ঢাকা , রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

শেখ হাসিনা ডকট্রিন এবং জন কেরির ফোন

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ইস্যু নিয়ে মার্কিন মুল্লুকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্য দিকে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাদাম ব্লুম বার্নিকার্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে বেশ আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যাকাণ্ড বিশেষ করে, ঢাকার কলাবাগানে বসবাসরত সমকামী যুবকদ্বয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। জন কেরি তার ফোনালাপে বাংলাদেশে সংঘটিত সমকামী হত্যা, ব্লগার হত্যা, ভিন্নমতের উগ্রবাদের বিস্তৃতি এবং আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। মাদাম ব্লুমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন তা পত্রপত্রিকায় এলেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে অনেকের সন্দেহ হলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ যাত্রায় হয়তো শেখ হাসিনা ডকট্রিনের মুখোমুখি হননি, যা কিনা আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে এবং আশঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে ‘শেখ হাসিনা ডকট্রিন’ সম্পর্কে কিছু বলে নেই-

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব কিছুর মধ্যেই একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির অন্য সব মানুষের মতো তিনি নন। মুখের ওপর উচিত কথা বলে দেয়া এবং অপ্রিয় সত্য কথা জোর গলায় সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তিনি মাঝামাঝি কিছু বলেন না, মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন না এবং ভীতিকর পরিবেশে চুপ থেকে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করেন না। আকার-ইঙ্গিতে কথা বলা, চোখ টিপে মোনাফেকি করা অথবা কথা দিয়ে কথা না রাখার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কেউ করেননি। তিনি কাউকে ভালোবাসলে অবশ্যই প্রবলভাবে বাসেন, আবার ঘৃণা করলে তা-ও প্রকাশ করেন সুতীব্রভাবে। তিনি উপকারীর উপকার স্বীকার করেন এবং সম্ভব হলে প্রতিদানের চেষ্টা করেন। একইভাবে তিনি শত্রুর প্রতি অতীব কঠোর মানসিকতা পোষণ করেন। তিনি ‘প্রতিশোধ’ গ্রহণ করতে পছন্দ করেন এবং এ ব্যাপারে কারো সুপারিশ বা অনুরোধে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টান না। সরাসরি রাজনীতিতে আসার পর আওয়ামী লীগ নেত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা একটি নিজস্ব ভাবমর্যাদা গড়ে তুলেছেন যাকে অনেকে ‘হাসিনা ডকট্রিন’ বলে অভিহিত করে।

 

এ ডকট্রিনের মার্কিন নীতি হলো- দেশটির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, দাদাগিরি এবং অন্য দেশের ব্যাপারে অযাচিত নাক গলানো একদম পাত্তা না দেয়া। গত সাত আট বছরে তিনি এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে করেছেন। হিলারি ক্লিনটনের ফোন না ধরা, জন কেরির সাথে কথা না বলা, বাংলাদেশে সফররত মার্কিন মন্ত্রীদেরকে সাক্ষাৎকার না দেয়া, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার কার্যকালে তাকে কোনো সাক্ষাৎ তো দূরের কথা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয় ও বাসভবনে ঢুকতে না দেয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং ইচ্ছাশক্তিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, ঠিক সেই সময়কালে ছুটি কাটানোর জন্য বহুবার তিনি মার্কিন মুল্লুকে গিয়েছিলেন; কিন্তু গত সাতটি বছর তিনি শুধু জাতিসঙ্ঘের অনুষ্ঠান ছাড়া সে দেশে পা মাড়াননি। তিনি শুধু মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি নয়- তাদের মদদপুষ্ট বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসঙ্ঘকেও গত সাত বছরে এমন সব ‘শিক্ষা’ দিয়েছেন যা বিগত দিনে কোনো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক তো দূরের কথা, উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালী কোনো রাষ্ট্রনায়কও পারেননি।

 

