ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১০ জেলায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ

দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ- এই ১০ জেলা বন্যাকবলিত। বন্যার পানি প্রবেশ করায় এসব জেলার এক হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার (৬ জুলাই) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

এর মধ্যে শুধু সুনামগঞ্জেই ৫৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বন্যার কারণে হাজারো মানুষ পানিবন্দি। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল। কিছু এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি সার্বিকভাবে কমছে, যা আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

তবে উত্তর, উত্তর-মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে আজ। আজ সকাল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শুক্রবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। আগামী দুই দিন ঝুঁকি বেশি থাকবে মূলত উত্তরের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার এবং উত্তর-পশ্চিমের ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে। এসব অঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের ৫৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত ৩ জুলাই থেকে বিদ্যালয়ে গেলেও এসব বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী আসেনি।

একই কারণে গত সোমবার মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক ১০১টি বিদ্যালয়ে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস জানান, গত ১৬ থেকে ২০ জুনের প্রথম দফা বন্যায় জেলার এক হাজার ৪৭৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করে। পানি ওঠেনি এমন ২৫৮টি বিদ্যালয়ে বন্যার্তরা আশ্রয় নেয়। দ্বিতীয় দফা ৩০ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বন্যায়ও জেলার ২৩৮টি বিদ্যালয় প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি ওঠেনি এমন ৫৯টি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে এখনো বন্যাকবলিত লোকজন সপরিবারে অবস্থান করছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় প্রায় আট লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়। এ সময়ে প্রায় ২৬ হাজার বন্যার্ত বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

মৌলভীবাজার: জেলার কুশিয়ারা নদী (শেরপুর) বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদীর পানি বিপত্সীমার ১৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও মৌলভীবাজারের বন্যাকবলিত পাঁচটি উপজেলার ৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। পাশাপাশি কিছু বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়নি বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খুরশেদ আলম। জেলার ৩৯টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো বন্যার পানি রয়েছে।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, দ্বিতীয় দফার বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে পানিবন্দি আট হাজার ২১০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা তিন লাখ ১৪ হাজার ২৪৭।

কুলাউড়ায় দ্বিতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়েছে হাওরতীরের মানুষ। এখন হাকালুকি হাওর ও জুড়ী নদীর পানিতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

গাইবান্ধা: জেলা সদরসহ সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ৬৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাইবান্ধা সদরে ১৭টি, ফুলছড়িতে ১৫টি, সাঘাটায় ২২টি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বিদ্যালয় বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

হবিগঞ্জ: জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ, দীগলবাক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ৫০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো সেগুলো পাঠদানের উপযোগী হয়নি। জেলার অনেক হাই স্কুলে হয়নি মূল্যায়ন পরীক্ষা। জেলার নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা।

বগুড়া:  এ জেলায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যার কারণে তিন উপজেলার ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুটি, একটি মাদরাসা ও ৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেই পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এই তিন উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৩৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সোনাতলা উপজেলায় আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা এবং ধুনটে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম কবির জানান, উপজেলার ৩৩টি সরকারি প্রাথমকি বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এ জন্য বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করানো সম্ভব হচ্ছে না। ধুনটে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধে।

সিলেট: সিলেটে অব্যাহত বৃষ্টিপাত কিছু কম থাকায় আগের দিনের তুলনায় গতকাল সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলার নদ-নদীর ১১ পয়েন্টের মধ্যে ৯টি পয়েন্টে পানি কমেছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেটের ৩১ উপজেলার ১০১টি ইউনিয়ন এখনো ব্যানকবলিত। এসব ইউনিয়নের এক হাজার ১৮০টি গ্রামের ছয় লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন বন্যাকবলিত। তবে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে। জেলার ২০৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৯ হাজার ৩৬৭ জন মানুষ রয়েছে।

তৃতীয় দফা বন্যার ধকল সামলাচ্ছে সিলেটবাসী। বন্যায় জেলার ১৩ উপজেলা প্লাবিত হয়। এর মধ্যে ১০ উপজেলায় বন্যার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে ৬৯ বিদ্যালয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭টি ওসমানীনগর উপজেলায়। এর পরই ১৪টি করে বিদ্যালয় রয়েছে বালাগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

