বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এখন চলছে বোরো ধান ঘরে তোলার শেষ প্রক্রিয়া। তাই গোলায় ধান উঠাতে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণীরা। রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরিতেও চলছে ধানঝাড়া ও শুকানোর কাজ। আর চলছে এ মৌসুমে ধান প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশ। এবছর প্রাপ্তিতে এমন মিল-অমিলের দ্বন্দ্বে হাওরের বিল এলাকার বোরো চাষিরা হতাশ। এবার হাওরজুড়ে ধানের চাষ হয়েছে। কিন্তু মন ভরেনি কৃষকের। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না হওয়ায় প্রাণহীন কৃষক।
জানা গেল, এর অন্যতম কারণ ব্লাস্ট রোগ। আর বজ্রপাতের ভয়ে শ্রমিক সংকট। মৌসুমে ৫০০-৬০০ টাকা মজুরি দিয়েও মিলেনি ধান কাটার শ্রমিক। এবছর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ আর বজ্রপাতের ভয়ে প্রায় ১০-১৫ শতাংশ ধানই ঘরে তুলতে পারেননি হাওরপাড়ের কৃষক। গেল বছর আগাম বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছিলেন এজেলার বোরো চাষিরা। সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছিল এবারকার হাওরজুড়ে বোরো ধানের বাম্পার ফলন। মৌসুমের শুরুতে চাষকৃত বোরো ধান স্বপ্ন প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছিল তাদের। কিন্তু ধান পাকতে শুরু হলেই সে স্বপ্ন প্রত্যাশায় ভাটা পড়তে থাকে। কারন মেলেনি কাঙ্খিত ফলন। এতে বোরো চাষীরা ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও লাভবান হতে না পারায় হতাশ।
বিশেষ করে জেলার হাকালুকি হাওরের বিল এলাকায় এ সমস্যা ছিল প্রকট। তবে কাউয়া দিঘি আর হাইল হাওরে বোরো ধানের উৎপাদন ছিল তোলনামূলক ভালো। এবছর হাওরের ব্রি-ধান ২৮ শে ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণে ছিটা হয়ে যায়। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় ব্রি-ধান ২৯ শেও এই সমস্যা হয়। তবে বিআর ১৪ (গাজি) ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এবছর আগাম ফসল হিসেবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ব্রি-ধান ২৮ ও ব্রি-ধান ২৯ বেশি পরিমানে চাষ করে চাষীরা কাঙ্ক্ষিত ফলন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে জেলার ৩টি হাওরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাকালুকি হাওরের বোরো চাষিরা।
গতকাল দেশের সবচেয়ে বড় হাওর জেলার হাকালুকি হাওরের কুলাউড়ার উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর, ভুকশিমইল, জয়চন্ডী ও জুড়ীর জায়ফর নগর, পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে গেলে বোরো চাষিরা তাদের এই সমস্যার কথা জানান। ভূকশিমইল ইউনিয়নের বোরো চাষি শফিক মিয়া (৪৬), আজমত মিয়া (৩৮), জফিরুল মিয়া (৫৫), কালাম মিয়া (৬০), সুফিয়া বেগম (৩৬), কলসুমা বেগম (৪২), জায়ফর নগরের নজিব মিয়া (৫৬), ছমির আলী (৬০), আলফু মিয়া (৬৩) সহ অনেকেই জানান তাদের চাষকৃত বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শেষ। এখন চলছে ঝাড়া,বাছাই শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ। কিন্তু অনান্য বছরের মত এবছর ভরছেনা তাদের ধানের গোলা।
তারা জানালেন এবছর বোরো ধান চাষ ভালো হলেও ব্লাস্ট রোগের আক্রমনে ধান ছিটা হয়ে যাওয়াতে অর্ধেক ধানই চুচা (চালহীন) হয়ে যায়। তাই বিঘা প্রতি ১২-১৬ মণ ধানের জায়গায় এবছর ফলন পেয়েছেন ৭-৮ মণ। তাদের মধ্যে অনেকেরই ধান জমিতেই নষ্ট হয়েছে। কারন কোন জমিতে অত্যধিক ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণে ছিটার পরিমাণ বেশি হওয়ায় খরচের হিসাব-নিকাশে ওই ধান আর কাটতে যাননি। এতে জমিতেই নষ্ট হয়েছে ধান। চাষিরা জানালেন গেল বছরের ক্ষতি পোষাতে ও আগাম বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষায় এবছর কৃষি বিভাগের পরামর্শে দ্রুত ও আগাম ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-ধান ২৮ ও ব্রি-ধান ২৯ চাষ করেছিলেন। কিন্তু তা তাদের জন্য হিতে বিপরিত হয়েছে। বোরো মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ব্লাষ্ট ও নেক ব্লাষ্ট আক্রমন করে। ওষুধ ছিটিয়েও মিলেনি প্রতিকার।
তবে যারা হাওরের তীরবর্তী উচুঁ এলাকায় বিআর-১৪ জাতের ধান চাষ করেছেন তারা অনেকটাই লাভবান হয়েছেন। তারা বিঘা প্রতি ১৪-১৮ মণ ধান পয়েছেন। কিন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিল এলাকার কৃষক। তবে নদী ও হাওরের তীরবর্তী উঁচু এলাকায় যারা বিআর-১৪ জাতের ধান চাষ করেছেন তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন কম। এমনটি জানালেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর ছাড়াও নদী ও হাওরের তীরবর্তী উঁচু এলাকায় এখনো চলছে ধান কাটা ও মাড়াই। শ্রমিক সংকটের কারনে মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও পুরোপুরি শেষ হচ্ছেনা ধান কাটা ও মাড়াইর কাজ। কিছু কিছু এলাকায় তলিয়ে গেছে পাকা বোরো ধান।
চোখের সামনে পাকা ধান নষ্ট হলেও বজ্রপাতের ভয়ে তা তুলতে যাননি কৃষরা। গেল কয়েক দিন থেকে বৃষ্টি ও বজ্রপাত কম হওয়াতে রমজানের মধ্যেও চলে ধান কাটা ও মাড়াইর কাজ। সেই সাথে হরদম চলছে ধান ঝাড়া ও শুকানোর কাজ। জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, এবছর জেলায় ব্রি-ধান-২৮,২৯ ও বিআর-১৪ জাতের মিলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৫৪ দশমিক ১২ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলে ১৯ হাজার ৩ শত ৬৬ হেক্টর। বাকিটুকু চাষ হয়েছে নদী ও হাওরের তীরবর্তী এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে। জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ শাজাহান জানান এবছর বোরো ঘরে উঠায় কৃষকরা খুশি।
তবে হাওরের নিচু এলাকায় বোরো ধান বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে আগাম জাতের ব্রি-ধান-২৮ ও ব্রি-ধান-২৯ আবাদ করেন চাষিরা। রাতের তাপমাত্রা আপেক্ষাকৃত কমে যাওয়ায় ব্রি-ধান-২৮ এ ব্লাস্ট রোগের আক্রমন বেড়ে যায়। এতে হাওরের বিল এলাকার চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তবে অপক্ষেকৃত উঁচু এলাকায় ফলন ভালো হয়েছে। তিনি বলেন আগামী বছর ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত থেকে ফসল রক্ষায় এই ধান থেকে বীজ না রাখার পরামর্শ তার। তবে বাধ্য হয়ে বীজ রাখলে বীজ বপনের আগে তাতে ছত্রাক নাশক ওষুধ স্প্রে করে ব্লাস্টের ছত্রাক দূর করে তা রোপণের। তবে এবছর সার্বিক ভাবে জেলায় বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে বলে দাবি তার।