ডকট্রিনের মধ্যেই তার সফলতা ও ব্যর্থতা নিহিত। অর্থাৎ তাকে যদি কেউ সফল বলেন তবে অবশ্যই তার ডকট্রিনকে বেইজ লাইন ধরতে হবে। অন্য দিকে যদি ব্যর্থ বলেন- তা-ও একই কারণে হয়েছে বা অনাগত দিনে হবে। মাঝে মধ্যে ভেবেছি, কেন শেখ হাসিনা বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর, প্রতিশোধপরায়ণ, স্বার্থপর ও অহঙ্কারী একটি জাতির সাথে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে জড়ালেন। পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে বহু রাষ্ট্র আমেরিকার চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য কিংবা সভ্যতা গঠন করেছিল। ফেরাউনদের মিসরীয় সাম্রাজ্য, সাইরাস প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্য, জুলিয়াস সিজার প্রতিষ্ঠিত রোমান সাম্রাজ্য, বাগদাদ, মিসর, কনস্টান্টিনোপল, সমরখন্দ, বোখারা, ভারতবর্ষ, স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের সাম্রাজ্য- হাজার হাজার বছর ধরে একচ্ছত্রভাবে পৃথিবী শাসন করেছে। ওইসব সাম্রাজ্যের বহু শাসক আজো পৃথিবীবাসীর আত্মার সিংহাসনে রাজা হয়ে বসে আছেন। সে দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম এক শ’ বছরে তারা বেশ কয়েকজন মহান প্রেসিডেন্ট পেয়েছিলেন; কিন্তু জাতিগত দাঙ্গা, পারস্পরিক হানাহানি এবং অপরাধপ্রবণ জনগণের কারণে তাদের বহু জনপদ, রাজধানী এবং শহর-বন্দর পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টকে তারা হত্যা করেছে। তারপরও ইতিহাসের আমোঘ নিয়মে তাদের বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে বটে কিন্তু নৈতিক মানদণ্ড দিনকে দিন তলানিতে চলে গেছে।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর সুপার পাওয়ার হতে পেরেছে মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর। গত ২৫ বছরে রাষ্ট্রটি তার একক সুপার পাওয়ার ব্যবহার করে পৃথিবীর কোনো উন্নয়ন তো দূরের কথা, যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা মানবজাতির ইতিহাসে সর্বাধিক কলঙ্ক হয়ে থাকবে। সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে সৃষ্টি, আবার তাদের হত্যা করার মাধ্যমে ইরাক ও লিবিয়া নামক দেশ দু’টির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধ, আফগানিস্তানের যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ছাড়াও আফ্রিকার অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ এবং ফিলিস্তিন সমস্যার মাধ্যমে মার্কিনিরা তামাম দুনিয়াকে অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে ছেড়েছে। তারা ল্যাটিন আমেরিকায় কন্ট্রা বিদ্রোহী, ভারতে মাওবাদী, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস, আলকায়েদা সৃষ্টিসহ রাশিয়া ও তুরস্ককে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা করেনি বা করছে না।

 

মার্কিনিরা সব সময়ই শক্তের ভক্ত- নরমের যম। তারা উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন, ভেনিজুয়েলা, কিউবা ও ভারতকে ভয় পায়। তারা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ইরানের আহমাদিনেজাদকেও অন্যভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। গত ২৫ বছরে তারা প্রতিটি যুদ্ধে শোচনীয় ও অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়েছে। তারা তাদের সাহায্যকারীর সর্বনাশ না করে ছাড়েনি। অন্য দিকে বিপদে পড়লে শত্রুর পদচুম্বন করতেও দ্বিধা করেনি। তারা আলকায়েদা ও তালেবানদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছে পাকিস্তানে তাদের দোসর জেনারেল মোশাররফের সাহায্যে। আবার অজানা কারণে সবাইকে ধ্বংস করেছে অবলীলায়। তারা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একসময় ভিসা দেয়নি- আবার নিজেদের প্রয়োজনেই মোদির পেছনে এমনভাবে ছুটছে যা রীতিমতো অপমানকর। তারা ৫০ বছর ধরে কিউবা এবং ইরানের পেছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে রাষ্ট্র দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য। আবার সাম্প্রতিক সময়ে তারাই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কিউবা ও ইরানের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য।

 

অতিসম্প্রতি বিশ্ববাসী মার্কিন জাতির দুটো উল্লেখযোগ্য অপমান অবলোকন করার সুযোগ পেয়েছে। কিউবা ভ্রমণকালে প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে কিংবদন্তিতুল্য ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন দেখা করেননি, তেমনি জাতিসঙ্ঘের সম্মেলনের সময়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন- ‘আমি সার্কাস পছন্দ করি না। আমাদের মধ্যে ৪৫ বছর ধরে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো সমাধানের চেষ্টা না করে প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে হঠাৎ বৈঠক সার্কাস বৈ অন্য কিছু হবে না। হুগো শ্যাভেজ, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং চীনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মার্কিন প্রশাসন সব সময় তটস্থ থেকে শেষমেশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। অন্য দিকে সাদ্দাম, গাদ্দাফি, আলেন্দে, নরিয়েগা প্রমুখ নেতা তলে তলে যিনিই মার্কিনিদের সাথে আপস করার চেষ্টা করেছেন, অমনি মার্কিনি মারণফাঁদ তাদের পাকড়াও করেছে।

