ঢাকা: কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়া নিয়ে ব্যবসা চলছে রমরমা। খোদ কারারক্ষীরা বড়কর্তাদের নামে চালিয়ে যাচ্ছে ঘুষ বাণিজ্য। মোটা অংকের টাকা দিলে ডেঞ্জার সেলের আসামিদের সঙ্গেও ‘ভিআইপি’ সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি কমবেশি সবাই শুনে থাকলেও বাংলামেইলের গোপন ক্যামেরায় একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়লো এমন দৃশ্য। কিন্তু এই বাণিজ্য যে কতো ধরনের হুমকি ডেকে আনতে পারে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ একেবারেই উদাসীন।
বুধবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে গিয়ে এমন ঘুষ বাণিজ্যের দৃশ্য দেখা গেল। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে কারাগারের অনুসন্ধান কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, জসিম নামের এক কারারক্ষী আসামির স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। বিনিময়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে লেখা একটি স্লিপ। ওই স্লিপ কারাগারের মূল ফটকে দেখালেই ‘ভিআইপি’ভাবে আসামির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ মিলবে।
কিছুক্ষণ ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে অনুসন্ধান কক্ষে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে ওই কারারক্ষী সামনে এসে জানতে চান কোনো আসামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি কি না। জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি বললেন, ‘এক হাজার টাকা দেন। ভিআইপিভাবে দেখা করার সুযোগ করে দিব।’
এটা কী বৈধ? এমন প্রশ্নে কারারক্ষী জসিম বলেন, সরকারি সিস্টেমে দেখা করতে গেলে আসামির দেখা পাবেন না। দেখা পাবেন শুধু তার ছায়ার! আর আমাদের এই সিস্টেমে গেলে তার সাথে ভিআইপিভাবে দেখা করে আসতে পারবেন।
কিন্তু এতো টাকা কেন? জানতে চাইলে জসিম শুনালেন চমকে ওঠার মতো তথ্য। ওই কারারক্ষী বলেন, ‘এই টাকার ভাগ সবাইরে দেওয়া লাগে। আমি পামু ৫০ টাকা। বাকি টাকা বল্টু পাবে।’ বল্টু কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বল্টু হচ্ছে বড় কর্মকর্তারা। তাদের সবাইরে টাকা দেয়া লাগে।
তবে জেলগেটে প্রায় সব কারারক্ষীই এই কাজ করেন। এমনকি তাদের কাজটা আরো সহজ করে দিতে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে তৈরি হয়েছে দালাল চক্রও। সব সাক্ষাৎপ্রার্থীকে তারা আগে থেকেই এ প্রক্রিয়ার সুবিধা বুঝিয় রাজি করানো চেষ্টা করছে। তবে সরাসরি কারারক্ষীদের মাধ্যমে গেলে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা, আর দালাল মারফত গেলে খরচ পড়ে ১১শ টাকা।
অনুসন্ধান কক্ষের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, বেশিরভাগ কারারক্ষীই সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে দর কষাকষি নিয়ে ব্যস্ত। এসময় বেশ কয়েকজন সাক্ষাৎপ্রার্থী অভিযোগ করেন, যাদের টাকা আছে তারা না হয় এভাবে সাক্ষাৎ করতে পারে। কিন্তু যাদের সেই সামর্থ্য নেই তারা শুধু দূর থেকে ‘ছায়া’ দেখে চলে যাবে?
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এভাবে প্রতিদিন অন্তত এক থেকে দেড়শ জন সাক্ষাৎপ্রার্থীকে কারারক্ষীরা তল্লাশি ছাড়াই ভেতরে নিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন লাখ টাকার বাণিজ্য হয়।
সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন জামাল উদ্দিন নামের এক বৃদ্ধ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এর আগে একদিন সরকারি টিকিট কেটে (১০ টাকায়) জেলগেটে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু ভালোমত কথা বলাতো দূরের কথা, পোলাডারে দেখতেও পাইনি। কিন্তু কারারক্ষীগো এক হাজার টাকা দিলে এহেন কাজ নাই যা জেলগেটে হয় না! ভিআইপি সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে ভেতরে নেশার জিনিসও দেয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কারগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি অসুস্থতার কারণে জেলের বাইরে আছি। আসার পর আপনি দেখিয়ে দেবেন সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে কারাগারে থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, কারাগারে থাকা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নির্দেশনায় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) পুনরায় সংগঠিত ও সক্রিয় হয়েছে। এসব নেতা কারাগার থেকে নিয়মিত মুঠোফোন ও চিঠিসহ নানা মাধ্যমে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং দল পরিচালনা করছেন।
সম্প্রতি এক ছাত্রলীগ নেতা কারাগারে থেকে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।