ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে বন্যা এবং মরা ছাগল তত্ত্ব

ভদ্রলোকের নাম শাহ কামাল। (পাঠক হয়ত লক্ষ করবেন, এই লোকের নামের সঙ্গে আমার নামের একটা অংশের হুবহু মিল রয়েছে। এই মিলের কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি।) উনি একজন সচিব। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব। কদিন আগে উনি সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন। একা নন, সঙ্গে ওনার মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীও ছিলেন। ছিলেন আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। গিয়েছিলেন ওনারা সেখানকার হাওর এলাকার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উপলব্ধি করতে, মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ নিজ চোখে দেখতে। সন্দেহ নেই, এটি একটি অতি উত্তম কর্ম। ওনাদের এই কর্মকা-ের বাকি অংশে যাওয়ার আগে বরং হাওরের পরিস্থিতিটা একটু বলে নেওয়া দরকার।

দেশের একটা বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর। আয়তনে পুরো দেশের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এখানকার জনসংখ্যাও একেবারে কম নয়, দুই কোটি। অন্য এলাকা থেকে তুলনামূলক কিছুটা নিচু হওয়ায় হাওর এলাকায় বছরের একটা লম্বা সময় ধরে পানি থাকে। বলা যায়, পানিতে ডুবে থাকে। যে সময়টায় অত পানি থাকে না, তখনই রোপণ করা হয় ফসল। ফসল বলতে মূলত ধান, বোরো ধান। পানিতে ডুবে থাকার কারণে এখানের মাটি খুবই উর্বর, তাই ফসলও হয় প্রচুর। এই ফসল চাষে সার বা সেচের তেমন একটা দরকার হয় না। হাওর এলাকাকে বলা হয় বাংলাদেশের শস্যভা-ার। বছরে এখানে কেবল যে একটি ফসল হয়, সেই বোরো ধানই এতবেশি উৎপাদন হয় যে, নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ধান তারা সরবরাহ করে সারা দেশে। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের ১৮ শতাংশই হয় হাওর অঞ্চলে।

এত গেল ধানের কথা। নিচু এলাকা বলে এখানকার পানিতে মাছও হয় প্রচুর। দেশের মোট মাছের ২০ শতাংশ মাছ আসে হাওর এলাকা থেকে। ঢাকা শহরে আমরা যে মাছ খাই, তার একটা বড় অংশ হাওরের মাছ। প্রাকৃতিক পরিবেশের মাছ বলে এর স্বাদ, চাহিদা এবং দামও বেশি।
এই যে এত সমৃদ্ধ হাওর অঞ্চল, তার এখন বড় দুঃসময়। অকাল বন্যায় এবার তাদের একমাত্র ফসলটি ভেসে গেছে। ক্ষেতের ধানগুলো কদিন আগেও পুষ্ট হয়ে উঠেছিল। হয়ত আর দুই সপ্তাহেই ঘরে তোলার মতো হতো। তখনই উজান থেকে নেমে এলো পাহাড়ি ঢল, সেই সঙ্গে লাগাতার কয়েকদিন বৃষ্টি। আচমকা ভেসে গেল, ডুবে গেলে সব ধান। সম্পন্ন যে কৃষক হাজার হাজার মণ ধানের হিসাব করছিল, রাতারাতি সে পরিণত হলো নিঃস্বে। ধান কাটার সময় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক লাগে। শ্রমিকদের সেই চাহিদাও হঠাৎ করেই একেবারে নেই হয়ে গেল। পুরো এলাকাজুড়ে একটা হাহাকার।

কেবল ফসল নয়, মাছ এবং প্রাণিসম্পদেরও হয়েছে বিরাট ক্ষতি। বিপুল মাছের উৎস এই হাওরগুলো। এক হাকালুকি হাওর থেকেই প্রতি বছর ১৩ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যেত। বাকি হাওরের হিসাব যোগ করলে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে কয়েক লাখ মেট্রিক টনে। এখন অর্থনৈতিক সেই হিসাবটিও কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেছে।

পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ধানগাছ পানিতে ডুবে গেছে। তারপর সেখানে পচে তা থেকে বের হয়েছে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস। মিশেছে তা পানিতে। এতে হাওরের পানিতে কমে গেছে অক্সিজেনের পরিমাণ। অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় অসংখ্য মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এসব মাছের দেহে ঢুকে গেছে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। ফলে এই মাছ যারা যাচ্ছে, তাতেও দেখা দিচ্ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। এরই মধ্যে পানিতে ভেসে থাকা সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে অনেক হাঁসও মারা গেছে। সব মিলিয়ে এক জটিল অবস্থা। বিষয়টি মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন, এরই মধ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে হাওরের পানিতে ভেসে ওঠা মরা মাছ ধরার ওপর।

সরকার তো নিষেধাজ্ঞা জারি করেই খালাস। তাদের দায়িত্ব তারা পালন করেছে, বলে দিয়েছেÑ এই মাছ খাওয়া যাবে না, ধরা যাবে না। কিন্তু সেখানকার মানুষের হবেটা কি? ফসল থেকে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মাছ ধরে বিক্রি করে যে কিছু আয় করবেÑ সেটাও বন্ধ হলো।
অসময়ে আসা পাহাড়ি এই ঢলের শিকার হয়েছে এবার সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ হাওর। হাওরবাসীর কাছে পাহাড়ি ঢল যে খুব অপরিচিত কোনো বিষয়, তা নয়। আচমকা এই বিপদের সঙ্গে তারা পরিচিত। এ নিয়ে সরকারেরও অনেক চিন্তাভাবনা আছে। ফসল রক্ষার জন্য সরকার তাই হাওর এলাকায় বেশকিছু বাঁধ তৈরির প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এই বাঁধগুলো গত ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তৈরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ বাঁধের নির্মাণই শেষ হয়নি। কোনো কোনোটি মাত্র ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয়েছে। যখন নির্মাণ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, তখনই মাত্র কেন শুরু হলো এসব কাজ? এ প্রশ্নের জবাবের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের অমানবিক দুর্নীতির বিচিত্র সব মতলব। সেসব অনেক কিছুই এখন আলোচনায় আসছে, সরকার যদি আসলেই আন্তরিক হয় তাহলে হয়ত তার কিছু কিছু উদঘাটিতও হবে। কিন্তু সেসবের চেয়েও এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবন।

হাওরের মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। খাবার নেই, অর্থ নেই, কাজ নেই। অভাবিত বিপুল ধ্বংসযজ্ঞে ভেঙে গেছে অনেকের মনোবলও। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বাঁচে কি করে?

মানুষের এই মুহূর্তের দরকারটাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। অকাল বন্যা শুরু হয়েছে দু সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম দশদিনে এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্যও দেখা যায়নি কোনো পর্যায়ে। কেউ যেন কিছু জানেই না। এ নিয়ে হাওরবাসীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন হলো, মানববন্ধন হলো। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবেদন হলো। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে অনেকে দাবি করেছেন, বন্যাকবলিত হাওর অঞ্চলকে ‘দুর্গত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণার জন্য। তারপরই যেন ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলেন কর্তাব্যক্তিরা। তারা ভাবলেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে সরেজমিনে উপদ্রুত এলাকায় যাওয়া দরকার। সেই অনুযায়ী ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা চলে গেলেন সুনামগঞ্জে।

সুনামগঞ্জে গিয়ে তারা কতটুকু কি দেখেছেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু দেখাদেখি শেষে যে ব্রিফিংটা করলেন, সেটাই হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী ছিলেন। তবে সচিবই যেন মূল বক্তা, তিনি যা কিছু বললেন তার কোনো তুলনা হয় না। তার সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ যেন ছিল ওই ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণার দাবি নিয়ে। এই সচিব সাহেবের কথাই বলতে শুরু করেছিলাম লেখার একেবারে শুরুতে। ওনার নামই শাহ কামাল।

শাহ কামাল সাহেব বললেন, ‘আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যাবে, যদি সেই এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মরে যায়, এবং দেশে খাদ্য নেই বলে যদি ইউনিসেফ এবং ইউএন ডিক্লেয়ার করে, তাহলে সেই এলাকার প্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবে, ইনকোয়ারি করবে, করে জানাবে, তারপর মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই এলাকাকে দুর্গত এলাকা বলে ঘোষণা করবেন।’ আসলে এই অহেতুক কতগুলো সস্তা কথা বলা, যারা এসব বলে তারা না জেনে বলে, তাদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই।

