ঢাকা , বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাজেটের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করছেন। এই বাজেট বাস্তবায়নে প্রায় লাখ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে নতুন বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ধার করতে হবে সরকারকে। কেউ কেউ বলছেন এত বড় বাজেট উচ্চাভিলাসী। আবার কেউ কেউ এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলেও তা পূরণের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নতুন বাজেট নিয়ে পূর্বপশ্চিমের পক্ষ থেকে কথা হয়েছে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও আমলাদের সঙ্গে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষনের চেয়ারপারসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, “বাজেট নিয়ে সাধারণত তিনটি প্রশ্ন উদয় হয়। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কতটুকু সক্ষম, দেশের রাজস্ব নীতি- বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙা করতে পারবে কিনা এবং এই বাজেটের কর্মসংস্থান কতটুকু বাড়বে।”

তিনি বলেন, “এই বাজেটকে অনেককেই অবাস্তব বলছেন। কারণ এটা বাস্তবায়নে বেশকিছু সমস্যা আছে। দেশজ উৎপাদন কম, কর কাঠামো প্রগতিশীল নয়। আবার দেশে দুটো কর ব্যবস্থা আছে; আয়কর ও মূসক। মূসক সবচে বড় খাত। এটা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তন হয়না। আয়ের অনুপাতের সঙ্গে মিল নেই। সবাইকে একই পরিমাণ দিতে হয়। আবার দেশে করফাঁকি একটা বড় সমস্যা। বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রদেয় কর সঠিকভাবে আদায় হয়না। এইসব যদি ঠিকভাবে সরকার করতে পারে তবে সঠিকভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।”

তিতুমীর আরও বলেন, “বাংলাদেশে তিনটি কাঠামোগত সমস্যা রয়েই গেছে। সব সময় আমাদের অর্থনীতিতে বৈষম্য বিরাজ করছিল। এটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জোরজবরদস্তি করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে। আগেও ছিল, এখনো আছে, বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো নীতি নির্ধারণগত। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, এ দেশের নীতিনির্ধারকরা সে হারে এগোতে পারেননি। যার প্রভাবে এইবারও পড়বে।”

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “দেশ সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্র ভাল। বলা যেতে পারে ইতিবাচক। তবে বিনিয়োগটা সেরকম হচ্ছে না, স্থবিরতা আছে মেনে নিতে হবে। বিনিয়োগের মধ্যে ব্যক্তি বিনিয়োগটাই প্রধান। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ৩৫ শতাংশ জিডিপি অর্জন করতে হবে। বিদ্যুৎ পুরোপুরি আমরা শিল্পে ব্যবহার করতে পারছি না। ফলে উপাদন সেই হারে দিতে পারছি না। ইকোনমিক জোন হলে বিনিয়োগ বাড়বে সন্দেহ নাই। তবে সেই রকম পরিবেশ তৈরী করতে হবে। তবে আমি মনে করি, উৎপাদনের জন্য ইলেক্ট্রসিটির উৎপাদন আরও বাড়ানো জরুরি। এফিসিয়েন্ট ইলেক্ট্রিসিটি নাই। বিকল্প জ্বালানি তৈরী করতে সরকারের অনেক সময় লেগে যাবে। ফলে কেউ ব্যবসা শুরু করল আর কিছুদিন চলে জ্বালানি সংকটে পড়লে তো বিনিয়োগই আটকে যাবে। এতে করে সামনের দিনে দেশের অর্থনীতি আরও বিপদে পড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে অদূরদর্শী নীতির কারণে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে। অর্থনীতির অনেক অপ্রয়োজনীয় জায়গায় ভর্তুকির নামে অর্থের অপচয় হচ্ছে। কুইক রেন্টালে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংক ঋণ বাড়ছে এবং ঋণ বাবদ অনেক টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ কমে আসছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। এতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে সরকারকে নতুন করে নজর দিতে হবে।”

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, শিক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের এডুকেশন সিস্টেম এখনও দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যাপ্ত দক্ষ লোক দিতে পারছে না। এটা যদি সরকারি পরিকল্পনামাফিক করতে পারে, দেশ লাভবান হবে। মার্কেটের চাহিদাটা আমাকে বুঝতে হবে। মার্কেট কি চায়। এছাড়া ভবিষ্যত নিয়েও ভাবতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে।

সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বাজেটের আকার নিয়ে দ্বিমত নেই। উচ্চভিলাসী বাজেটও বলা যাবে। আমরা আয় করতে পারব না। যদি করতে পারিও, ব্যায় করতে পারি না। রেমিট্যান্সের দিকে সরকারের নজর বাড়ানো খুব জরুরী। সবচে বড় প্রশ্ন সক্ষমতার। দেশে খরচ বেশি। অবশ্যই উচ্চভিলাসী। প্রকৃতপক্ষে যদি ধরি, তবে ৮০ শতাংশের বেশি অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে। সরকার বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অনেক বছর লাগে। ব্যায় বাড়ে। এই মুহূর্তে এডিপি নাও থাকে দেশের কিছু হবে না। কিন্তু ব্যক্তিখাত বন্ধ করা হলে অর্থনীতি বিপদে পড়বে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

