বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দোয়ারাবাজারের সেই স্কুল থেকে শিক্ষার্থী বের করে দেবার বিষয়ে এবং জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের সরেজমিন তদন্ত হবে আজ। তদন্তকালে মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং দোয়ারাবাজার কলেজের অধ্যক্ষকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে, মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অভিভাবকরা জানিয়েছেন,‘তদন্তকালে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমির নিকট মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বন্দোবস্ত চেয়ে আবেদন করা ভূমির বিষয়টিও নজরে আনবেন এলাকাবাসী। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে দোয়ারাবাজারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এই তদন্ত করবেন।
১৯৯৪ সালে মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী। বিদ্যায়ের নামে ৩৩ শতক জমি দানপত্র রেজিস্ট্রি করে দেন একই গ্রামের ঠাকুর চান দাসের ছেলে সারদা কান্তি দাস। প্রায় ৩ বছর পাঠদানের পর বিদ্যালয়টি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়। ঘর না থাকায় পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ থাকে। এসময় ঐ বিদ্যালয়ের জমি খালি থাকায় ঐ জমিতেই দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের ৪ তলা ভবন হয়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে দোয়ারাবাজার কলেজের পুরাতন টিনশেড ঘরটি। ২০০৭ সালে আবার দোয়ারাবাজার কলেজের পরিত্যক্ত টিনশেড ঘরে মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। সম্প্রতি, মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানতে পারেন সারদা কান্তি দাস বিদ্যালয়ের যে জমি দানপত্র করে দিয়েছিলেন, সেটি পরবর্তী সময়ে কলেজকে দানপত্র করে দিয়েছেন।
বিষয়টি জেনে স্কুল কর্তৃপক্ষ দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যান । ইউএনও প্রধান শিক্ষককে জানান, মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে। ওখানে ১১৫ শতক জমি রয়েছে। এই সংবাদ জেনে গত ১৭ এপ্রিল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য জমি বন্দোবস্তের আবেদন করেন। বিষয়টি জেনে দোয়ারাবাজার কলেজের অধ্যক্ষ ক্ষিপ্ত হন। তিনি ঐ দিনই মংলারগাও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড খুলে ঐ ঘরে তালা ঝুলিয়ে রাখেন।
২৩ ও ২৪ এপ্রিল বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের ১৬২ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত হলে কলেজ অধ্যক্ষ একরামুল হক শিক্ষার্থীদের ঘরে ঢুকতে দেননি। পরে প্রখর রোদে খোলা আকাশের নীচে পরীক্ষা দিয়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা। এসময় বিদ্যালয়ের অনেক শিশু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহারের শর্তে স্কুলঘর ব্যবহারের অনুমতি দেন অধ্যক্ষ। পরে প্রধান শিক্ষিকা জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার করেন।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন মংলারগাঁও বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। তাদের পক্ষ থেকে ২৬ এপ্রিল পশ্চিম নৈনগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলাম মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বর্তমানে থাকা স্কুলের ১২৭৭ নম্বর দাগের ১১৫ একর জমির মধ্যে ৪৫ শতক জমি বন্দোবস্ত চেয়ে আবেদন করেছেন।
আবেদনে সাবেক ইউপি সদস্য মো. তাজুল ইসলাম উল্লেখ করেন, নৈনগাঁও মৌজার ৩৭৮ নম্বর খতিয়ানের ১২৭৭ নম্বর দাগের সরকারি জমির ১১৫ একর’র ৪৫ শতাংশ মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবহার করে আসছে। তিনি ব্যবহৃত এই ভূমি মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অভিভাবক তেগাঙা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল বলেন,‘মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে আমার ভাগ্নি (বোনের মেয়ে) এখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছে। ঐ স্কুলের নামে একসময় জমি ছিল, স্কুলটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে বন্ধ হয়ে পড়লে ভূমি দাতা ঐ জমিই দোয়ারাবাজার কলেজকে দানপত্র করে দেন। এখন যেহেতু সেখাইে প্রচুর পরিমাণ সরকারি জমিও রয়েছে, স্কুলও চালু আছে, কিছু জমি স্কুলকে দিলে কলেজের পাশাপাশি স্কুলও টিকে থাকবে।’
শিক্ষার্থী অভিভাবক তেগাঙার বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, ‘মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হওয়াতে গ্রামের শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তামুক্ত থাকেন। এখানে স্কুল না থাকলে শিক্ষার্থীদের দেড় মাইল পায়ে হেঁটে হয় দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের স্কুলে, না হয় দেড় মাইল দূরের নৈনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হবে। এই পথ যেতে সড়ক আছে, নদীও আছে। শিশুদের জন্য এই পথ কেবল দূরের নয়, ঝুঁকিপূর্ণও। এই জন্য স্কুলটি টিকে থাকা চাই আমরা।’
নৈনগাঁওয়ের বাসিন্দা সুন্দর আলী বলেন,‘নৈনগাঁও বা দোয়ারাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঐ এলাকার শিশুদেরই স্থান সংকুলান হয় না। আমাদের শিশুরা পড়বে কীভাবে। মংলারগাঁওয়ে স্কুল হওয়াতে সকল শিশুরাই স্কুলে যায়। এই স্কুল না থাকলে অনেক শিশুই স্কুলে যাবে না। স্কুলে পড়েই শিক্ষার্থীদের কলেজে পড়তে হবে। এজন্য স্কুল- কলেজ দুটোই থাকতে হবে।’
শিক্ষার্থী অভিভাবক মংলারগাঁওয়ের বাসিন্দা দিলীপ দাস বলেন,‘আমরা সংসদ সদস্য মহোদয়ের কাছেও এখানকার স্কুলটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানাবো।’ তিনি জানান, সোমবারের তদন্তের সময়ও এলাকার সকল অভিভাবকই উপস্থিত থাকবেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল খালেক বলেন,‘৪-৫ গ্রামে স্কুল নেই, এলাকার উদ্যমী কিছু মানুষ একটি স্কুল করেছে, শিক্ষার্থী আছে ১৬২ জন, আমরা এলাকাবাসী এই স্কুলটি রক্ষা করার জন্য সকলের কাছেই দাবি জানানো।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম ফজলুল হক বলেন,‘দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরসহ দুয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে প্রখর রোদে খোলা আকাশের নীচে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে। এটি কেন হলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবার জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা চিঠি দিয়েছেন। সোমবার সরেজমিনে গিয়ে এই বিষয়টি জানবো আমরা। একই ঘটনায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সহকারী কমিশনার ভূমি সাহেবও ওখােেন যাবেন। আমরা একসঙ্গে বিদ্যালয়ের ভূমি বিরোধের বিষয়েও জানার চেষ্টা করবো। স্কুলটি হবার জন্য যেটুকু সম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা করবো আমরা।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ইদ্রিছ আলী বীরপ্রতীক বলেন,‘মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এইবারই প্রথম আমার চোখে পড়েছে। দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ কলেজের একটি টিনশেড ঘরে স্কুল পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। এই গ্রামে একটি স্কুল হওয়া জরুরি। তবে কোন প্রক্রিয়ায় স্কুলটি হবে, সেটি বিবেচ্য বিষয়। এই স্কুলের জন্য জমি যিনি দান করেছিলেন, স্কুল না হওয়ায় ঐ ভূমিদাতা পরে দলিলে স্কুল না হবার বিষয়টি উল্লেখ করে কলেজের নামে জমি দানপত্র করে দিয়েছেন।’