অর্থাৎ শাহ কামাল সাহেব প্রমাণ করে দিলেন বন্যাউপদ্রুত হাওর অঞ্চলকে কোনোভাবেই ‘দুর্গত এলাকা’ বলার কোনো সুযোগ নেই। ভদ্রলোক আরও কিছু সময় পেলে হয়ত এটাও প্রমাণ করে দিতে পারতেন যে, বন্যা হলেও হাওরের মানুষের কোনো ক্ষতিই হয়নি! তবে সে সুযোগ তিনি পাননি। পাননি আসলে তারই মন্ত্রণালয়ের খোদ মন্ত্রীর কারণে। উনি যখন ওইসব জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তার পাশেই বসে ছিলেন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি যেন নতুন একটা পয়েন্ট মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘ছাগল মরে নাই!’
এরপর আর কি লাগে। দ্বিগুণ উৎসাহে সচিব সাহেব বলতে লাগবেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো গরু মারা গেছে বা ছাগল মারা গেছে এমন তথ্যও আসে নাই!’

অর্ধেক মানুষ মারা যায় নাই, ছাগল মারা যায় নাই, তাহলে দুর্গত এলাকা কি করে হলো? এর চেয়ে লাগসই প্রশ্ন কেউ কখনো শুনেছেন?
পাদটীকা

সেদিন ফেসবুকে একজনের একটা স্ট্যাটাস দেখলাম। সচিব শাহ কামালের ছাগল-সংক্রান্ত এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘কেন কোনো মৃত ছাগল পাওয়া গেল না?’

জবাবটাও উনি নিজেই দিয়েছেন। ‘আসলে বন্যা শুরুর আগেই সব ছাগল ঢাকায় চলে গিয়েছিল সচিব হওয়ার জন্য, সে কারণেই কোনো মরা ছাগল পাওয়া যায়নি!’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হাওরে বন্যা এবং মরা ছাগল তত্ত্ব

আপডেট টাইম : ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

ভদ্রলোকের নাম শাহ কামাল। (পাঠক হয়ত লক্ষ করবেন, এই লোকের নামের সঙ্গে আমার নামের একটা অংশের হুবহু মিল রয়েছে। এই মিলের কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি।) উনি একজন সচিব। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব। কদিন আগে উনি সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন। একা নন, সঙ্গে ওনার মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীও ছিলেন। ছিলেন আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। গিয়েছিলেন ওনারা সেখানকার হাওর এলাকার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উপলব্ধি করতে, মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ নিজ চোখে দেখতে। সন্দেহ নেই, এটি একটি অতি উত্তম কর্ম। ওনাদের এই কর্মকা-ের বাকি অংশে যাওয়ার আগে বরং হাওরের পরিস্থিতিটা একটু বলে নেওয়া দরকার।

দেশের একটা বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর। আয়তনে পুরো দেশের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এখানকার জনসংখ্যাও একেবারে কম নয়, দুই কোটি। অন্য এলাকা থেকে তুলনামূলক কিছুটা নিচু হওয়ায় হাওর এলাকায় বছরের একটা লম্বা সময় ধরে পানি থাকে। বলা যায়, পানিতে ডুবে থাকে। যে সময়টায় অত পানি থাকে না, তখনই রোপণ করা হয় ফসল। ফসল বলতে মূলত ধান, বোরো ধান। পানিতে ডুবে থাকার কারণে এখানের মাটি খুবই উর্বর, তাই ফসলও হয় প্রচুর। এই ফসল চাষে সার বা সেচের তেমন একটা দরকার হয় না। হাওর এলাকাকে বলা হয় বাংলাদেশের শস্যভা-ার। বছরে এখানে কেবল যে একটি ফসল হয়, সেই বোরো ধানই এতবেশি উৎপাদন হয় যে, নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ধান তারা সরবরাহ করে সারা দেশে। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের ১৮ শতাংশই হয় হাওর অঞ্চলে।

