সব লোক নাকি রিক্সাওয়ালা এবং কাজের বুয়া! আমি নিজে আমার উচ্চশিক্ষিত খালারে বলতে শুনছি, নোয়াখালির সব লোক নাকি স্বার্থপর! (হ, নিশ্চই, বাংলাদেশের আর বাদবাকী জনগণ খুব নিঃস্বার্থ হাজি মোহাম্মদ মহসিন!)
অঞ্চলের প্রভাব মানুষের উপর থাকবে এইটা স্বাভাবিক, যেমন পাহাড়ে থাকা মানুষদের পরিশ্রমী হইতে হয়, নদীর আশেপাশের লোকেদের মাছ ধইরা জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, গরম অঞ্চলের মানুষদের তুলনামূলক অলস হইতে হয়, কিন্তু এলাকা ধইরা সব মানুষরে খারাপ বলা বা স্টেরিওটাইপ করা অসম্ভব একটা কাজ। এবং একমাত্র বাংলাদেশের লোকদের পক্ষেই তা করা সম্ভব।
ভালো মানুষ হওয়ার জন্য আপনার মাত্র একটা জিনিসই দরকার, তার নাম এমপ্যাথি। অর্থাৎ, সহমর্মিতা। আর কিছুই না। কিছুই না। ভালো মানুষ যেইরকম শুধুমাত্র বিশেষ তুন্দ্রা অঞ্চলে একমাত্র ফর্সা গায়ের রঙ নিয়া জন্মান না, খারাপ মানুষও তেমনি অঞ্চল ধইরা, গায়ের রঙ ধইরা আসেন না। আমার শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। আমার শাশুড়ির মত ভালোমানুষ আমি দুনিয়াতে খুব কম লোকরেই দেখছি। আমার দেখা সবচাইতে হ্যান্ডসাম মানুষদের মধ্যে আমার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কলিগ আছেন। আমার মা ময়মনসিংহের মেয়ে হইয়া রিক্সা চালান না। আমার সিলেটি বন্ধুরা শুধু সিলেটিদের সাথেই মিশেন না। আমার নাস্তিক বন্ধুরা মুসলিমদের ঘৃণা করেন না। আমার মুসলিম বন্ধুরা সবাই মাথায় হিজাব লাগান না। আমার চিটাগং-এর বন্ধুরা সবাই একগাদা ঝাল খান না। আমার দেখা সবচাইতে ভালো মানুষ একজন কুমিল্লার লোক।
ডিয়ার ব্রাদারস এ্যান্ড সিস্টারস, রেইসিজম থিকা বাইর হইয়া, মানুষরে মানুষ হিসাবে দেখেন। অন্ততঃ ট্রাই করেন।
পাকিস্তানি বইলাই একজনরে ঘৃণা করতে হবে, এমন চিন্তা জাতীয়তাবাদি নোংরা এবং মধ্যযুগীয় প্রো-জাফর-ইকবালীয় চিন্তা। কালো বইলা একজন ছেলে বা মেয়ের বিয়া হবে না, বা আফ্রিকান বইলা একজন মানুষরে গুন্ডা বদমাশ রেইপিস্ট ভাবা- এমন চিন্তা খুবই ঔপনিবেশবাদে আক্রান্ত নিচুশ্রেণির মানসিকতা। খারাপ মানুষ কোনো বিশেষ জাতির, কোনো বিশেষ দেশের, কোনো বিশেষ গায়ের রঙ্গের, কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষ না। খারাপ মানুষ দুনিয়ার সব জায়গাতেই আছেন। ভালো মানুষও সব জায়গাতে আছেন।
নিজের অঞ্চলরে উপরে উঠানোর জন্য, অন্য অঞ্চলরে আপনার নিচে নামানো জরুরী না।
নিজের গায়ের রঙরে ব্রাহ্মণ বানানোর জন্য, বাকি গায়ের রঙদের নমঃশুদ্র বানানো জরুরী না। আর ব্রাহ্মণ ক্যানো বানাইবেন, তাও একটা প্রশ্ন। (লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)