 

হাসিনা ডকট্রিন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যদি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতীতের মতো আচরণ করেন তবে নিঃসন্দেহে তিনি ভালো ফল পাবেন। কোনো মার্কিন এজেন্ট, খয়ের খাঁ বা দালালের পাল্লায় পড়ে তিনি যদি গলার স্বর নরম করেন তাহলেই মার্কিনিরা তাকে পেয়ে বসবে এবং তার পতন না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। শুরু থেকেই মার্কিনিরা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে মেনে নেয়নি। তারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি এবং বঙ্গবন্ধুকে মুদ্রণ অযোগ্য মন্দ ভাষায় সম্বোধন করত। ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিটকারি করে বলতে আরম্ভ করলেন যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই সময়টাতে তারা মারাত্মক দু’টি সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলে। প্রথমত, চাল দেয়ার কথা বলে চাল না দিয়ে দুর্ভিক্ষকে প্রলম্বিত করে। দ্বিতীয়ত, তাদের পশ্চিমা মিত্রদের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে রিলিফ প্রদান করে তাদের মনোনীত এজেন্টদের মাধ্যমে। এসব এজেন্ট কালোবাজারে এমনভাবে সুকৌশলে রিলিফ বিক্রি করতে থাকে যার ফলে নিজেরা রাতারাতি টাকার কুমির বনে যায়- অন্য দিকে রিলিফ চুরির দায় গিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর। মার্কিনিদের সেই এজেন্টদের একজন এখনো রীতিমতো কিংবদন্তি স্যারে রূপান্তর হয়ে গেছেন।

 

ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্নমত পোষণ করি। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির একতরফা সংসদ নির্বাচন, প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন এবং সীমিত গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কোচনকে সমর্থন করি না; কিন্তু তার একরোখা উন্নয়ন নীতি, মার্কিন সংক্রান্ত সাহসী নীতি এবং পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংককে জনমের মতো শিক্ষা দেয়ার ঘটনা আমাদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। কাজেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে জন কেরির ফোনালাপ অনেকের ভালো লাগেনি। মাদাম ব্লুম যদি তাদের দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো উপসচিব বা যুগ্ম সচিবের সাথে বৈঠক করতেন তাহলে কোনো আপত্তি থাকত না। অন্য দিকে, এ দেশের তেল, গ্যাস, ব্যাংকিং সেক্টর, তামাকপণ্য এবং অন্যান্য সেক্টরে কর্মরত শত শত মার্কিন কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যদি জন কেরি আমাদের শাহরিয়ার আলমের সাথে কথা বলতেন তাহলেও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না।

 

কেরির সাথে ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন তা আমি জানি না। তবে নিজের ডকট্রিনের বৈশিষ্ট্য মোতাবেক তিনি বলতে পারতেন- ‘মি. কেরি! আপনি আমাকে কেন ফোন করেছেন। প্রটোকল অনুযায়ী আপনি তো আমাকে ফোন করতে পারেন না। কোনো জরুরি বিষয় থাকলে প্রেসিডেন্ট ওবামার ফোনই আমার কাম্য। তার পরও যেহেতু ফোন করে বসেছেন, সেহেতু কিছু কথা বলে নিই। কয়েক দিন আগে এক বাঙালি দম্পতি আপনার দেশে খুন হলো। নিউ ইয়র্ক, ফ্লোরিডা, মিশিগান প্রভৃতি বাঙালিপ্রধান এলাকায় নিরীহ বাঙালিরা কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয় জাতের উগ্র আমেরিকানদের দ্বারা হররোজ আক্রমণের শিকার হচ্ছে। পুলিশের কাছে এন্তার অভিযোগ করার পরও কোনো সুফল মেলেনি।’

 

