দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় অগ্রগতি আছে যথেষ্ট। আবার ঘাটতিও কম নয়। সাক্ষাৎকারে সেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নেহাল আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
প্রশ্ন: আমাদের দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা এখন কেমন চলছে?
নেহাল আহমেদ : বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। ভর্তি বেড়েছে। ছাত্রীরা পড়াশোনায় এগিয়েছে। পাসের হার বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। অবকাঠামো খাতেও বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখনো বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষার অভাব। আমরা হয়তো সনদ পাচ্ছি, কিন্তু সেই সনদ যতটুকু জ্ঞান অর্জন করে পাওয়া উচিত, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে না। শহরভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হয়তো বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা চাপেও থাকে, আবার এগিয়েও থাকে। কিন্তু মফস্বল এলাকায় এখন সেটা হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকের সংকট যেমন আছে, তেমনি শিক্ষকের মানের সংকটও আছে। সরকার অবকাঠামোগত দিক থেকে বিরাট সহযোগিতা দিয়েছে। সারা দেশে এখন ভাঙাচোরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট রয়ে গেছে। এর কারণ হলো, আমাদের দেশে শিক্ষকতার পেশাটি খুব একটা আকর্ষণীয় অবস্থায় নেই। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ ও স্কুল সবখানেই। শিক্ষকতাকে এখন অনেকেই সম্মানজনক পেশা হিসেবে মনে করেন না। এর চেয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে বেশি ভালো পেশা মনে করেন, যে কারণে ভালো মানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় কম আসছেন। উন্নত বিশ্বে যেটা একেবারেই উল্টো। সেখানে সাধারণত ক্লাসের প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে শিক্ষক হওয়ার। আর বাংলাদেশে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে ভবিষ্যতে প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ, কাস্টমস ইত্যাদি ক্যাডার কর্মকর্তা হবেন। ফলে বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষকের প্রচুর অভাব এখনো। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে এই সংকট আরও বেশি। এই সংকট দূর করতে হবে।
প্রশ্ন: মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের অনেকেই এখনো ঠিকমতো প্রশ্নই করতে পারেন না। বিশেষ করে সৃজনশীলের প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তাঁরা গলদঘর্ম হচ্ছেন, এটা কেন?
নেহাল: আসলে মানসম্পন্ন শিক্ষক কম থাকার কারণেই অনেকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে এখনো প্রশ্ন করতে পারেন না।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, শিক্ষা এখন পরীক্ষানির্ভর হয়ে গেছে। আপনার কী মনে হয়?
নেহাল: এটা ঠিক যে পরীক্ষানির্ভরতা আছে। এখন শিক্ষার্থীরাও মনে করে, ক্লাসে না এসে নোট-গাইড পড়েই পাস করে যাবে। তারা মনে করে, ক্লাসে আসার দরকার কী? আমি সব সময়ই ক্লাসের ওপর জোর দিতে চাই। ছাত্রজীবনেও দেখবেন, কিছু শিক্ষকের ক্লাস করার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম। আবার কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁদের ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতাম। ব্যাপারটা হলো, মানসম্পন্ন শিক্ষক না হলে এবং শিক্ষক যদি আকর্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা আগ্রহী কম হবে। আমি ঢাকা কলেজে যে ব্যবস্থা করেছি, তাতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু আমি নিজেও মাঝেমধ্যে দ্বিধায় থাকি, আমার শিক্ষকেরা সে পরিমাণ আকর্ষণীয় করে ছাত্রদের কাছে ক্লাসটি উপস্থাপন করতে পারছেন কি না। আমি বলব পড়াশোনার জন্য শ্রেণিকক্ষের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন: স্কুল-কলেজের পড়াশোনায় এখন প্রাইভেট ও কোচিংয়ের আধিক্য, ব্যবসায়িক কোচিং সেন্টার যেমন আছে, তেমনি শিক্ষকেরাও জড়িয়েছেন এই কাজে, এটা কেন হচ্ছে?
নেহাল: ক্লাসকে যদি খুব আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারা যায়, স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাসের জন্য প্রাইভেট-কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকবে। সেটাই হচ্ছে। কিছু শিক্ষক এই প্রাইভেট-কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তবে কোচিংয়ের জন্য ঢালাওভাবে সব শিক্ষককে দোষারোপ করা যাবে না। এখন তো কিছু কোচিং করপোরেট হাউসের মতো হয়ে গেছে। আমি নাম নিতে চাই না। তাদের শাখা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এগুলো শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, আমি মনে করি, এগুলো বন্ধ করা উচিত।
প্রশ্ন: মানসম্মত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কী করা উচিত বলে মনে করেন?
নেহাল: শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে তুলে ধরতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়াতে হবে। না হয় ভালো ছেলেমেয়েরা এই পেশায় আসবে না। এরপর শিক্ষকদের জন্য প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষকদের অনেক প্রশিক্ষণ অন্য পেশার লোকেরা দেশে-বিদেশে গিয়ে নিয়ে আসেন। অথচ সেই প্রশিক্ষণটা দরকার ছিল একজন শিক্ষকের।
প্রথম আলো