ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে দখলরাজ আফজাল

আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না তার। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন। সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। সংসদ সদস্য হয়ে নেমে পড়েন এলাকার জলমহাল, জমি দখলসহ নানা অপরাধে। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের (নিকলী-বাজিতপুর) সাবেক এই সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন, ওই আসন থেকে টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছেন

এলাকায় অভিযোগ রয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন আফজাল হোসেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহযোগিতায় ও বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন নেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আফজাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১২ সালের জুন থেকে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালের পর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তার ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান।

আনোয়ার বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে জলমহাল, খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর ও বালুমহাল দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মানুষকে মামলায় হয়রানি ও মাদক কারবারের অভিযোগও রয়েছে। পরিস্থিতি এতই ভীতিকর ছিল যে, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পেত না। যারা দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।

এলাকায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে প্রায় ২ একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় ৮ একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।

এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট (আফজালের নিজের বাসভবন), বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা এবং বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি দখল করেন।

২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এমপি ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়া নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজবাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দেওয়া হয়। তার ২৯ শতাংশ জমিও দখল করে নেন দুই ভাই।

ভুক্তভোগী বিল্লাল মিয়া বলেন, আমার জায়গা দখল করছে। আমার জায়গায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার গাছ ছিল, এগুলোও নিয়ে গেছে। আমার জায়গার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।

বাজিতপুর পৌর এলাকার সিনেমা হল সড়কে একটি দোকানের মালিক চঞ্চল। তার দোকানও দখল করে নেন আফজাল ও তার ভাই আশরাফ। ভুক্তভোগী চঞ্চল বলেন, আমার দোকান প্রায় তিন বছর তালা দিয়ে রাখে। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু দোকান উদ্ধার করতে পারিনি তখন। ৫ আগস্টের পর দোকান দখলমুক্ত করি।

অন্যদিকে, ঢাকা ৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে আফজাল তার স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে ৫ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা।

এভাবে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তার আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকর্মী জানান, ঢাকায় ২০২৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্লাব) কার্যালয়ে মো. কামাল হোসেন রিপন নামে এক ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলন করে আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। আফজাল হোসেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী।

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক তার ফেসবুক আইডি থেকে আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকসংক্রান্ত একটি নিউজ শেয়ার দেন। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে।

বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি এহসান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে চিহ্নিত যে কয়টি উপজেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল, তার মধ্যে বাজিতপুর অন্যতম। তারা দুই ভাই এই রাজত্ব গড়ে তুলেছিল। এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করেনি।’

এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায় এবং তাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে কোনো ফাইল ওপেন হয়নি। এ বিষয়ে হেড অফিস বলতে পারবে। আর তার ভাই আশরাফের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তার সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদবিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, এসব অভিযোগে আফজালের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে দখলরাজ আফজাল

আপডেট টাইম : ০৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না তার। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন। সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। সংসদ সদস্য হয়ে নেমে পড়েন এলাকার জলমহাল, জমি দখলসহ নানা অপরাধে। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের (নিকলী-বাজিতপুর) সাবেক এই সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন, ওই আসন থেকে টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছেন

এলাকায় অভিযোগ রয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন আফজাল হোসেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহযোগিতায় ও বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন নেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আফজাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১২ সালের জুন থেকে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালের পর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তার ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান।

আনোয়ার বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে জলমহাল, খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর ও বালুমহাল দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মানুষকে মামলায় হয়রানি ও মাদক কারবারের অভিযোগও রয়েছে। পরিস্থিতি এতই ভীতিকর ছিল যে, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পেত না। যারা দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।

এলাকায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে প্রায় ২ একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় ৮ একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।

এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট (আফজালের নিজের বাসভবন), বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা এবং বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি দখল করেন।

২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এমপি ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়া নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজবাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দেওয়া হয়। তার ২৯ শতাংশ জমিও দখল করে নেন দুই ভাই।

ভুক্তভোগী বিল্লাল মিয়া বলেন, আমার জায়গা দখল করছে। আমার জায়গায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার গাছ ছিল, এগুলোও নিয়ে গেছে। আমার জায়গার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।

বাজিতপুর পৌর এলাকার সিনেমা হল সড়কে একটি দোকানের মালিক চঞ্চল। তার দোকানও দখল করে নেন আফজাল ও তার ভাই আশরাফ। ভুক্তভোগী চঞ্চল বলেন, আমার দোকান প্রায় তিন বছর তালা দিয়ে রাখে। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু দোকান উদ্ধার করতে পারিনি তখন। ৫ আগস্টের পর দোকান দখলমুক্ত করি।

অন্যদিকে, ঢাকা ৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে আফজাল তার স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে ৫ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা।

এভাবে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তার আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকর্মী জানান, ঢাকায় ২০২৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্লাব) কার্যালয়ে মো. কামাল হোসেন রিপন নামে এক ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলন করে আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। আফজাল হোসেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী।

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক তার ফেসবুক আইডি থেকে আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকসংক্রান্ত একটি নিউজ শেয়ার দেন। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাকে।

বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি এহসান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে চিহ্নিত যে কয়টি উপজেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল, তার মধ্যে বাজিতপুর অন্যতম। তারা দুই ভাই এই রাজত্ব গড়ে তুলেছিল। এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করেনি।’

এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায় এবং তাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে কোনো ফাইল ওপেন হয়নি। এ বিষয়ে হেড অফিস বলতে পারবে। আর তার ভাই আশরাফের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তার সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদবিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, এসব অভিযোগে আফজালের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।