এত গেল ধানের কথা। নিচু এলাকা বলে এখানকার পানিতে মাছও হয় প্রচুর। দেশের মোট মাছের ২০ শতাংশ মাছ আসে হাওর এলাকা থেকে। ঢাকা শহরে আমরা যে মাছ খাই, তার একটা বড় অংশ হাওরের মাছ। প্রাকৃতিক পরিবেশের মাছ বলে এর স্বাদ, চাহিদা এবং দামও বেশি।
এই যে এত সমৃদ্ধ হাওর অঞ্চল, তার এখন বড় দুঃসময়। অকাল বন্যায় এবার তাদের একমাত্র ফসলটি ভেসে গেছে। ক্ষেতের ধানগুলো কদিন আগেও পুষ্ট হয়ে উঠেছিল। হয়ত আর দুই সপ্তাহেই ঘরে তোলার মতো হতো। তখনই উজান থেকে নেমে এলো পাহাড়ি ঢল, সেই সঙ্গে লাগাতার কয়েকদিন বৃষ্টি। আচমকা ভেসে গেল, ডুবে গেলে সব ধান। সম্পন্ন যে কৃষক হাজার হাজার মণ ধানের হিসাব করছিল, রাতারাতি সে পরিণত হলো নিঃস্বে। ধান কাটার সময় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক লাগে। শ্রমিকদের সেই চাহিদাও হঠাৎ করেই একেবারে নেই হয়ে গেল। পুরো এলাকাজুড়ে একটা হাহাকার।

কেবল ফসল নয়, মাছ এবং প্রাণিসম্পদেরও হয়েছে বিরাট ক্ষতি। বিপুল মাছের উৎস এই হাওরগুলো। এক হাকালুকি হাওর থেকেই প্রতি বছর ১৩ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যেত। বাকি হাওরের হিসাব যোগ করলে সেটা গিয়ে দাঁড়াবে কয়েক লাখ মেট্রিক টনে। এখন অর্থনৈতিক সেই হিসাবটিও কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেছে।

পৌনে দুই লাখ হেক্টর জমির ধানগাছ পানিতে ডুবে গেছে। তারপর সেখানে পচে তা থেকে বের হয়েছে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস। মিশেছে তা পানিতে। এতে হাওরের পানিতে কমে গেছে অক্সিজেনের পরিমাণ। অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় অসংখ্য মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এসব মাছের দেহে ঢুকে গেছে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। ফলে এই মাছ যারা যাচ্ছে, তাতেও দেখা দিচ্ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। এরই মধ্যে পানিতে ভেসে থাকা সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে অনেক হাঁসও মারা গেছে। সব মিলিয়ে এক জটিল অবস্থা। বিষয়টি মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পেরেছেন, এরই মধ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে হাওরের পানিতে ভেসে ওঠা মরা মাছ ধরার ওপর।

সরকার তো নিষেধাজ্ঞা জারি করেই খালাস। তাদের দায়িত্ব তারা পালন করেছে, বলে দিয়েছেÑ এই মাছ খাওয়া যাবে না, ধরা যাবে না। কিন্তু সেখানকার মানুষের হবেটা কি? ফসল থেকে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মাছ ধরে বিক্রি করে যে কিছু আয় করবেÑ সেটাও বন্ধ হলো।
অসময়ে আসা পাহাড়ি এই ঢলের শিকার হয়েছে এবার সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ হাওর। হাওরবাসীর কাছে পাহাড়ি ঢল যে খুব অপরিচিত কোনো বিষয়, তা নয়। আচমকা এই বিপদের সঙ্গে তারা পরিচিত। এ নিয়ে সরকারেরও অনেক চিন্তাভাবনা আছে। ফসল রক্ষার জন্য সরকার তাই হাওর এলাকায় বেশকিছু বাঁধ তৈরির প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এই বাঁধগুলো গত ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তৈরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ বাঁধের নির্মাণই শেষ হয়নি। কোনো কোনোটি মাত্র ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয়েছে। যখন নির্মাণ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, তখনই মাত্র কেন শুরু হলো এসব কাজ? এ প্রশ্নের জবাবের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের অমানবিক দুর্নীতির বিচিত্র সব মতলব। সেসব অনেক কিছুই এখন আলোচনায় আসছে, সরকার যদি আসলেই আন্তরিক হয় তাহলে হয়ত তার কিছু কিছু উদঘাটিতও হবে। কিন্তু সেসবের চেয়েও এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবন।

হাওরের মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। খাবার নেই, অর্থ নেই, কাজ নেই। অভাবিত বিপুল ধ্বংসযজ্ঞে ভেঙে গেছে অনেকের মনোবলও। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বাঁচে কি করে?