“মি. কেরি! আপনারা আপনাদের ব্যাংকব্যবস্থার সংস্কার করুন। আইনে পরিবর্তন আনুন। বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য লোকজন নিজ নিজ দেশের টাকা গোপনে পাচার করে আপনার দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা করছে। এসব টাকার ওপর আপনার সরকার কোনো আয়কর আরোপ করে না; বরং উচ্চ হারে সুদ দেয়। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের মেহনতি মানুষের রক্ত পানি করা অর্থের একটি বিরাট অংশই লুটেরাদের মাধ্যমে আপনারা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী লুটেরাদের জন্য আপনারা নিজেদের দেশকে ‘স্বর্গরাজ্য’ বানিয়ে ফেলেছেন। আপনাদের দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনীতির ছন্দপতন এবং আপনাদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে আমরা যারপরনাই ত্যক্তবিরক্ত। আপনাদের সৃষ্টি করা আলকায়েদা, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, কুর্দিশ আর্মি, নুসরা ফ্রন্ট, দায়েশ বা আইএস, মাহদি আর্মি, জয়েশ-ই-মোহাম্মদ, তালেবানসহ বিভিন্ন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে পৃথিবীর মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে আপনাদের সৃষ্ট অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ মাঝে মধ্যে বাংলাদেশকে অশান্ত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। আমাদের সন্দেহ- এসব কাজে আপনাদের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে। সময় থাকতে এসব বন্ধ করুন। নতুবা এ দেশে ব্যবসারত মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর হতে এবং চীনের মতো আপনাদের দেশে বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসাতে বাধ্য হবো।”

 

‘মি. কেরি! বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য আপনারাই দায়ী। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আপনাদের মদদে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আপনারাই তাদের বিভ্রান্ত করেছেন এবং বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সময়মতো সটকে পড়েছেন। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, বাংলাদেশের সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার এবং সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করুন। আপনারা ধনী হয়েছেন বড়জোর পঞ্চাশ বছর- আর আমরা ছিলাম পৃথিবীর এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। আমাদের পাহাড়পুর বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সরকারি খরচে হাজার হাজার দেশী-বিদেশী ছাত্র অধ্যয়ন করতো তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে সভ্যতার আলো পর্যন্ত পৌঁছেনি। আজ যারা বিশ্বমাধ্যমে বড় বড় কথা বলেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা বংশানুক্রমে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত আমাদের দেশে আসত কামলা খাটার জন্য। কেউবা আসত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। কিন্তু বেশির ভাগই আসত চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি আর লুটতরাজ করার জন্য। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেবল চায়ের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ার হয়নি। আমাদের বিক্ষুব্ধ জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা বেতনভাতা না পাওয়ার কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজধানী পুড়িয়ে ছারখার করে দেননি। প্রেসিডেন্ট এবং এমপিদের সংসদ ভবনে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেননি। আমরা আবু গারিব কারাগার, গুয়ান্তানামো কারাগার ইত্যাদি বানিয়ে মানবতার গান গাই না। আমরা ভারতীয় কূটনীতিবিদ দেবযানীর মতো কোনো মহিলা বা পুরুষ কূটনীতিবিদকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করিনি এবং তার স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর মধ্যে ড্রাগ খুঁজিনি এবং থানাহাজতে বেশ্যাদের সাথে রাত্রি যাপনে কাউকে বাধ্য করিনি। আমরা পৃথিবীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী এবং ভারতের মতো বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতিকে বিমানবন্দরে আটক করে দেবযানীর মতো হয়রানি করিনি।’

 

‘মি. কেরি! আমাদেরকেও সম্মান করতে শিখুন। আমাদের আবেগ-অনুভূতি, ভালো লাগা এবং পছন্দ-অপছন্দের দিকে খেয়াল রাখুন। আপনারা আমাদের কাছে এমন কাউকে প্রেরণ করবেন না, যার ব্যক্তিত্ব ও আচরণ আমাদের কাছে ষোলআনার পরিবর্তে দু’আনা বলে মনে হবে। আপনারা এমন কাউকে পাঠাবেন না যাদের দেশবাসী বিউটি বেগম, কালা জাহাঙ্গীর এবং কাজের মেয়ে মর্জিনা বলে টিটকারি করার সুযোগ পায়। বাঙালি কৃতজ্ঞ ও ভদ্র জাতি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনারা প্রবল বিরোধিতা করেছেন তারপরও ওই সময়ে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন দূত (কনসাল জেনারেল) আর্চার ব্লাডকে তো আমরা পরম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি তার ন্যায়পরায়ণতা, সত্য নিষ্ঠা এবং সাহসী চরিত্রের কারণে।’
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

রাজধানীর ১৫টি খাল খননে দূর হবে ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতা

