ঢাকা , শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মহাখালীতে আবাসিক ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২ ইউনিট ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়সসীমা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আপত্তি বিএনপি মহাসচিবের মাহফিলে গিয়ে নিখোঁজ কৃষকের মরদেহ মিললো আম গাছে নদী বাঁচাতে প্রয়োজনে দু’চারটি ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়া হবে যারা অর্থ নিয়ে দেশ ছেড়েছে তাদের অর্থ ফেরাতে চেষ্টা চলছে: গভর্নর প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির বিচার হবে: উপদেষ্টা ফরিদা আখতার শীতের সবজিতে ভরপুর বাজার, কমেছে দাম ২৫ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে জনপ্রিয় আরজে স্বস্তি ফিরছে পেঁয়াজের বাজারে নান্দাইলে মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণ ও হত্যা আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবারের ক্ষোভ

উন্নয়নের অর্থনীতি ও আমাদের কিশোরগঞ্জ

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জ ঢাকা বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যমন্ডিত জেলা। ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলার অর্থনৈতিক প্রধান ক্ষেত্র কৃষি। হাওর,নদী, চর এবং সমতলের পলিমিশ্রিত মাটিতে উৎপাদিত ধান, প্রাকৃতিক উৎসের মৎস্য সম্পদ, মৎস্য এবং পোল্ট্রি শিল্প দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জেলার অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বিপূলসংখ্যক প্রবাসীর প্রেরিত রেমিটেন্সও। এর বাইরে উল্লেখ করার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে ভৈরবের পাদুকা শিল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। ঢাকার বাইরে জুতা প্রস্তুতের সর্ববৃহৎ এই ক্ষেত্রটি কর্মসংস্থানমুখী এবং ক্রমেই বিনিয়োগের নিরাপদ সম্ভাবনার আধার হয়ে উঠছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এহেন ফিরিস্তি আপাত: স্বস্তিদায়ক হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তির সাথে তুলনায় মোটেও যায় না। কারণ রাজধানী ঢাকা থেকে যৌক্তিক দূরত্বে দেশের দক্ষিণপূর্ব, পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধনের এ অঞ্চলটি উন্নয়ন অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকায় নেই।

এ পরিস্থিতির জন্য জেলায় শিল্পদ্যোগ না থাকাকেই দায়ী করা যায়। শিল্পায়ন না হওয়ায় স্থানীয় কর্মসংস্থান নেই। গড়ে ওঠেনি ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরোয়ার্ড লিংকেজ ব্যবসাও। আমদানী রফতানী বাণিজ্য তো পরের কথা। মজার ব্যাপার হলো, এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা ভাবনাও নেই কারো মাঝে।

অনেকেই যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং ঈদ-পার্বনে মার্কেটের কেনাকাটার ভীড় দিয়ে অর্থনৈতিক চাঙ্গাভাবের দিকে ইঙ্গিত করে থাকেন। কিন্তু তারা বুঝতে চান না যে, শুধু কেনাকাটার অর্থনীতি আর প্রকৃত গতিশীলতা এবং উন্নয়নের অর্থনীতি এক নয়। বরং আমরা যা দেখি তা হলো বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ এলাকার কল কারখানায় কামলা খাটার বিনিময়ে এই অঞ্চলের শ্রমিকদের অর্জিত আয়ের খরচের প্রভাব। এই কেনাকাটার প্রকৃত উপকারভোগী সেই উৎপাদনকারী এবং আমদানীকারকই যার কারখানা/ফ্যাক্টরীতে এসব শ্রমিকরা কাজ করে কিংবা যারা আমদানী করে বাজারজাত করে।

বাস্তবে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হলো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান। অন্যের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে নিজের পরিবার নিয়ে খেয়ে দেয়ে সুখে দিন কাটানো যায় বটে ; তবে জাতীয় উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখা যে যায় না, সে সত্যটাই বুঝতে চান না অনেকে।

