বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সময় চলে গেছে অনেক আগেই। ধারণা ছিল শ্রাবণের পূর্ণিমায় ধরা পড়বে নদীর ইলিশ, কিন্তু পড়েনি। শ্রাবণের ভরা জোয়ারও চলে গেছে। কিন্তু ইলিশের দেখা নেই পদ্মায়। আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়ছে না ভোলার তেঁতুলিয়া নদীতেও। তবে গত কয়েক দিন ধরে বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আর সেই ইলিশের সমারোহ ঘটেছে বরিশাল ও চাঁদপুর হয়ে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র।
গত ১৬ দিন ধরে গভীর সমুদ্র থেকে ইলিশ বোঝাই ট্রলার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আড়তগুলোতে ফিরছে। আর সেখান থেকে বাজারজাত হচ্ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতারাও খুশি। কাঙ্ক্ষিত রুপালি ইলিশ ধরা পড়ায় হাসি ফুটেছে মৎস্যজীবীদের মুখে।
দেশের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ সাগরের নোনা পানির মাছ। ডিম ছাড়ার সময় হলে ইলিশ দল বেঁধে নদীতে আসে। ডিম ছেড়ে ইলিশ আবার সাগরে ফিরে যায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলেই সেই ইলিশ জোয়ারের সঙ্গে আবার নদীর দিকে ধেয়ে আসে। আর তখনই জেলেদের জালে ধরা পড়ে লাখ লাখ ইলিশ। কিন্তু এবারের ইলিশের চিত্র ভিন্ন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ইলিশ ধরা পড়েনি। প্রত্যাশা ছিল শ্রাবণের ভরাপূর্ণিমার জোয়ারে ইলিশ নদী অববাহিকায় আসবে, তা-ও আসেনি।
বিশেষজ্ঞের অভিমত, সাগরের তুলনায় নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি। কারণ, নদীর ইলিশের গায়ে লবণাক্ততা কম থাকে। ইলিশ সবসময় উজানে চলতে পছন্দ করে। ঝাঁকে-ঝাঁকে ইলিশ যখন উজান ঠেলে সাগর থেকে নদীর দিকে ধেয়ে আসে তখন ইলিশ থেকে লবণাক্ততা কমতে থাকে। সাগরের ইলিশ নদী হয়ে যত ভেতরের দিকে আসবে ততই তার গায়ের লবণাক্ততা কমতে থাকবে। আর যত লবণাক্ততা কমবে, ততই বাড়বে ইলিশের স্বাদ। যেহেতু এবার সাগরের ইলিশ বাজারে বেশি আসছে, সে কারণে এবারকার ইলিশের স্বাদও কম। নদীর ইলিশ ধরা পড়লেই পাওয়া যাবে সেই ইলিশের কাক্সিক্ষত স্বাদ।
বিভিন্ন জেলার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, নদীর গতিপথ বদল ও নদীর মধ্যে জেগে ওঠা নতুন চর— এই তিন কারণে নদীতে প্রয়োজনীয় স্রোত নেই। তাই সাগর থেকে ইলিশ নদীমোহনায় আসতে বাধা পাচ্ছে। আর এ কারণেই প্রবল বৃষ্টি আর নদীতে স্রোত থাকার পরেও এই ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না জেলেরা। উপকূলীয় নদ-নদীতে আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। উত্তাল মেঘনা-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েও ইলিশ মাছের দেখা পাচ্ছে না জেলেরা।
জেলেরা জানান, গভীর সাগরে এখনো প্রচুর ইলিশ রয়েছে। সাগরে ইলিশ মৌসুম শুরু হওয়ার পর দেড়মাস মাছশূন্য সাগর থাকলেও এখন প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। তারা আরো বলেন, এখনো সাগরে অনেক ট্রলার আছে, যাতে প্রচুর মাছ রয়েছে। ইলিশের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত ভোলার তেঁতুলিয়া, পটুয়াখালীর পায়রা, পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা এবং চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না। তবে গত কয়েক দিন সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। পিরোজপুরের পারেরহাটের আড়তদার গোলাম ফারুক টেলিফোনে জানিয়েছেন, বরিশালের আশপাশের নদীতে কাক্সিক্ষত পরিমাণের ইলিশ ধরা না পড়লেও সাগরের তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। আর তাতেই বাজার সয়লাব।
পটুয়াখালীর মৎস্য ব্যবসায়ী সেকেন্দার আলী বলেছেন, সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে। এতে কিছুটা কমেছে ইলিশের দাম। এক সপ্তাহ আগেও যে ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হয়েছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, গত সপ্তাহে প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। তিনি বলেছেন, আরো কিছুদিন ইলিশের সরবারহ থাকবে।
এদিকে ভোলা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে চর পড়ার কারণে এখন আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না। তবে সাগরে প্রচুর মাছ আছে। আশা করা যায়, শিগগিরই জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়বে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের নদ-নদীতে ধরা মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এর অবদান এক শতাংশ। এক মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় নদীর পরিবেশ, জাটকা সংরক্ষণ ও অভয়াশ্রম নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে বছরে ইলিশের বাণিজ্য হতো কমপক্ষে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা বড় হওয়ার সুযোগ দিতে জেলেদের বছরে দুইবার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ২০১১ সালে সংশোধিত আইন অনুযায়ী, ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম আশ্বিন মাসের প্রথমে চাঁদ উদয় হওয়ার আগে তিনদিন ও চাঁদ উদয় হওয়ার পরের সাত দিন মোট ১১দিন উপকূলীয় এলাকাসহ সারাদেশে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫ দিন।
এ ছাড়া জাটকা সংরক্ষণে এবং প্রজননের সুযোগ দিয়ে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই দুই মাসও নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। এ সময়ে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। একজন জেলেকে মাসে দেওয়া হয় ৪০ কেজি চাল। দেশের ১৬টি জেলার প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবার এ খাদ্য সহায়তা পায় বলে জানায় মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র। এ ছাড়া এই দুই মাস জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়।