শেখ হাসিনা ডকট্রিন এবং জন কেরির ফোন

আপডেট টাইম : ০৬:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ মে ২০১৬
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ইস্যু নিয়ে মার্কিন মুল্লুকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্য দিকে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাদাম ব্লুম বার্নিকার্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে বেশ আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যাকাণ্ড বিশেষ করে, ঢাকার কলাবাগানে বসবাসরত সমকামী যুবকদ্বয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। জন কেরি তার ফোনালাপে বাংলাদেশে সংঘটিত সমকামী হত্যা, ব্লগার হত্যা, ভিন্নমতের উগ্রবাদের বিস্তৃতি এবং আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। মাদাম ব্লুমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন তা পত্রপত্রিকায় এলেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে অনেকের সন্দেহ হলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ যাত্রায় হয়তো শেখ হাসিনা ডকট্রিনের মুখোমুখি হননি, যা কিনা আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে এবং আশঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে ‘শেখ হাসিনা ডকট্রিন’ সম্পর্কে কিছু বলে নেই-

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব কিছুর মধ্যেই একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির অন্য সব মানুষের মতো তিনি নন। মুখের ওপর উচিত কথা বলে দেয়া এবং অপ্রিয় সত্য কথা জোর গলায় সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নেই। তিনি মাঝামাঝি কিছু বলেন না, মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন না এবং ভীতিকর পরিবেশে চুপ থেকে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করেন না। আকার-ইঙ্গিতে কথা বলা, চোখ টিপে মোনাফেকি করা অথবা কথা দিয়ে কথা না রাখার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কেউ করেননি। তিনি কাউকে ভালোবাসলে অবশ্যই প্রবলভাবে বাসেন, আবার ঘৃণা করলে তা-ও প্রকাশ করেন সুতীব্রভাবে। তিনি উপকারীর উপকার স্বীকার করেন এবং সম্ভব হলে প্রতিদানের চেষ্টা করেন। একইভাবে তিনি শত্রুর প্রতি অতীব কঠোর মানসিকতা পোষণ করেন। তিনি ‘প্রতিশোধ’ গ্রহণ করতে পছন্দ করেন এবং এ ব্যাপারে কারো সুপারিশ বা অনুরোধে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টান না। সরাসরি রাজনীতিতে আসার পর আওয়ামী লীগ নেত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা একটি নিজস্ব ভাবমর্যাদা গড়ে তুলেছেন যাকে অনেকে ‘হাসিনা ডকট্রিন’ বলে অভিহিত করে।

 

এ ডকট্রিনের মার্কিন নীতি হলো- দেশটির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, দাদাগিরি এবং অন্য দেশের ব্যাপারে অযাচিত নাক গলানো একদম পাত্তা না দেয়া। গত সাত আট বছরে তিনি এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে করেছেন। হিলারি ক্লিনটনের ফোন না ধরা, জন কেরির সাথে কথা না বলা, বাংলাদেশে সফররত মার্কিন মন্ত্রীদেরকে সাক্ষাৎকার না দেয়া, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার কার্যকালে তাকে কোনো সাক্ষাৎ তো দূরের কথা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কার্যালয় ও বাসভবনে ঢুকতে না দেয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং ইচ্ছাশক্তিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, ঠিক সেই সময়কালে ছুটি কাটানোর জন্য বহুবার তিনি মার্কিন মুল্লুকে গিয়েছিলেন; কিন্তু গত সাতটি বছর তিনি শুধু জাতিসঙ্ঘের অনুষ্ঠান ছাড়া সে দেশে পা মাড়াননি। তিনি শুধু মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি নয়- তাদের মদদপুষ্ট বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসঙ্ঘকেও গত সাত বছরে এমন সব ‘শিক্ষা’ দিয়েছেন যা বিগত দিনে কোনো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক তো দূরের কথা, উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালী কোনো রাষ্ট্রনায়কও পারেননি।

 

