ঢাকা , বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুবে কমলেও বেড়েছে উত্তরে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার বাসিন্দারা পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। যমনুা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও আত্রাই নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। সবশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে পানি বেড়ে উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে বিপর্যয়।

গত বুধবার গাইবান্ধায় ট্রেনলাইন ডুবে গিয়ে সারা দেশের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়হীনতা, তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। গত চার দিনে বানের পানিতে ডুবে কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও শেরপুরে অন্তত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার সচিবালয়ে সভা শেষে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছিলেন, বন্যাদুর্গত জেলাগুলোয় ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সাড়ে ১৭ হাজার টন চাল এবং ৫০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া প্রতিটি জেলায় দু-এক দিনের মধ্যে ৫০০টি করে তাঁবু পাঠানোর সিদ্ধান্তও হয়। বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যাতে বিপর্যয় না ঘটে তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত সভায় জোনভিত্তিক সমন্বয় ও মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। বিশেষ করে বন্যাদুর্গত ১৬ জেলাকে চিহ্নিত করে বিশেষ মনিটরিং, মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের নিজ দফতরে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা হয়। তারা জানিয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু থাকবে, যেখানে বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের উজানে ভারতের বিহার ও আসাম এবং নেপালের বন্যার প্রভাব পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-বরাক নদীর উপত্যকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সেখানে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ উপমহাদেশের ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় উজানের বন্যার পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই সাগরে নামছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সপ্তাহখানেক আগে ভারত গজলডোবার তিস্তা বাঁধের সব কটি কপাট খুলে দিয়েছে। ফলে ভারত থেকে ধেয়ে আসছে বানের পানি। অবশ্য এখন পর্যন্ত বন্যায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত ও নেপাল। সপ্তাহব্যাপী বন্যায় নেপালে মারা গেছে ৭৮ জন। ভারতের আসাম ও বিহারে প্রাণ হারিয়েছে ৫৫ জন, উত্তর প্রদেশে ১৪ জন। এছাড়া বিহার রাজ্যে ২০ লাখ এবং আসামে ১০ লাখেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

এদিকে যমুনা নদীর পানি জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ও গাইবান্ধার ফুলছড়ি এবং তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিগত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। একই সঙ্গে মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি, উত্তরাঞ্চলে স্থিতিশীল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এমনকি আগামী ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতি-শুক্রবার) ঢাকার পার্শ্ববর্তী শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুধবারের (১৭ জুলাই) তথ্য অনুযায়ী, যমুনা নদীর পানির সমতল বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২১ দশমিক ১২ মিটার ও ফুলছড়ি পয়েন্টে ২১ দশমিক ২৯ মিটার এবং তিস্তা নদীর পানির সমতল ডালিয়া পয়েন্টে ৫৩ দশমিক ১২ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি নিয়ে স্বাধীনতার আগের তথ্য পূর্বাভাস কেন্দ্রে নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আগে কখনো যমুনা ও তিস্তার পানি এত বাড়েনি। এর আগে সর্বোচ্চ পানি বেড়েছিল ২০১৭ সালে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট যমুনা নদীর পানির সমতল সর্বোচ্চ বাহাদুরাবাদে ২০ দশমিক ৮৪ মিটার, ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই ফুলছড়ি পয়েন্টে ২১ দশমিক ১৩ মিটার এবং ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট তিস্তা নদীর পানি ৫৩ দশমিক ০৫ মিটার রেকর্ড করা হয়েছিল।

বিশেষ প্রতিবেদনে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধির ফলে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং বুধবার (১৭ জুলাই) ফরিদপুরের গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পানি অব্যাহত বৃদ্ধির কারণে পদ্মা নদীর পানি সমতল মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুল ও গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।

বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামীকাল শনিবার থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা নদীর পানি কমতে শুরু করার সম্ভাবনা থাকায় জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যভাগ বা শেষভাগে মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা অঞ্চলে সুরমা, কুশিয়ারা, কংশ ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলাতেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত মঙ্গলবার থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ও কাছাকাছি মেঘালয় অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় এ অঞ্চলের নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। এ অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস না থাকায় এখানকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে বলেও জানিয়েছেন বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা।

পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর পানি তিনটি, কুশিয়ারা নদীর পানি তিনটি, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি দুটি, যমুনা নদীর পানি ছয়টি, পদ্মা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এ ছাড়া পুরনো সুরমা, সোমেশ্বরী, কংস, তিতাস, মেঘনা, ধরলা, ঘাঘট, আত্রাই ও ধলেশ্বরী নদীর পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

খোলা কাগজের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গাইবান্ধার চার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৮৯ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি বিপদসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সদরের গোদার হাটে সোনাইল বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে বাড়িঘরে। রেল সূত্র জানায়, বুধবার পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধার বাদিয়াখালীতে রেললাইনে পানি উঠে গেছে। ফলে, দুপুর ১২টা থেকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগায়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে সড়কে পানি ওঠায় গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক, গাইবান্ধা-বালাসী ও কালিরবাজার সড়ক, গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শহরে পানি ওঠায় অধিকাংশ এলাকা এখন পানির নিচে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, চিলমারীর বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখন বিপদসীমার ১৩২ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পানির নিছে তলিয়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে। বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ঘর ছাড়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। তাদের বসবাস এখন আশ্রয়কেন্দ্র, ওয়াপদা বাঁধ ও কেচি সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধ-বৃহস্পতিবার) বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ৫২টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, হাজরাবাড়ী ও মেলান্দহ পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের ৭৯ হাজার ১৪০টি পরিবারের প্রায় চার লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। বন্যার পানি প্রবেশ করায় সাত উপজেলায় মোট ৪৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০৬টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৫১টি মাদ্রাসা এবং ২৩টি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ক্ষেতের ফসল। বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় ঘরের আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষ। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে পূর্বমান্দার এবং আত্রাইয়ের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

পুবে কমলেও বেড়েছে উত্তরে

আপডেট টাইম : ০৯:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার বাসিন্দারা পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। যমনুা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও আত্রাই নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। সবশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে পানি বেড়ে উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে বিপর্যয়।

গত বুধবার গাইবান্ধায় ট্রেনলাইন ডুবে গিয়ে সারা দেশের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয়হীনতা, তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। গত চার দিনে বানের পানিতে ডুবে কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও শেরপুরে অন্তত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার সচিবালয়ে সভা শেষে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছিলেন, বন্যাদুর্গত জেলাগুলোয় ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সাড়ে ১৭ হাজার টন চাল এবং ৫০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া প্রতিটি জেলায় দু-এক দিনের মধ্যে ৫০০টি করে তাঁবু পাঠানোর সিদ্ধান্তও হয়। বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যাতে বিপর্যয় না ঘটে তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত সভায় জোনভিত্তিক সমন্বয় ও মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। বিশেষ করে বন্যাদুর্গত ১৬ জেলাকে চিহ্নিত করে বিশেষ মনিটরিং, মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের নিজ দফতরে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা হয়। তারা জানিয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু থাকবে, যেখানে বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের উজানে ভারতের বিহার ও আসাম এবং নেপালের বন্যার প্রভাব পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-বরাক নদীর উপত্যকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সেখানে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ উপমহাদেশের ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় উজানের বন্যার পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই সাগরে নামছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সপ্তাহখানেক আগে ভারত গজলডোবার তিস্তা বাঁধের সব কটি কপাট খুলে দিয়েছে। ফলে ভারত থেকে ধেয়ে আসছে বানের পানি। অবশ্য এখন পর্যন্ত বন্যায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত ও নেপাল। সপ্তাহব্যাপী বন্যায় নেপালে মারা গেছে ৭৮ জন। ভারতের আসাম ও বিহারে প্রাণ হারিয়েছে ৫৫ জন, উত্তর প্রদেশে ১৪ জন। এছাড়া বিহার রাজ্যে ২০ লাখ এবং আসামে ১০ লাখেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

