লাল গালিচায় ঢেকে গেছে ঠাকুরগাঁও জেলার সর্বত্র। যেদিকে তাকাই মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে শুধু লাল গালিচার দৃশ্য। মাঠে-ঘাটে ক্ষেতের পাশে যেখানেই ফাঁকা, সেখানেই লাল গালিচা। দেখতে লাল গালিচা মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। ক্ষেতের পাশে কিংবা মিলের চাতালে মরিচ শুকানোর দৃশ্য। এভাবেই চলছে ঠাকুরগাঁওয়ে মরিচ সংগ্রহ ও শুকানোর হিড়িক। বাজারে দাম ভালো, তাই কৃষক কৃষাণীরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ক্ষেত থেকে মরিচ সংগ্রহ আর শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ধান গম পাট ভুট্টা ইত্যাদি চাষ করে যেখানে কৃষকেরা প্রতি বছর লোকসান গুনছেন সেখানে একমাত্র মরিচ চাষ করে লাভের মুখ দেখেছেন। লাল মরিচের রঙের সঙ্গে এবার ঠাকুরগাঁও জেলার কৃষকের ভাগ্যও লাল হয়ে উঠেছে।
চলতি বছর ঠাকুরগাঁও জেলায় ৩২৩ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু চাষীরা লক্ষ্যমাত্রার চাইতে অতিরিক্ত ৩২ হেক্টর জমিতে মরিচ বপন করেন। অর্থাৎ ৩৫৫ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ করা হয়। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চাষ করা জমি থেকে ৫১০ মেট্রিক টন শুকনো মরিচ উৎপাদন হবে যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরে বিক্রি করা হবে।
ঘনিমহেশপুর গ্রামের কৃষক জহির উদ্দীন জানান, ঠাকুরগাঁও জেলার কৃষকেরা ধান গম পাট ভুট্টা ইত্যাদি চাষ করে যেখানে লোকসান গুনছেন সেখানে একমাত্র মরিচ চাষ করে লাভের মুখ দেখেছেন। তাই এ জেলার চাষীরা মরিচ আবাদকে ঘাটতি পূরণের ফসল হিসেবে বিবেচনা করছেন। সেজন্য গাছে থোকায় থোকায় মরিচ পাকায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলছে মরিচ সংগ্রহের প্রাণান্তকর চেষ্টা।
ঘনিমহেশপুর গ্রামের মরিচ চাষী নজিব উদ্দীন জানান, এক বিঘা জমিতে বিন্দু ও বাঁশগাড়া জাতের মরিচ লাগানো, নিরানী, সেচ ও পরিচর্যা থেকে শুরু করে মরিচ সংগ্রহ পর্যন্ত ব্যয় হয় ১৪-১৫ হাজার টাকা। আর ওই জমিতে মরিচ উৎপাদন হচ্ছে কমপক্ষে ১০ মণ। প্রতিমণ মরিচ ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি করে বিঘা প্রতি মুনাফা অর্জন করছেন কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার টাকা।
বর্তমানে প্রতিমণ বাঁশগাড়া তথা বড় আকারের শুকনো মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩২’শ টাকা দরে এবং বিন্দু বা ছোট আকারের মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪২’শ টাকার উপরে। বিন্দু সাইজে ছোট হলেও অতিরিক্ত ঝাল ও রঙ লাল টকটকে হওয়ায় চাহিদা বেশি এবং দামও তাই বেশি।
কৃষক হাসান আলী জানান, এ বছর পোকার আক্রমণের কারণে মরিচের উৎপাদন খানিকটা কমে গেছে। তারপরও বাজারে এ বছর দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে বলে অন্যান্য ফসলের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।
কৃষক আমাতু জানান, গত বছর ১০ কাঠা জমিতে মরিচ চাষ করে লাভ হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। তাই এ বছর ১ বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছেন। তিনি জানান, এবারের মরিচের টাকা দিয়ে তিনি তার একমাত্র কন্যাকে ভালো ঘরে পাত্রস্থ করবেন।
এদিকে ক্ষেত থেকে মরিচ সংগ্রহ কাজে অনেক নারী ও শিশু-কিশোরের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিজন শ্রমিক কমপক্ষে ৫-৬ ঢাকি (ঝুড়ি) মরিচ তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। প্রতি ঢাকি ৪০ টাকা হিসেবে দিনে আয় করছেন কমপক্ষে আড়াইশ টাকা থেকে ৩’শ টাকা। স্কুলের ছেলেমেয়েরাও রোজার ছুটি কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয় করছেন।
এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক কে এম মাওদুদুল ইসলাম জানান, মরিচ মসলা জাতীয় ফসল। মরিচ চাষ করে এ জেলার কৃষকেরা ভালো দাম পাওয়ায় তাদের আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। এ জেলার মাটি বন্যামুক্ত ও উৎপাদিত মরিচ উন্নত মানের হওয়ায় এর চাহিদা সর্বত্র। বিভিন্ন ফসলে লোকসান গুনলেও একমাত্র মরিচ চাষ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন। তাই এ ফসলটি অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জেলার চাষিরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মরিচ জেলার বাইরে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।