ডকট্রিনের মধ্যেই তার সফলতা ও ব্যর্থতা নিহিত। অর্থাৎ তাকে যদি কেউ সফল বলেন তবে অবশ্যই তার ডকট্রিনকে বেইজ লাইন ধরতে হবে। অন্য দিকে যদি ব্যর্থ বলেন- তা-ও একই কারণে হয়েছে বা অনাগত দিনে হবে। মাঝে মধ্যে ভেবেছি, কেন শেখ হাসিনা বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর, প্রতিশোধপরায়ণ, স্বার্থপর ও অহঙ্কারী একটি জাতির সাথে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে জড়ালেন। পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে বহু রাষ্ট্র আমেরিকার চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য কিংবা সভ্যতা গঠন করেছিল। ফেরাউনদের মিসরীয় সাম্রাজ্য, সাইরাস প্রতিষ্ঠিত পারস্য সাম্রাজ্য, জুলিয়াস সিজার প্রতিষ্ঠিত রোমান সাম্রাজ্য, বাগদাদ, মিসর, কনস্টান্টিনোপল, সমরখন্দ, বোখারা, ভারতবর্ষ, স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের সাম্রাজ্য- হাজার হাজার বছর ধরে একচ্ছত্রভাবে পৃথিবী শাসন করেছে। ওইসব সাম্রাজ্যের বহু শাসক আজো পৃথিবীবাসীর আত্মার সিংহাসনে রাজা হয়ে বসে আছেন। সে দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম এক শ’ বছরে তারা বেশ কয়েকজন মহান প্রেসিডেন্ট পেয়েছিলেন; কিন্তু জাতিগত দাঙ্গা, পারস্পরিক হানাহানি এবং অপরাধপ্রবণ জনগণের কারণে তাদের বহু জনপদ, রাজধানী এবং শহর-বন্দর পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টকে তারা হত্যা করেছে। তারপরও ইতিহাসের আমোঘ নিয়মে তাদের বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে বটে কিন্তু নৈতিক মানদণ্ড দিনকে দিন তলানিতে চলে গেছে।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর সুপার পাওয়ার হতে পেরেছে মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর। গত ২৫ বছরে রাষ্ট্রটি তার একক সুপার পাওয়ার ব্যবহার করে পৃথিবীর কোনো উন্নয়ন তো দূরের কথা, যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা মানবজাতির ইতিহাসে সর্বাধিক কলঙ্ক হয়ে থাকবে। সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে সৃষ্টি, আবার তাদের হত্যা করার মাধ্যমে ইরাক ও লিবিয়া নামক দেশ দু’টির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধ, আফগানিস্তানের যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ছাড়াও আফ্রিকার অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ এবং ফিলিস্তিন সমস্যার মাধ্যমে মার্কিনিরা তামাম দুনিয়াকে অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে ছেড়েছে। তারা ল্যাটিন আমেরিকায় কন্ট্রা বিদ্রোহী, ভারতে মাওবাদী, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস, আলকায়েদা সৃষ্টিসহ রাশিয়া ও তুরস্ককে অস্থিতিশীল করার হেন চেষ্টা নেই যা করেনি বা করছে না।

 

মার্কিনিরা সব সময়ই শক্তের ভক্ত- নরমের যম। তারা উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন, ভেনিজুয়েলা, কিউবা ও ভারতকে ভয় পায়। তারা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ইরানের আহমাদিনেজাদকেও অন্যভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। গত ২৫ বছরে তারা প্রতিটি যুদ্ধে শোচনীয় ও অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়েছে। তারা তাদের সাহায্যকারীর সর্বনাশ না করে ছাড়েনি। অন্য দিকে বিপদে পড়লে শত্রুর পদচুম্বন করতেও দ্বিধা করেনি। তারা আলকায়েদা ও তালেবানদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছে পাকিস্তানে তাদের দোসর জেনারেল মোশাররফের সাহায্যে। আবার অজানা কারণে সবাইকে ধ্বংস করেছে অবলীলায়। তারা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একসময় ভিসা দেয়নি- আবার নিজেদের প্রয়োজনেই মোদির পেছনে এমনভাবে ছুটছে যা রীতিমতো অপমানকর। তারা ৫০ বছর ধরে কিউবা এবং ইরানের পেছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে রাষ্ট্র দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য। আবার সাম্প্রতিক সময়ে তারাই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কিউবা ও ইরানের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য।

 

অতিসম্প্রতি বিশ্ববাসী মার্কিন জাতির দুটো উল্লেখযোগ্য অপমান অবলোকন করার সুযোগ পেয়েছে। কিউবা ভ্রমণকালে প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে কিংবদন্তিতুল্য ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন দেখা করেননি, তেমনি জাতিসঙ্ঘের সম্মেলনের সময়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন- ‘আমি সার্কাস পছন্দ করি না। আমাদের মধ্যে ৪৫ বছর ধরে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো সমাধানের চেষ্টা না করে প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে হঠাৎ বৈঠক সার্কাস বৈ অন্য কিছু হবে না। হুগো শ্যাভেজ, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং চীনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মার্কিন প্রশাসন সব সময় তটস্থ থেকে শেষমেশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। অন্য দিকে সাদ্দাম, গাদ্দাফি, আলেন্দে, নরিয়েগা প্রমুখ নেতা তলে তলে যিনিই মার্কিনিদের সাথে আপস করার চেষ্টা করেছেন, অমনি মার্কিনি মারণফাঁদ তাদের পাকড়াও করেছে।