কিশোরগঞ্জের সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। আছে সাহিত্য ও  সংস্কৃতির অনন্য গৌরব গাঁথা। মসনদ-ই-আলা  বীর ঈসাখাঁ, প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ জাতীয় অঙ্গণে জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জের সমীহের স্মারক। কিন্তু এত কিছু থাকার পরও অর্থনীতির গতিধারার মূল স্রোতের বাইরেই যেনো কিশোরগঞ্জ। কারণ কর্মসংস্থানমুখী কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই, গর্ব করার মতো কোনো প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডও নেই।

কিশোরগঞ্জে আমার বাড়ি। আমার ব্যাংকিং কর্মজীবনে বর্তমানে  ইসলামী ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনেরর আগেও দু’বার কিশোরগঞ্জ শাখায় কাজ করা সুযোগ হয়েছে। শিল্পসমৃদ্ধ নরসিংদীতে তিন বছর, এশিয়ার ম্যানচেস্টর খ্যাত নরসিংদীর মাধবদী শাখায় আড়াই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় উন্নয়নের অর্থনীতির স্বরূপটা বুঝি বলেই খেয়ে বাঁচার অর্থনীতির সাথে এর পার্থক্যটাও চোখে বাধে। শিল্প, ও আমদানী রফতানী বাণিজ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই নরসিংদী ও মাধবদী দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত।

মাধবদীতে আড়াই বছর কাটিয়ে ২০১০ সাল হতে প্রায় এক দশক ধরে অন্যান্য এলাকায় শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আবার কিশোরগঞ্জ শাখায় বদলী হই ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। নরসিংদীসহ অন্যান্য এলাকার লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে কিশোরগঞ্জে শিল্পদ্যোক্তা তৈরী করা যায় কি না তা নিয়ে আবার কাজ শুরু করি। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই সেরকম সাড়া পাইনি। সবারই কমন বক্তব্য “আমাদের দিয়ে ওসব হবে না”।

যথেষ্ট সামর্থ আছে এমন অনেকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি যে, তারা চান কুইক রিটার্ন। এক হাতে পণ্য কেনাবেচা করবেন  আরেক হাতে লাভের হিসাব করবেন। এর বাইরে টাকা খাটালে না আবার দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত টাকা খোয়া যায়, সেই ভাবনায় তারা সাহস করেন না। এটা এমন এক মানসিক দৈন্যতা যা থেকে কিশোরগঞ্জকে বের করে আনার প্রচেষ্টায় সফল হওয়া কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিগত শতাব্দির আশির দশকে সদর উপজেলার মারিয়া এলাকায় স্থাপিত বিসিক শিল্প নগরী নিয়ে এক সময় জেলার স্বপ্ন ছিলো যে, এটি জেলার অর্থনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। একই সময়ে স্থাপিত আশেপাশের জেলার বিসিকগুলো কর্মচঞ্চলতায় ভরপূর থাকলেও কিশোরগঞ্জের আজও হয়ে উঠেনি। এখানে সে অর্থে শিল্প মানে ছোট বড় কিছু গড়ে না উঠায় এলাকার উন্নয়নের সাথে তাল মেলাতে পারেনি আজও। অমিত সম্ভাবনার মাঝে বাস করেও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে পীড়া দেয়।

অবশ্য এটাও ঠিক যে, কোনো এলাকার ব্যবসায় এবং শিল্পোন্নয়নে স্থানীয়দের খুব বেশি সফল হতে দেখা যায় না। এখানে প্রয়োজন হয় অনুকুল পরিবেশ তৈরী করে বাইরের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ উদ্যোগের আমন্ত্রণ জানানো। এক্ষেত্রেও যেমন কিশোরগঞ্জের ব্যর্থতা আছে, ব্যর্থতা আছে কিশোরগঞ্জ জেলার নাগরিকদের মধ্যে যারা দেশের শিল্পোন্নত এলাকায় উৎপাদন বাণিজ্যে সফল এমন উদ্যোক্তাদের নিজ এলাকায় টানতে না পারাও।

করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময়ে গত ২০ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেয়ার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষি অর্থনীতির বিপূল সম্ভাবনাময় কিশোরগঞ্জের উদ্যোগ উন্নয়নের এ ব্যর্থতার কথা  উল্লেখ করেন ঈষৎ রসিকতায়। তিনি বলেন, ”—-কিশোরগঞ্জের মানুষ কিশোররই থেকে গেছে। তারা চিন্তাই করে নাই যে, (আধুনিক) রাইস মিল লাগবে—–” ইত্যাদি।

আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের শুরুতে ভিডিও কনফারেন্সে কিশোরগঞ্জ প্রান্তে উপস্থিতদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখেন, কিশোরগঞ্জে এতো ধান হয়? অথচ সেখানে বোধ হয় কোনো  রাইস মিল নাই! আধুনিক রাইস মিল বোধহয় কেউ করেনি? করা আছে? কারো আছে ওখানে রাইস মিল! এর জবাবে জেলা প্রশাসক এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একযোগে বলেন, না স্যার—না আপা । (কথাবার্তার এক পর্যায়ে) প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে তা না, আসলে সেটা না। ওই কিশোরগঞ্জের মানুষ কিশোরই থেকে গেছে। তারা চিন্তাই করে নাই, যে, একটা রাইস মিল লাগবে? বা কিছু লাগবে? ——তারপরে হাওরে মাছ ওঠে, তার জন্য হ্যাচারি তৈরি করা অর্থ্যাৎ মাছ ধরে রাখা, একটা বরফকল ছিল না তো। আমি এইজন্য বললাম, কিশোরগঞ্জ একদিকে কিশোর থেকে গেছে। আবার ওদিক থেকে দেখা গেল, কিশোরগঞ্জ তো রাষ্ট্রপতির জেলা………..।

আসলে বাস্তবতাও এমন যে, কিশোরগঞ্জের উৎপাদিত ধান যায় নিকট এবং দূরবর্তি অন্যান্য জেলায়। সেসব জায়গায় আধুনিক রাইস মিলে তৈরী চাল নানা নাম ব্র্যান্ডের ব্যাগে করে আবার কিশোরগঞ্জের বাজারে আসে। অথচ বাজার থেকে কিনে চাল খাওয়াদের কেউই ভাবেই না যে, নিজদের মাঠের ধান দিয়ে আরো কম খরচে চাল উৎপাদন করে সারা দেশের বাজার দখল করে নিজেদের পক্ষে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।

লেখক: কবি , প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

মহাখালীতে আবাসিক ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২ ইউনিট

উন্নয়নের অর্থনীতি ও আমাদের কিশোরগঞ্জ

আপডেট টাইম : ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জ ঢাকা বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যমন্ডিত জেলা। ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলার অর্থনৈতিক প্রধান ক্ষেত্র কৃষি। হাওর,নদী, চর এবং সমতলের পলিমিশ্রিত মাটিতে উৎপাদিত ধান, প্রাকৃতিক উৎসের মৎস্য সম্পদ, মৎস্য এবং পোল্ট্রি শিল্প দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জেলার অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বিপূলসংখ্যক প্রবাসীর প্রেরিত রেমিটেন্সও। এর বাইরে উল্লেখ করার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে ভৈরবের পাদুকা শিল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। ঢাকার বাইরে জুতা প্রস্তুতের সর্ববৃহৎ এই ক্ষেত্রটি কর্মসংস্থানমুখী এবং ক্রমেই বিনিয়োগের নিরাপদ সম্ভাবনার আধার হয়ে উঠছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এহেন ফিরিস্তি আপাত: স্বস্তিদায়ক হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তির সাথে তুলনায় মোটেও যায় না। কারণ রাজধানী ঢাকা থেকে যৌক্তিক দূরত্বে দেশের দক্ষিণপূর্ব, পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের সেতুবন্ধনের এ অঞ্চলটি উন্নয়ন অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকায় নেই।