টাঙ্গাইল: টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি বেড়ে গতকাল সকালে চার উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি। জেলার যমুনা ও ঝিনাই নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২০ ও ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

পাউবো টাঙ্গাইল সূত্রে জানা যায়, জেলার নদীগুলোর পানি বাড়ায় ভূঞাপুর, গোপালপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি। কয়েকটি এলাকায় নদীভাঙনে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ সাপের আতঙ্কে রয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে যমুনা, ঝিনাই, ধলেশ্বরীসহ জেলার সব নদীর পানি বেড়েছে। আরো কয়েক দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে বন্যার কবলে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২০টি মাদরাসা রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, জেলার ১৫৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দুটি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রৌমারী উপজেলার দুই শতাধিক ও রাজিবপুর উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রাম ও উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে দেখা দিয়েছে মানুষ ও গবাদি পশুর খাবারের সংকট।

সিরাজগঞ্জ: জেলার পাঁচটি উপজেলায় এক হাজার ২৭৬টি পরিবার পানিবন্দি। পানি আরো চার-পাঁচ দিন বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে পাউবো। এ কারণে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কৃষি অফিস জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ৪০৮ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার কয়েকটি স্থানে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় ৫০০ মেট্রিক টন চাল আর ১০ লাখ টাকা মজুদ আছে। সময়মতো সেগুলো বিতরণ করা হবে।

জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান, প্রতিটি উপজেলায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, কাজিপুরে ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকেছে।

কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মোট ২২৮ হেক্টর জমির রোপা আমনের বীজতলা, সবজি, কলা, তিল, মরিচ, আউশ ও পাটক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

শেরপুর: অতিবৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে শেরপুরের আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিমজ্জিত। জলমগ্ন এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝিনাইগাতী উপজেলার পাঁচটি, সদরের দুটি ও নালিতাবাড়ী উপজেলার একটি। শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

রাজবাড়ী: রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি ও স্রোত বেড়েই চলেছে। উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা পাউবো সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৮ সেন্টিমিটার। এ নিয়ে গত চার দিনে সেখানে ১১৮ সেন্টিমিটার পানি বাড়ল।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

১০ জেলায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ

আপডেট টাইম : ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪

দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ- এই ১০ জেলা বন্যাকবলিত। বন্যার পানি প্রবেশ করায় এসব জেলার এক হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার (৬ জুলাই) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

এর মধ্যে শুধু সুনামগঞ্জেই ৫৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বন্যার কারণে হাজারো মানুষ পানিবন্দি। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল। কিছু এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি সার্বিকভাবে কমছে, যা আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

তবে উত্তর, উত্তর-মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে আজ। আজ সকাল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শুক্রবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। আগামী দুই দিন ঝুঁকি বেশি থাকবে মূলত উত্তরের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার এবং উত্তর-পশ্চিমের ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে। এসব অঞ্চলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের ৫৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত ৩ জুলাই থেকে বিদ্যালয়ে গেলেও এসব বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী আসেনি।

একই কারণে গত সোমবার মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক ১০১টি বিদ্যালয়ে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস জানান, গত ১৬ থেকে ২০ জুনের প্রথম দফা বন্যায় জেলার এক হাজার ৪৭৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করে। পানি ওঠেনি এমন ২৫৮টি বিদ্যালয়ে বন্যার্তরা আশ্রয় নেয়। দ্বিতীয় দফা ৩০ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বন্যায়ও জেলার ২৩৮টি বিদ্যালয় প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি ওঠেনি এমন ৫৯টি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে এখনো বন্যাকবলিত লোকজন সপরিবারে অবস্থান করছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় প্রায় আট লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়। এ সময়ে প্রায় ২৬ হাজার বন্যার্ত বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

মৌলভীবাজার: জেলার কুশিয়ারা নদী (শেরপুর) বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদীর পানি বিপত্সীমার ১৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও মৌলভীবাজারের বন্যাকবলিত পাঁচটি উপজেলার ৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। পাশাপাশি কিছু বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়নি বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খুরশেদ আলম। জেলার ৩৯টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো বন্যার পানি রয়েছে।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, দ্বিতীয় দফার বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে পানিবন্দি আট হাজার ২১০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা তিন লাখ ১৪ হাজার ২৪৭।