 

হাসিনা ডকট্রিন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যদি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতীতের মতো আচরণ করেন তবে নিঃসন্দেহে তিনি ভালো ফল পাবেন। কোনো মার্কিন এজেন্ট, খয়ের খাঁ বা দালালের পাল্লায় পড়ে তিনি যদি গলার স্বর নরম করেন তাহলেই মার্কিনিরা তাকে পেয়ে বসবে এবং তার পতন না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। শুরু থেকেই মার্কিনিরা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে মেনে নেয়নি। তারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি এবং বঙ্গবন্ধুকে মুদ্রণ অযোগ্য মন্দ ভাষায় সম্বোধন করত। ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিটকারি করে বলতে আরম্ভ করলেন যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই সময়টাতে তারা মারাত্মক দু’টি সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলে। প্রথমত, চাল দেয়ার কথা বলে চাল না দিয়ে দুর্ভিক্ষকে প্রলম্বিত করে। দ্বিতীয়ত, তাদের পশ্চিমা মিত্রদের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে রিলিফ প্রদান করে তাদের মনোনীত এজেন্টদের মাধ্যমে। এসব এজেন্ট কালোবাজারে এমনভাবে সুকৌশলে রিলিফ বিক্রি করতে থাকে যার ফলে নিজেরা রাতারাতি টাকার কুমির বনে যায়- অন্য দিকে রিলিফ চুরির দায় গিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর। মার্কিনিদের সেই এজেন্টদের একজন এখনো রীতিমতো কিংবদন্তি স্যারে রূপান্তর হয়ে গেছেন।

 

ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্নমত পোষণ করি। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির একতরফা সংসদ নির্বাচন, প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন এবং সীমিত গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কোচনকে সমর্থন করি না; কিন্তু তার একরোখা উন্নয়ন নীতি, মার্কিন সংক্রান্ত সাহসী নীতি এবং পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংককে জনমের মতো শিক্ষা দেয়ার ঘটনা আমাদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। কাজেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে জন কেরির ফোনালাপ অনেকের ভালো লাগেনি। মাদাম ব্লুম যদি তাদের দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো উপসচিব বা যুগ্ম সচিবের সাথে বৈঠক করতেন তাহলে কোনো আপত্তি থাকত না। অন্য দিকে, এ দেশের তেল, গ্যাস, ব্যাংকিং সেক্টর, তামাকপণ্য এবং অন্যান্য সেক্টরে কর্মরত শত শত মার্কিন কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যদি জন কেরি আমাদের শাহরিয়ার আলমের সাথে কথা বলতেন তাহলেও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না।

 

কেরির সাথে ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন তা আমি জানি না। তবে নিজের ডকট্রিনের বৈশিষ্ট্য মোতাবেক তিনি বলতে পারতেন- ‘মি. কেরি! আপনি আমাকে কেন ফোন করেছেন। প্রটোকল অনুযায়ী আপনি তো আমাকে ফোন করতে পারেন না। কোনো জরুরি বিষয় থাকলে প্রেসিডেন্ট ওবামার ফোনই আমার কাম্য। তার পরও যেহেতু ফোন করে বসেছেন, সেহেতু কিছু কথা বলে নিই। কয়েক দিন আগে এক বাঙালি দম্পতি আপনার দেশে খুন হলো। নিউ ইয়র্ক, ফ্লোরিডা, মিশিগান প্রভৃতি বাঙালিপ্রধান এলাকায় নিরীহ বাঙালিরা কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয় জাতের উগ্র আমেরিকানদের দ্বারা হররোজ আক্রমণের শিকার হচ্ছে। পুলিশের কাছে এন্তার অভিযোগ করার পরও কোনো সুফল মেলেনি।’

 

