বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় দুই শত মেয়ে প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। এটা ভাবতে আজও অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া হাজিরবাগ আইডিয়াল গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রীরা সেটি করে দেখাচ্ছে। কেউ কেউ পেছনে কুটুক্তি করলেও, সেই দিকে কান দেওয়ার সময় নেই মেয়েদের। তারা প্রগতির সঙ্গে এগিয়ে চলায় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে।
শিক্ষার আলোয় আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে তারাও অংশীদার। এজন্য এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। বাইসাইকেলে যাতায়াত করায় সময় অর্থ ও দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে। সচেতন হয়েছে এলাকার মানুষ, অভিভাবক, শিক্ষকরাও। উচ্চ শিক্ষা শিক্ষিত হয়ে মানুষের মত মানুষ হতে চায় তারা। শিক্ষার আলোকবির্তকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বাঁকড়া হাজিরবাগ আইডিয়াল গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৫ সালে জুনিয়র ও ২০০৪ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্তি। এরপর ২০১২ সালে একাদশ শ্রেণি চালু করা হয়। বর্তমানে স্কুল শাখায় ৩১৭ জন ও কলেজ শাখা ৯৭ জন ছাত্রী অধ্যায়নরত রয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ, বাঁকড়া, নির্বাসখোলা ও মণিরামপুর উপজেলার হরিহরনগর ইউনিয়নের ১২-১৪ টি গ্রামের মেয়েরা পড়াশুনা করে এই প্রতিষ্ঠানে। আগামীতে বাল্য বিয়ে, নারী নির্যাতন, ইভটিজিংসহ সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার দুর করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে শিক্ষার্থীরা। গত ২২ অক্টোবর স্কুল চত্ত্বরে কথা হয় তৃণমূলের এগিয়ে যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে। তারা জানায় সংগ্রামের কথ, এগিয়ে যাওয়ার কথা।
সানজিদা নাহার প্রিয়া : গ্রামের আশেপাশে মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো স্কুল নেই। গ্রামের স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে হয় সানজিদা নাহার প্রিয়াকে। ভ্যান, ইজিবাইকে যাতায়াত করতে প্রথম দিকে দুর্ভোগের শিকার হতে হতো। গ্রামের মেয়েদের বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া দেখে উৎসাহিত হয় প্রিয়া। এরপর বাবার কাছে বায়না ধরে বাইসাইকেল কিনে দিতে। প্রথমে মা রাজি হলেও বাবার সোজা কথা মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে গেলে লোকে অনেক কথা বলবে। এক পর্যায়ে বাবা রাজি হন সাইকেল কিনে দিতে। এরপর সাইকেল চালানো শিখি। প্রথম দিকে ভয় পেতাম। রাস্তায় কেউ কেউ নানা কথা বলতো। এখন আর কেউ কিছু বলে না জানাচ্ছিল সানজিদা নাহার প্রিয়া।
বাইসাইকেলে যাতায়াত করা দুর্ভোগ কমেছে। একই সঙ্গে খরচ ও সময় সাশ্রয় হয়েছে। প্রতিদিন স্কুলে আসতে সমস্যা হয় না যোগ করেন প্রিয়া। সে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মহাদেবপুর গ্রামের আবদুস সবুরের মেয়ে।
তামান্না সুলতানা ইভা : বান্ধবী লিলি, বৃষ্টি, তন্বী, সুমাইয়া, অরিন, জুলি সবাই একসঙ্গে দলবেঁধে প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করি। এতে সময়, অর্থ দুই বেঁচে যায়। স্কুলে অনুপস্থিত থাকি না। কথাগুলো বলছিলো নবম শ্রেণীর ছাত্রী তামান্না সুলতানা ইভা।
ঝিকরগাছা উপজেলার মহেশপাড়া গ্রামের বাবুল হোসেনের মেয়ে ইভা। স্কুল থেকে তার বাড়ির দুরুত্ব চার কিলোমিটার। এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় এই স্কুলে পড়াশুনা করছে। যাতায়াতের সুবিধার্থে বাবার কাছ থেকে একটি বাইসাইকেল পেয়েছে। সেই বাইসাইকেলে প্রতিদিন সে স্কুলে যাতায়াত করছে।
ইভা জানায়, তার বাবা প্রথম দিকে বাইসাইকেল কিনে দিতে রাজি হননি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন ২/৩ মাইল হেটে, ভ্যানে, ইজিবাইকে যাতায়াত করেছে সে। এতে তার দুর্ভোগ বেড়ে যায়। পরে এলাকার আরও অনেকে মেয়েকে দেখে বাবা বাইসাইকেল কিনে দিতে রাজি হন। ইভা বাবার কাছ থেকে একটি বাইসাইকেল পায়। এরপর পাশের গ্রামে নানার বাড়িতে গিয়ে চালানো শিখে আসে। প্রথম দিকে বাইসাইকেল চালাতে একটু লজ্জা লাগলেও, এখন আর কোনো ভয়, লজ্জা করে না। প্রথম দিকে লোকের নানা কথার ভয় থাকলেও দল বেঁধে আমরা স্কুলে আসি, এ জন্য কোনো সমস্যা হয় না। নিয়মিত স্কুলে আসছি। স্কুলের বড় আপাদের দেখে আমারও সাহস পেয়েছি।