কুলাউড়ায় দ্বিতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়েছে হাওরতীরের মানুষ। এখন হাকালুকি হাওর ও জুড়ী নদীর পানিতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

গাইবান্ধা: জেলা সদরসহ সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ৬৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাইবান্ধা সদরে ১৭টি, ফুলছড়িতে ১৫টি, সাঘাটায় ২২টি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বিদ্যালয় বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

হবিগঞ্জ: জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ, দীগলবাক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ৫০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো সেগুলো পাঠদানের উপযোগী হয়নি। জেলার অনেক হাই স্কুলে হয়নি মূল্যায়ন পরীক্ষা। জেলার নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা।

বগুড়া:  এ জেলায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যার কারণে তিন উপজেলার ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুটি, একটি মাদরাসা ও ৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেই পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এই তিন উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৩৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সোনাতলা উপজেলায় আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা এবং ধুনটে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম কবির জানান, উপজেলার ৩৩টি সরকারি প্রাথমকি বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এ জন্য বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করানো সম্ভব হচ্ছে না। ধুনটে বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধে।

সিলেট: সিলেটে অব্যাহত বৃষ্টিপাত কিছু কম থাকায় আগের দিনের তুলনায় গতকাল সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলার নদ-নদীর ১১ পয়েন্টের মধ্যে ৯টি পয়েন্টে পানি কমেছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেটের ৩১ উপজেলার ১০১টি ইউনিয়ন এখনো ব্যানকবলিত। এসব ইউনিয়নের এক হাজার ১৮০টি গ্রামের ছয় লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ জন বন্যাকবলিত। তবে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে। জেলার ২০৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৯ হাজার ৩৬৭ জন মানুষ রয়েছে।

তৃতীয় দফা বন্যার ধকল সামলাচ্ছে সিলেটবাসী। বন্যায় জেলার ১৩ উপজেলা প্লাবিত হয়। এর মধ্যে ১০ উপজেলায় বন্যার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে ৬৯ বিদ্যালয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭টি ওসমানীনগর উপজেলায়। এর পরই ১৪টি করে বিদ্যালয় রয়েছে বালাগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

টাঙ্গাইল: টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি বেড়ে গতকাল সকালে চার উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি। জেলার যমুনা ও ঝিনাই নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২০ ও ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

পাউবো টাঙ্গাইল সূত্রে জানা যায়, জেলার নদীগুলোর পানি বাড়ায় ভূঞাপুর, গোপালপুর, কালিহাতী ও সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি। কয়েকটি এলাকায় নদীভাঙনে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ সাপের আতঙ্কে রয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে যমুনা, ঝিনাই, ধলেশ্বরীসহ জেলার সব নদীর পানি বেড়েছে। আরো কয়েক দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে বন্যার কবলে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২০টি মাদরাসা রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, জেলার ১৫৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দুটি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রৌমারী উপজেলার দুই শতাধিক ও রাজিবপুর উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রাম ও উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে দেখা দিয়েছে মানুষ ও গবাদি পশুর খাবারের সংকট।

সিরাজগঞ্জ: জেলার পাঁচটি উপজেলায় এক হাজার ২৭৬টি পরিবার পানিবন্দি। পানি আরো চার-পাঁচ দিন বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে পাউবো। এ কারণে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কৃষি অফিস জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ৪০৮ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার কয়েকটি স্থানে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় ৫০০ মেট্রিক টন চাল আর ১০ লাখ টাকা মজুদ আছে। সময়মতো সেগুলো বিতরণ করা হবে।

জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জানান, প্রতিটি উপজেলায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, কাজিপুরে ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকেছে।

কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মোট ২২৮ হেক্টর জমির রোপা আমনের বীজতলা, সবজি, কলা, তিল, মরিচ, আউশ ও পাটক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

শেরপুর: অতিবৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে শেরপুরের আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিমজ্জিত। জলমগ্ন এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝিনাইগাতী উপজেলার পাঁচটি, সদরের দুটি ও নালিতাবাড়ী উপজেলার একটি। শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

রাজবাড়ী: রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি ও স্রোত বেড়েই চলেছে। উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা পাউবো সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৮ সেন্টিমিটার। এ নিয়ে গত চার দিনে সেখানে ১১৮ সেন্টিমিটার পানি বাড়ল।