এ পরিস্থিতির জন্য জেলায় শিল্পদ্যোগ না থাকাকেই দায়ী করা যায়। শিল্পায়ন না হওয়ায় স্থানীয় কর্মসংস্থান নেই। গড়ে ওঠেনি ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরোয়ার্ড লিংকেজ ব্যবসাও। আমদানী রফতানী বাণিজ্য তো পরের কথা। মজার ব্যাপার হলো, এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা ভাবনাও নেই কারো মাঝে।

অনেকেই যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং ঈদ-পার্বনে মার্কেটের কেনাকাটার ভীড় দিয়ে অর্থনৈতিক চাঙ্গাভাবের দিকে ইঙ্গিত করে থাকেন। কিন্তু তারা বুঝতে চান না যে, শুধু কেনাকাটার অর্থনীতি আর প্রকৃত গতিশীলতা এবং উন্নয়নের অর্থনীতি এক নয়। বরং আমরা যা দেখি তা হলো বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ এলাকার কল কারখানায় কামলা খাটার বিনিময়ে এই অঞ্চলের শ্রমিকদের অর্জিত আয়ের খরচের প্রভাব। এই কেনাকাটার প্রকৃত উপকারভোগী সেই উৎপাদনকারী এবং আমদানীকারকই যার কারখানা/ফ্যাক্টরীতে এসব শ্রমিকরা কাজ করে কিংবা যারা আমদানী করে বাজারজাত করে।

বাস্তবে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হলো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান। অন্যের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে নিজের পরিবার নিয়ে খেয়ে দেয়ে সুখে দিন কাটানো যায় বটে ; তবে জাতীয় উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখা যে যায় না, সে সত্যটাই বুঝতে চান না অনেকে।

কিশোরগঞ্জের সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। আছে সাহিত্য ও  সংস্কৃতির অনন্য গৌরব গাঁথা। মসনদ-ই-আলা  বীর ঈসাখাঁ, প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ জাতীয় অঙ্গণে জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জের সমীহের স্মারক। কিন্তু এত কিছু থাকার পরও অর্থনীতির গতিধারার মূল স্রোতের বাইরেই যেনো কিশোরগঞ্জ। কারণ কর্মসংস্থানমুখী কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই, গর্ব করার মতো কোনো প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডও নেই।

কিশোরগঞ্জে আমার বাড়ি। আমার ব্যাংকিং কর্মজীবনে বর্তমানে  ইসলামী ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনেরর আগেও দু’বার কিশোরগঞ্জ শাখায় কাজ করা সুযোগ হয়েছে। শিল্পসমৃদ্ধ নরসিংদীতে তিন বছর, এশিয়ার ম্যানচেস্টর খ্যাত নরসিংদীর মাধবদী শাখায় আড়াই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় উন্নয়নের অর্থনীতির স্বরূপটা বুঝি বলেই খেয়ে বাঁচার অর্থনীতির সাথে এর পার্থক্যটাও চোখে বাধে। শিল্প, ও আমদানী রফতানী বাণিজ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই নরসিংদী ও মাধবদী দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত।

মাধবদীতে আড়াই বছর কাটিয়ে ২০১০ সাল হতে প্রায় এক দশক ধরে অন্যান্য এলাকায় শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আবার কিশোরগঞ্জ শাখায় বদলী হই ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। নরসিংদীসহ অন্যান্য এলাকার লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে কিশোরগঞ্জে শিল্পদ্যোক্তা তৈরী করা যায় কি না তা নিয়ে আবার কাজ শুরু করি। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই সেরকম সাড়া পাইনি। সবারই কমন বক্তব্য “আমাদের দিয়ে ওসব হবে না”।