লুবনা আক্তার : ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ থেকে মেধা যাচাই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বছর দেড় আগে একটি বাইসাইকেল উপহার পায়। সেই বাইসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে নবম শ্রেণীর ছাত্রী লুবনা আক্তার। ঝিকরগাছার রায়পটন গ্রামের ইসমাইল হোসেনের মেয়ে লুবনা ক্লাসের প্রথম ছাত্রী। নিজের একটি বাইসাইকেল হওয়া সে মহাখুশি।
লুবনা আক্তার জানায়, আগে স্কুলে হেটে, ভ্যানে যাতায়াত করতাম। খুব কষ্ট হতো। প্রতিদিন সময়মত স্কুলে যাতায়াত করছি। অর্থের সাশ্রয়, স্কুলে অনুপস্থিতিও কম। শুধু আমি একা না, অনেক মেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। আমরা সবাই খুব খুশি। আমরা বাল্য বিয়েকে না বলেছি। আমরা পড়াশুনা করে অনেক বড় হতে চাই।
ফাতেমা আক্তার রুমা : বাড়ির আশেপাশে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল নেই। পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর চিন্তায় পড়ে যায় ফাতেমা আক্তার রুমা। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৫ কিলোমিটার দূরে বাঁকড়া-হাজিরবাগ আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি করা হবে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তিও করা হয়। অনেক দূরের পথ ভ্যান, ইজিবাইকে যাতায়াত করতে অসুবিধা দেখা দেয়। রুমা বাবার কাছে বায়না ধরে স্কুলের আপুরা সাইকেল চালিয়ে আসে। আমিও বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাবে। প্রথম বাবা রাজি হই না। এরপর মেয়ের সুবিধার কথা চিন্তা করে বাইসাইকেল কিনে দেয়। সেই বাইসাইকেল প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করছে। ঝিকরগাছা উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের আবদুর রবের মেয়ে রুম এখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সে জানায়, আমাদের স্কুলের প্রায় দুইশো মেয়ে দলবেঁধে স্কুলে আসে। আগে অনেকে পেছনে কিছু কথা বললেও এখন আর কেউ বলে না। লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হতে চাই।
লিলি সুলতানা : আমাদের পাড়ার আপুরা বাইসাইকেলে চড়ে স্কুলে যাতায়াত করতো। তাদের দেখে আমরাও বাইসাইল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছি। প্রথম দিকে কিছু মানুষ খারাপ কথা বললেও এখন আর বলে না। আমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে চাই। বাল্য বিয়েকে না বলেছি। বলছিল ঝিকরগাছা উপজেলার মহেশপাড়া গ্রামের কাবিল হোসেনের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী লিলি সুলতানা। সে প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। সে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে না। নিয়মিত স্কুলে যাই।
তাহেরা আক্তার শান্তা : ঝিকরগাছা উপজেলার ইস্তা গ্রামের আজিজুর রহমানের মেয়ে তাহেরা আক্তার শান্তা নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সে প্রতিদিন সাড়ে চার কিলোমিটার পথ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেয় তার বাবা। তার মত এলাকার অনেক মেয়ে এখন বাইসাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে। এতে সময়, অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। স্কুলে অনুপস্থিতির হারও কমেছে। শান্তা বলছিল, আশেপাশে হাইস্কুল না থাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরের এই প্রতিষ্ঠানে সে পড়ছে। তার মত অনেক মেয়ে এখন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। সবাই খুব মজা করি। লেখাপড়া করে দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাই।
প্রতিষ্ঠানের ভরাপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রজব আলী বলেন, বর্তমানে স্কুল পর্যায়ে ৩১৭ জন ও কলেজ পর্যায়ে ৯৭ জন ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। এদের মধ্যে প্রায় ২’শ ছাত্রী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করছে। যাতায়াতের সুবিধা হওয়ায় ক্লাসে অনুপস্থিতির হারও কম।
তিনি আরো জানান, ২০০৫ সাল থেকে মেয়েরা বাইসাইকেলে যাতায়াত শুরু করে বলেও জানান তিনি।
তারপর থেকে পর্যায়ক্রমে এখন প্রায় দুইশ ছাত্রী বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। প্রথম দিকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা মেয়েদের রাস্তায় বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা হলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি বলেও জানান তিনি।