বাজেটের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

আপডেট টাইম : ০৬:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জুন ২০১৬

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করছেন। এই বাজেট বাস্তবায়নে প্রায় লাখ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে নতুন বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ধার করতে হবে সরকারকে। কেউ কেউ বলছেন এত বড় বাজেট উচ্চাভিলাসী। আবার কেউ কেউ এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলেও তা পূরণের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নতুন বাজেট নিয়ে পূর্বপশ্চিমের পক্ষ থেকে কথা হয়েছে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও আমলাদের সঙ্গে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষনের চেয়ারপারসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, “বাজেট নিয়ে সাধারণত তিনটি প্রশ্ন উদয় হয়। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কতটুকু সক্ষম, দেশের রাজস্ব নীতি- বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙা করতে পারবে কিনা এবং এই বাজেটের কর্মসংস্থান কতটুকু বাড়বে।”

তিনি বলেন, “এই বাজেটকে অনেককেই অবাস্তব বলছেন। কারণ এটা বাস্তবায়নে বেশকিছু সমস্যা আছে। দেশজ উৎপাদন কম, কর কাঠামো প্রগতিশীল নয়। আবার দেশে দুটো কর ব্যবস্থা আছে; আয়কর ও মূসক। মূসক সবচে বড় খাত। এটা ব্যক্তিভেদে পরিবর্তন হয়না। আয়ের অনুপাতের সঙ্গে মিল নেই। সবাইকে একই পরিমাণ দিতে হয়। আবার দেশে করফাঁকি একটা বড় সমস্যা। বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রদেয় কর সঠিকভাবে আদায় হয়না। এইসব যদি ঠিকভাবে সরকার করতে পারে তবে সঠিকভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।”

তিতুমীর আরও বলেন, “বাংলাদেশে তিনটি কাঠামোগত সমস্যা রয়েই গেছে। সব সময় আমাদের অর্থনীতিতে বৈষম্য বিরাজ করছিল। এটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জোরজবরদস্তি করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে। আগেও ছিল, এখনো আছে, বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো নীতি নির্ধারণগত। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, এ দেশের নীতিনির্ধারকরা সে হারে এগোতে পারেননি। যার প্রভাবে এইবারও পড়বে।”

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “দেশ সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্র ভাল। বলা যেতে পারে ইতিবাচক। তবে বিনিয়োগটা সেরকম হচ্ছে না, স্থবিরতা আছে মেনে নিতে হবে। বিনিয়োগের মধ্যে ব্যক্তি বিনিয়োগটাই প্রধান। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ৩৫ শতাংশ জিডিপি অর্জন করতে হবে। বিদ্যুৎ পুরোপুরি আমরা শিল্পে ব্যবহার করতে পারছি না। ফলে উপাদন সেই হারে দিতে পারছি না। ইকোনমিক জোন হলে বিনিয়োগ বাড়বে সন্দেহ নাই। তবে সেই রকম পরিবেশ তৈরী করতে হবে। তবে আমি মনে করি, উৎপাদনের জন্য ইলেক্ট্রসিটির উৎপাদন আরও বাড়ানো জরুরি। এফিসিয়েন্ট ইলেক্ট্রিসিটি নাই। বিকল্প জ্বালানি তৈরী করতে সরকারের অনেক সময় লেগে যাবে। ফলে কেউ ব্যবসা শুরু করল আর কিছুদিন চলে জ্বালানি সংকটে পড়লে তো বিনিয়োগই আটকে যাবে। এতে করে সামনের দিনে দেশের অর্থনীতি আরও বিপদে পড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে অদূরদর্শী নীতির কারণে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে। অর্থনীতির অনেক অপ্রয়োজনীয় জায়গায় ভর্তুকির নামে অর্থের অপচয় হচ্ছে। কুইক রেন্টালে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংক ঋণ বাড়ছে এবং ঋণ বাবদ অনেক টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ কমে আসছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। এতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে সরকারকে নতুন করে নজর দিতে হবে।”

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, শিক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের এডুকেশন সিস্টেম এখনও দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যাপ্ত দক্ষ লোক দিতে পারছে না। এটা যদি সরকারি পরিকল্পনামাফিক করতে পারে, দেশ লাভবান হবে। মার্কেটের চাহিদাটা আমাকে বুঝতে হবে। মার্কেট কি চায়। এছাড়া ভবিষ্যত নিয়েও ভাবতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে।

সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বাজেটের আকার নিয়ে দ্বিমত নেই। উচ্চভিলাসী বাজেটও বলা যাবে। আমরা আয় করতে পারব না। যদি করতে পারিও, ব্যায় করতে পারি না। রেমিট্যান্সের দিকে সরকারের নজর বাড়ানো খুব জরুরী। সবচে বড় প্রশ্ন সক্ষমতার। দেশে খরচ বেশি। অবশ্যই উচ্চভিলাসী। প্রকৃতপক্ষে যদি ধরি, তবে ৮০ শতাংশের বেশি অর্জন করা কঠিন হয়ে যাবে। সরকার বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অনেক বছর লাগে। ব্যায় বাড়ে। এই মুহূর্তে এডিপি নাও থাকে দেশের কিছু হবে না। কিন্তু ব্যক্তিখাত বন্ধ করা হলে অর্থনীতি বিপদে পড়বে।