“মি. কেরি! আপনারা আপনাদের ব্যাংকব্যবস্থার সংস্কার করুন। আইনে পরিবর্তন আনুন। বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য লোকজন নিজ নিজ দেশের টাকা গোপনে পাচার করে আপনার দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা করছে। এসব টাকার ওপর আপনার সরকার কোনো আয়কর আরোপ করে না; বরং উচ্চ হারে সুদ দেয়। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের মেহনতি মানুষের রক্ত পানি করা অর্থের একটি বিরাট অংশই লুটেরাদের মাধ্যমে আপনারা নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী লুটেরাদের জন্য আপনারা নিজেদের দেশকে ‘স্বর্গরাজ্য’ বানিয়ে ফেলেছেন। আপনাদের দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনীতির ছন্দপতন এবং আপনাদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে আমরা যারপরনাই ত্যক্তবিরক্ত। আপনাদের সৃষ্টি করা আলকায়েদা, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, কুর্দিশ আর্মি, নুসরা ফ্রন্ট, দায়েশ বা আইএস, মাহদি আর্মি, জয়েশ-ই-মোহাম্মদ, তালেবানসহ বিভিন্ন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে পৃথিবীর মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে আপনাদের সৃষ্ট অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ মাঝে মধ্যে বাংলাদেশকে অশান্ত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। আমাদের সন্দেহ- এসব কাজে আপনাদের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে। সময় থাকতে এসব বন্ধ করুন। নতুবা এ দেশে ব্যবসারত মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর হতে এবং চীনের মতো আপনাদের দেশে বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসাতে বাধ্য হবো।”

 

‘মি. কেরি! বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য আপনারাই দায়ী। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আপনাদের মদদে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আপনারাই তাদের বিভ্রান্ত করেছেন এবং বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সময়মতো সটকে পড়েছেন। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, বাংলাদেশের সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার এবং সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করুন। আপনারা ধনী হয়েছেন বড়জোর পঞ্চাশ বছর- আর আমরা ছিলাম পৃথিবীর এক নম্বর ধনী রাষ্ট্র প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। আমাদের পাহাড়পুর বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সরকারি খরচে হাজার হাজার দেশী-বিদেশী ছাত্র অধ্যয়ন করতো তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে সভ্যতার আলো পর্যন্ত পৌঁছেনি। আজ যারা বিশ্বমাধ্যমে বড় বড় কথা বলেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা বংশানুক্রমে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত আমাদের দেশে আসত কামলা খাটার জন্য। কেউবা আসত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। কিন্তু বেশির ভাগই আসত চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি আর লুটতরাজ করার জন্য। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেবল চায়ের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ার হয়নি। আমাদের বিক্ষুব্ধ জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা বেতনভাতা না পাওয়ার কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজধানী পুড়িয়ে ছারখার করে দেননি। প্রেসিডেন্ট এবং এমপিদের সংসদ ভবনে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেননি। আমরা আবু গারিব কারাগার, গুয়ান্তানামো কারাগার ইত্যাদি বানিয়ে মানবতার গান গাই না। আমরা ভারতীয় কূটনীতিবিদ দেবযানীর মতো কোনো মহিলা বা পুরুষ কূটনীতিবিদকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করিনি এবং তার স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর মধ্যে ড্রাগ খুঁজিনি এবং থানাহাজতে বেশ্যাদের সাথে রাত্রি যাপনে কাউকে বাধ্য করিনি। আমরা পৃথিবীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী এবং ভারতের মতো বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতিকে বিমানবন্দরে আটক করে দেবযানীর মতো হয়রানি করিনি।’

 

‘মি. কেরি! আমাদেরকেও সম্মান করতে শিখুন। আমাদের আবেগ-অনুভূতি, ভালো লাগা এবং পছন্দ-অপছন্দের দিকে খেয়াল রাখুন। আপনারা আমাদের কাছে এমন কাউকে প্রেরণ করবেন না, যার ব্যক্তিত্ব ও আচরণ আমাদের কাছে ষোলআনার পরিবর্তে দু’আনা বলে মনে হবে। আপনারা এমন কাউকে পাঠাবেন না যাদের দেশবাসী বিউটি বেগম, কালা জাহাঙ্গীর এবং কাজের মেয়ে মর্জিনা বলে টিটকারি করার সুযোগ পায়। বাঙালি কৃতজ্ঞ ও ভদ্র জাতি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনারা প্রবল বিরোধিতা করেছেন তারপরও ওই সময়ে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন দূত (কনসাল জেনারেল) আর্চার ব্লাডকে তো আমরা পরম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি তার ন্যায়পরায়ণতা, সত্য নিষ্ঠা এবং সাহসী চরিত্রের কারণে।’