যথেষ্ট সামর্থ আছে এমন অনেকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি যে, তারা চান কুইক রিটার্ন। এক হাতে পণ্য কেনাবেচা করবেন  আরেক হাতে লাভের হিসাব করবেন। এর বাইরে টাকা খাটালে না আবার দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত টাকা খোয়া যায়, সেই ভাবনায় তারা সাহস করেন না। এটা এমন এক মানসিক দৈন্যতা যা থেকে কিশোরগঞ্জকে বের করে আনার প্রচেষ্টায় সফল হওয়া কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিগত শতাব্দির আশির দশকে সদর উপজেলার মারিয়া এলাকায় স্থাপিত বিসিক শিল্প নগরী নিয়ে এক সময় জেলার স্বপ্ন ছিলো যে, এটি জেলার অর্থনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। একই সময়ে স্থাপিত আশেপাশের জেলার বিসিকগুলো কর্মচঞ্চলতায় ভরপূর থাকলেও কিশোরগঞ্জের আজও হয়ে উঠেনি। এখানে সে অর্থে শিল্প মানে ছোট বড় কিছু গড়ে না উঠায় এলাকার উন্নয়নের সাথে তাল মেলাতে পারেনি আজও। অমিত সম্ভাবনার মাঝে বাস করেও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে পীড়া দেয়।

অবশ্য এটাও ঠিক যে, কোনো এলাকার ব্যবসায় এবং শিল্পোন্নয়নে স্থানীয়দের খুব বেশি সফল হতে দেখা যায় না। এখানে প্রয়োজন হয় অনুকুল পরিবেশ তৈরী করে বাইরের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ উদ্যোগের আমন্ত্রণ জানানো। এক্ষেত্রেও যেমন কিশোরগঞ্জের ব্যর্থতা আছে, ব্যর্থতা আছে কিশোরগঞ্জ জেলার নাগরিকদের মধ্যে যারা দেশের শিল্পোন্নত এলাকায় উৎপাদন বাণিজ্যে সফল এমন উদ্যোক্তাদের নিজ এলাকায় টানতে না পারাও।

করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময়ে গত ২০ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেয়ার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষি অর্থনীতির বিপূল সম্ভাবনাময় কিশোরগঞ্জের উদ্যোগ উন্নয়নের এ ব্যর্থতার কথা  উল্লেখ করেন ঈষৎ রসিকতায়। তিনি বলেন, ”—-কিশোরগঞ্জের মানুষ কিশোররই থেকে গেছে। তারা চিন্তাই করে নাই যে, (আধুনিক) রাইস মিল লাগবে—–” ইত্যাদি।

আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের শুরুতে ভিডিও কনফারেন্সে কিশোরগঞ্জ প্রান্তে উপস্থিতদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখেন, কিশোরগঞ্জে এতো ধান হয়? অথচ সেখানে বোধ হয় কোনো  রাইস মিল নাই! আধুনিক রাইস মিল বোধহয় কেউ করেনি? করা আছে? কারো আছে ওখানে রাইস মিল! এর জবাবে জেলা প্রশাসক এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একযোগে বলেন, না স্যার—না আপা । (কথাবার্তার এক পর্যায়ে) প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে তা না, আসলে সেটা না। ওই কিশোরগঞ্জের মানুষ কিশোরই থেকে গেছে। তারা চিন্তাই করে নাই, যে, একটা রাইস মিল লাগবে? বা কিছু লাগবে? ——তারপরে হাওরে মাছ ওঠে, তার জন্য হ্যাচারি তৈরি করা অর্থ্যাৎ মাছ ধরে রাখা, একটা বরফকল ছিল না তো। আমি এইজন্য বললাম, কিশোরগঞ্জ একদিকে কিশোর থেকে গেছে। আবার ওদিক থেকে দেখা গেল, কিশোরগঞ্জ তো রাষ্ট্রপতির জেলা………..।

আসলে বাস্তবতাও এমন যে, কিশোরগঞ্জের উৎপাদিত ধান যায় নিকট এবং দূরবর্তি অন্যান্য জেলায়। সেসব জায়গায় আধুনিক রাইস মিলে তৈরী চাল নানা নাম ব্র্যান্ডের ব্যাগে করে আবার কিশোরগঞ্জের বাজারে আসে। অথচ বাজার থেকে কিনে চাল খাওয়াদের কেউই ভাবেই না যে, নিজদের মাঠের ধান দিয়ে আরো কম খরচে চাল উৎপাদন করে সারা দেশের বাজার দখল করে নিজেদের পক্ষে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।

লেখক: কবি , প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।