মাশা আলালাইকিনা ছিলেন রাশিয়ার একজন খ্যাতিমান মহিলা শিল্পী ও মডেল। কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন শিল্প অঙ্গনের জনপ্রিয় তারকা। কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই এ অঙ্গনকে গুডবাই জানিয়ে নানা প্রশ্ন ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করেন মাশা।
অবশ্য অল্প ক’ দিন পরই কেটে যায় রহস্যের মেঘ। কারণ, খবর আসে যে, “মাশা আলালাইকিনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তিনি দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যের চেয়ে সতীত্ব ও ঈমানের পোশাককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।”
যারা বস্তুগত সুখ-সুবিধা বা আরাম-আয়েশ ও বিলাসী জীবনকে গুরুত্ব দেয় তাদের কাছে এ খবর ছিল অবিশ্বাস্য। কারণ, মাশা খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন এবং অনেক বড় বড় চুক্তির প্রস্তাব আসছিল তার কাছে। কিন্তু তিনি অগ্রাহ্য করলেন খ্যাতি ও অর্থ।
মাশা আলালাইকিনা খুব ভালোভাবেই এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্র শিল্প চারিত্রিক অনাচার ও কলুষতাযুক্ত এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের কোনো স্পর্শও সেখানে নেই। তাই তিনি হিজাব ও চারিত্রিক পবিত্রতাকেই বেছে নিয়েছেন। মাশা আলালাইকিনা এখন ইসলামী শালীন পোশাক পরেন। স্কুলের শিক্ষকতা এখন তার পেশা। তিনি এখন তার জীবনের অতীতের ‘গ্ল্যামার’ বা কৃত্রিম চাকচিক্যকে ঘৃণা করেন। অন্যদিকে বর্তমানে একজন পর্দানশীন মুসলিম মহিলা হিসেবে জীবন যাপনকে সৌভাগ্য বলেই মনে করছেন মাশা।
মানুষ সৌন্দর্য্য-পিয়াসী। এটা তার প্রকৃতি বা স্বভাবগত বিষয়। অবশ্য তার প্রকৃতি চরম সৌন্দর্য্য-অভিসারী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসেন।” কিন্তু জরুরি বিষয় হল, সৌন্দর্য্যের কোন অংশ কখন, কোথায় ও কার কাছে দেখাতে হবে বা গোপন রাখতে হবে তা জানতে হবে মানুষকে। যে সৌন্দর্য্য মানুষকে প্রতারিত করে ও অনাচার বা দুর্নীতি ডেকে আনে তা পরিহার করতে হবে। সব ধরনের সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য্য যে বাস্তব এবং গ্রহণযোগ্য নয় তা মহান আল্লাহ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সুরা হিজর-এর ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ শয়তানের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, “শয়তান বলল: হে আমার পলনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথ ভ্রষ্ট করেছেন, আমিও মানুষের জন্য পৃথিবীতে সাজ-সরঞ্জামগুলো সুশোভিত করে তুলব এবং নিশ্চয়ই আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব। আপনার পরিশুদ্ধ (মনোনীত) বান্দাদের ছাড়া।”
প্রকৃত সৌন্দর্য্যের রয়েছে বাহ্যিক দিক
ও সুপ্ত বা আত্মিক দিক। এ ধরনের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় মূল্যবোধ। হিজাবই এর দৃষ্টান্ত। মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত হয়েছে এই সংস্কৃতি। অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও পূর্ণতার জন্যই হিজাবধারী নারী তাদের কোনো কোনো বাহ্যিক সৌন্দর্য্য প্রকাশ করেন না। হিজাবের সৌন্দর্য্য মাশা আলালাইকিনা-কে দিয়েছে সেইসব অভ্যন্তরীন সৌন্দর্য্য। ইসলাম তাকে দিয়েছে প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
“একদিন খবর পেলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন অন্য এক শহরে এক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। কিভাবে তাকে সাহায্য করতে পারি তা বুঝতে পারছিলাম না। সেদিন প্রথমবারের মত প্রার্থনা করলাম এবং হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করলাম। পরদিন আমার ওই বন্ধু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলল, আমি বেহুঁশ অবস্থায় তোমাকে দেখেছি। তুমি আমার অনেক সাহায্য করেছ। তার ওই কথা শুনে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কারণ, জীবনে এই প্রথম আমি আল্লাহর কাছে কিছু চেয়েছিলাম এবং আল্লাহও আমাকে তা দিয়েছেন। এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে মানুষ আল্লাহর দয়ায় তাঁর দিকে এগিয়ে যায় এবং এটা কেবল তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটে।”
