বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বিসিএসে তিন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শিক্ষার্থী। এই কৃতিত্বের অধিকারী তিনজন হলেন প্রশাসনে প্রথম ইসমাইল হোসেন, তথ্য ক্যাডারে প্রথম সারাহ ফারজানা হক ও পরিসংখ্যানে প্রথম মোহাম্মদ কামাল হোসেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন কৃতিত্বের ঘটনা এটাই প্রথম।
বিসিএসে এমন সফলতায় উচ্ছ্বসিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক ডিন মো. রোজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘এটি বিরাট এক অর্জন। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারিনি। এরপরও তাদের এমন সাফল্যে খুব খুশি হয়েছি।’ দ্রুত গতিতে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। রেজাউল করিম বলেন, ‘যেভাবে আমরা এগিয়ে চলছি, এতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাদের শিক্ষার্থীরা জায়গা করে নিতে পারবে। সীমিত সুযোগ-সুবিধা আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, আমরা এর চেষ্টা করছি। তবে আমরা যে সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছি, তার প্রমাণ হচ্ছে তিন শিক্ষার্থীর শীর্ষ তিন পদে প্রথম হওয়া।
প্রশাসনে প্রথম ইসমাইল হোসেন
প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে পাস করা ইসমাইল হোসেন। তিনি যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। ফলাফলও ভালো। দুটোতেই জিপিএ-৫।
৩৬তম বিসিএস ছিল ইসমাইলের জীবনের প্রথম কোনো চাকরির পরীক্ষা।
বিসিএস পরীক্ষার পর তিনি অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন—কোনো না কোনো ক্যাডার পাবেনই। প্রথম যে হবেন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি। ইসমাইল বলেন, ‘আমাদের ছোট একটি বিশ্ববিদ্যালয়। হল নেই, ভালো গ্রন্থাগার নেই। প্রস্তুতি নেওয়ার বাড়তি কোনো সুযোগও নেই। এর মধ্যে বিসিএসে প্রথম হওয়া অনেক বড় ব্যাপার। ভালো লাগছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভবিষ্যতে যাঁরা বিসিএস দেবেন, তাঁদের জন্য এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
ইসমাইলের বাবা এ এফ এম কবির আহমেদ ঢাকাতেই ব্যবসা করেন। মা ফয়জুন্নেসা গৃহিণী। ছোট ভাই এইচএসসি পাস করে বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজ করছেন। বড় বোন আইনজীবী। আর আরেক বোন ৩৪তম বিসিএসে ননক্যাডারে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হয়েছেন।
তথ্য ক্যাডারে প্রথম সারাহ ফারজানা হক
তথ্য ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সারাহ ফারজানা হক। তিনি পাস করেছেন আইন বিভাগ থেকে। আইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছেন বরগুনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে। ফলাফল ৪ দশমিক ৬৯। উচ্চমাধ্যমিকও পড়েছেন মানবিক বিভাগে। বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে জিপিও-৫ পেয়েছেন। এ ছাড়া তিনি অনার্সে ৩ দশমিক ২৭ ও মাস্টার্সে ৩ দশমিক ৩৬ পেয়ে পাস করেছেন।
৩৬তম বিসিএস ছিল সারাহ ফারজানার দ্বিতীয় বিসিএস। এর আগে ৩৫তম বিসিএসে ননক্যাডারে দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু ইচ্ছা ছিল প্রথম শ্রেণির চাকরি করার। ‘আর সেই আশা নিয়েই পরেরবার বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিই। ফলাফলের দিনে অনেক উৎকণ্ঠায় ছিলাম। আশা ছিল ক্যাডার পাব, কিন্তু কোনো ক্যাডারে প্রথম হতে পারব—এটা প্রত্যাশাই ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, প্রথম হয়ে শুধু আমার নিজের মুখ উজ্জ্বল হয়নি; আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখও উজ্জ্বল হয়েছে।’
সারাহ ফারজানা আরও বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নেই। সবাই বিভিন্ন জায়গায় থেকে নিজের উদ্যোগে পড়াশোনা করে। হল থাকলে শেয়ার করে পড়তে সুবিধা হতো। আর তাহলে আমরা আরও ভালো করতে পারতাম। হল না থাকার এই শূন্যতার মধ্যেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে প্রথম হওয়া বিশাল ব্যাপার আমাদের জন্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুনেরা এ থেকে দারুণ অনুপ্রেরণা পাবেন।’
পরিসংখ্যানে প্রথম মোহাম্মদ কামাল হোসেন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের মোহাম্মদ কামাল হোসেন। পরিসংখ্যান ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন তিনি। তবে এটা তাঁর জীবনের প্রথম বিসিএস। ভালো ফলের কারণ বললেন নিজেই। তিনি বলেন, ‘লেগে ছিলাম ভালো ফল হবে—এই আশায়। পড়াশোনার পথটা সহজ ছিল না।’
কামাল চাঁদপুরের হাইমচরের আলগীবাজার সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ২০০৪ সালে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। পরে চাঁদপুর পুরানবাজার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে ৪ দশমিক ৫ পেয়েছেন, যা ছিল ওই বছরে মানবিকের সেরা ফল। অনার্সে ৩ দশমিক শূন্য ৩ ও মাস্টার্সে ৩ দশমিক ৪৭ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মূলত অনার্সের পর থেকে বিসিএসের পড়াশোনা শুরু করেছি। এরপর নিয়মিত পড়েছি। মনে হয়েছে, ভালো করে পড়লে একটা ভালো ফল আসবেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সুযোগ-সুবিধা। তারপরও ভালো ফল করেছি বলে বেশ ভালো লাগছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহপাঠীদের কিছুটা হলেও সম্মানিত করতে পেরেছি।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ১৫৯ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের নাম বদল করে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তাঁর বাবার নামে ১৮৭২ সালে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। ১৮৮৪ ও ১৯০৮ সালে যথাক্রমে এটি দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ওই সময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫’ পাসের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের ৩৬টি বিভাগ ও দুইটি ইনস্টিটিউট শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতে অনেক সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় সবাইকে। কেননা, পুরান ঢাকার দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়। পর্যাপ্ত পরিবহন-সুবিধা এবং আবাসিক সুবিধা না থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল বেদখল। দু-একটি হল উদ্ধার হলেও আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতার কারণে আবাসিক অসুবিধা সমাধানের পথ সচল হচ্ছে না। যদিও একটি ছাত্রীহলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে।
এত সমস্যার মধ্যেও সদ্য প্রকাশিত ৩৬তম বিসিএসে প্রশাসন, তথ্য ও পরিসংখ্যান ক্যাডারের ফলাফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম হওয়ায় বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আনন্দিত। এভাবে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান তাঁরা।
প্রথম আলো