এদিকে যমুনা নদীর পানি জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ও গাইবান্ধার ফুলছড়ি এবং তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিগত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। একই সঙ্গে মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি, উত্তরাঞ্চলে স্থিতিশীল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এমনকি আগামী ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতি-শুক্রবার) ঢাকার পার্শ্ববর্তী শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুধবারের (১৭ জুলাই) তথ্য অনুযায়ী, যমুনা নদীর পানির সমতল বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২১ দশমিক ১২ মিটার ও ফুলছড়ি পয়েন্টে ২১ দশমিক ২৯ মিটার এবং তিস্তা নদীর পানির সমতল ডালিয়া পয়েন্টে ৫৩ দশমিক ১২ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি নিয়ে স্বাধীনতার আগের তথ্য পূর্বাভাস কেন্দ্রে নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আগে কখনো যমুনা ও তিস্তার পানি এত বাড়েনি। এর আগে সর্বোচ্চ পানি বেড়েছিল ২০১৭ সালে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট যমুনা নদীর পানির সমতল সর্বোচ্চ বাহাদুরাবাদে ২০ দশমিক ৮৪ মিটার, ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই ফুলছড়ি পয়েন্টে ২১ দশমিক ১৩ মিটার এবং ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট তিস্তা নদীর পানি ৫৩ দশমিক ০৫ মিটার রেকর্ড করা হয়েছিল।

বিশেষ প্রতিবেদনে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধির ফলে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং বুধবার (১৭ জুলাই) ফরিদপুরের গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পানি অব্যাহত বৃদ্ধির কারণে পদ্মা নদীর পানি সমতল মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুল ও গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।

বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামীকাল শনিবার থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা নদীর পানি কমতে শুরু করার সম্ভাবনা থাকায় জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যভাগ বা শেষভাগে মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা অঞ্চলে সুরমা, কুশিয়ারা, কংশ ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলাতেও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত মঙ্গলবার থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ও কাছাকাছি মেঘালয় অংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় এ অঞ্চলের নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। এ অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস না থাকায় এখানকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে বলেও জানিয়েছেন বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা।

পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর পানি তিনটি, কুশিয়ারা নদীর পানি তিনটি, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি দুটি, যমুনা নদীর পানি ছয়টি, পদ্মা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এ ছাড়া পুরনো সুরমা, সোমেশ্বরী, কংস, তিতাস, মেঘনা, ধরলা, ঘাঘট, আত্রাই ও ধলেশ্বরী নদীর পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

খোলা কাগজের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গাইবান্ধার চার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৮৯ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি বিপদসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সদরের গোদার হাটে সোনাইল বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে বাড়িঘরে। রেল সূত্র জানায়, বুধবার পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধার বাদিয়াখালীতে রেললাইনে পানি উঠে গেছে। ফলে, দুপুর ১২টা থেকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগায়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে সড়কে পানি ওঠায় গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক, গাইবান্ধা-বালাসী ও কালিরবাজার সড়ক, গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শহরে পানি ওঠায় অধিকাংশ এলাকা এখন পানির নিচে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, চিলমারীর বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখন বিপদসীমার ১৩২ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পানির নিছে তলিয়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে। বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ঘর ছাড়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। তাদের বসবাস এখন আশ্রয়কেন্দ্র, ওয়াপদা বাঁধ ও কেচি সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধ-বৃহস্পতিবার) বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ৫২টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, হাজরাবাড়ী ও মেলান্দহ পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের ৭৯ হাজার ১৪০টি পরিবারের প্রায় চার লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। বন্যার পানি প্রবেশ করায় সাত উপজেলায় মোট ৪৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০৬টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৫১টি মাদ্রাসা এবং ২৩টি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর মান্দায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ক্ষেতের ফসল। বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় ঘরের আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষ। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে পূর্বমান্দার এবং আত্রাইয়ের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।