মাশা আলালাইকিনা মনে করেন ইসলাম অন্য ধর্মগুলোর তুলনায় জীবনে বেশি কাজে লাগে। তিনি বলেছেন, “অন্য ধর্মগুলোর তুলনায় ইসলামের ভিত্তি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। ইসলামের সব বিধানই জীবনে কাজে আসে এবং ইসলামের পথ সৌভাগ্য বয়ে আনে। মুসলমান হয়ে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি অতীতে কী ছিলাম ও এখন কী হয়েছি তা তুলনা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি এখন বুঝতে পেরেছি প্রকৃত জীবনের অর্থ, তাই আমি সৌভাগ্যবান।”
মানুষের প্রকৃতি যে সত্য-সন্ধানী ও স্রস্টার ইবাদত করতে আগ্রহী তার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে মাশা আলালাইকিনা’র অভিজ্ঞতায়। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি নিশ্চিত যে আল্লাহ আমাদেরকে এ জন্য চিন্তাশক্তি ও বিবেক দেননি যে, কেবল খাব, ঘুমাব ও এভাবে জীবন-যাপন করে একদিন মরে যাব। আল্লাহ আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন যাতে আমরা তাঁকে খুঁজে পাই। যারা ইসলামের পথে এগুতে চান তাদেরকে অবশ্যই চিন্তাশীল হতে হবে এবং নিজ প্রকৃতি থেকে সাহায্য নিতে হবে। ইসলাম ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে।”
ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। হিজাব নারীর ওপর কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না। ইসলাম সমাজে নারীর সৃষ্টিশীল ক্ষমতা ও ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়। সমাজ পরিচালনায় নারীর ভূমিকাকেও উপেক্ষা করে না এই ধর্ম। নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) বলেছেন, “নারীই সব সৌভাগ্যের উৎস। নারীর বা মায়ের শিক্ষাই পুরুষকে মেরাজ বা উঁচু অবস্থানে পৌছে দেয়। নারী হল সমাজের শিক্ষক। সমাজের সৌভাগ্য ও নৈরাজ্য নির্ভর করে নারীর ওপর। সমাজের সংস্কার বা শান্তি এবং অনাচার বা দুর্নীতি নারীর পরিশুদ্ধি ও অনাচার থেকে উৎসারিত হয়।”
অমুসলমান থেকে মুসলমান হওয়া মাশা আলালাইকিনা মনে করেন হিজাব আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি বা নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। নগ্নতা ও যৌন অনাচার পশ্চিমা সমাজের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেছে। তিনি পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারী স্বাধীনতা বা লাগামহীন অনৈতিক জীবনযাপনের লাইসেন্সকে সত্যিকারের স্বাধীনতা বলে মনে করেন না। বরং হিজাবকেই প্রকৃত স্বাধীনতা মনে করেন মাশা। তিনি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি তুচ্ছ ও মূল্যহীন বিষয়গুলো অর্জনের চেষ্টা পরিহার করা, বরং উচ্চতর ও ভালো কিছু বেছে নেয়া। ইসলাম বলে আল্লাহ সম্পর্কে ভাবতে যদি অক্ষমও হও, অন্ততঃ নিজের কুপ্রবৃত্তি বা নফসের খেয়ালীপনার দাসত্ব থেকে মুক্ত হও এবং আত্মম্ভরিতা, নিজেকে বড় মনে করা, হিংসা, জুলুম, মিথ্যাচার ও নিজেকে জাহির করার মত নফসের কলুষতাগুলো দূর কর।”
আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাগুলো অর্জনে মনোযোগী মাশা হজ্বব্রত পালন করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “কখনও এ চিন্তাই মাথায় আসেনি যে একদিন হজ্বযাত্রী হব এবং সবচেয়ে ভালো ও সুস্বাদু পানি তথা জমজমের পানি পান করতে পারব। দুই বছর হল আমি মুসলমান হয়েছি। ইউরোপের ৫টি ভাষায় আমার দক্ষতা আছে। আমি বর্তমানে স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। প্রথমদিকে ভাবতাম আরবী ভাষা শেখা বেশ কঠিন হবে। কিন্তু এখন এ ভাষা শিখতে শুরু করার পর দেখছি, এ খুবই মিষ্টি ভাষা। আমি মনে করি আরবী ভাষা উচ্চতর জ্ঞান বোঝার চাবিকাঠি।”
যারা এখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে অসার এবং প্রতারণামূলক প্রচারণার ডামাডোল বা হৈ-চৈ থেকে মুক্ত হয়ে স্রস্টা সম্পর্কে ভাবার ও নিজেকে আবিস্কারের সবিনয় আবেদন জানিয়েছেন মাশা আলালাইকিনা। মুসলিম ভাইবোনদের সৎকাজগুলো আল্লাহ কবুল করবেন এবং তাদের ঘরে আল্লাহর রহমত আসুক-এই প্রার্থনা করছেন রুশ নও-মুসলিম মাশা আলালাইকিনা।-প্যারিস টুডে