মানুষের এই মুহূর্তের দরকারটাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। অকাল বন্যা শুরু হয়েছে দু সপ্তাহ হয়ে গেছে। প্রথম দশদিনে এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্যও দেখা যায়নি কোনো পর্যায়ে। কেউ যেন কিছু জানেই না। এ নিয়ে হাওরবাসীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন হলো, মানববন্ধন হলো। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিবেদন হলো। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে অনেকে দাবি করেছেন, বন্যাকবলিত হাওর অঞ্চলকে ‘দুর্গত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণার জন্য। তারপরই যেন ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলেন কর্তাব্যক্তিরা। তারা ভাবলেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে সরেজমিনে উপদ্রুত এলাকায় যাওয়া দরকার। সেই অনুযায়ী ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা চলে গেলেন সুনামগঞ্জে।

সুনামগঞ্জে গিয়ে তারা কতটুকু কি দেখেছেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু দেখাদেখি শেষে যে ব্রিফিংটা করলেন, সেটাই হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী ছিলেন। তবে সচিবই যেন মূল বক্তা, তিনি যা কিছু বললেন তার কোনো তুলনা হয় না। তার সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ যেন ছিল ওই ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণার দাবি নিয়ে। এই সচিব সাহেবের কথাই বলতে শুরু করেছিলাম লেখার একেবারে শুরুতে। ওনার নামই শাহ কামাল।

শাহ কামাল সাহেব বললেন, ‘আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যাবে, যদি সেই এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মরে যায়, এবং দেশে খাদ্য নেই বলে যদি ইউনিসেফ এবং ইউএন ডিক্লেয়ার করে, তাহলে সেই এলাকার প্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবে, ইনকোয়ারি করবে, করে জানাবে, তারপর মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই এলাকাকে দুর্গত এলাকা বলে ঘোষণা করবেন।’ আসলে এই অহেতুক কতগুলো সস্তা কথা বলা, যারা এসব বলে তারা না জেনে বলে, তাদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই।

অর্থাৎ শাহ কামাল সাহেব প্রমাণ করে দিলেন বন্যাউপদ্রুত হাওর অঞ্চলকে কোনোভাবেই ‘দুর্গত এলাকা’ বলার কোনো সুযোগ নেই। ভদ্রলোক আরও কিছু সময় পেলে হয়ত এটাও প্রমাণ করে দিতে পারতেন যে, বন্যা হলেও হাওরের মানুষের কোনো ক্ষতিই হয়নি! তবে সে সুযোগ তিনি পাননি। পাননি আসলে তারই মন্ত্রণালয়ের খোদ মন্ত্রীর কারণে। উনি যখন ওইসব জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন তার পাশেই বসে ছিলেন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি যেন নতুন একটা পয়েন্ট মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘ছাগল মরে নাই!’
এরপর আর কি লাগে। দ্বিগুণ উৎসাহে সচিব সাহেব বলতে লাগবেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো গরু মারা গেছে বা ছাগল মারা গেছে এমন তথ্যও আসে নাই!’

অর্ধেক মানুষ মারা যায় নাই, ছাগল মারা যায় নাই, তাহলে দুর্গত এলাকা কি করে হলো? এর চেয়ে লাগসই প্রশ্ন কেউ কখনো শুনেছেন?
পাদটীকা

সেদিন ফেসবুকে একজনের একটা স্ট্যাটাস দেখলাম। সচিব শাহ কামালের ছাগল-সংক্রান্ত এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘কেন কোনো মৃত ছাগল পাওয়া গেল না?’

জবাবটাও উনি নিজেই দিয়েছেন। ‘আসলে বন্যা শুরুর আগেই সব ছাগল ঢাকায় চলে গিয়েছিল সচিব হওয়ার জন্য, সে কারণেই কোনো মরা ছাগল পাওয়া যায়নি!’