ঢাকা , শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্দেশদাতাকে নিয়ে লুকোচুরি

চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতাকে নিয়ে চলছে লুকোচুরি। খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তি দিলেও কার নির্দেশে তারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছেন তা বলেননি। এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে তাদের দেওয়া জবানবন্দিও প্রকাশ করা হচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অকারণে ওয়াসিম ও আনোয়ার খুন করেননি এসপির স্ত্রী মিতুকে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভাড়াটে হিসেবে তারা কাজটি করেছেন। কার নির্দেশে মিতুকে খুন করা হলো, কেন করা হলো— তা না জানালে ভবিষ্যতে আইনের শাসন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসপি বাবুল আক্তারকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, খোদ পুলিশ প্রশাসনেও নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। কোনো মামলার বাদীকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে নিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ নজিরবিহীন। এই দীর্ঘ সময় তিনি কী জবানবন্দি দিয়েছেন, তার মুখোমুখি অপরাধীরা কী বয়ান দিয়েছেন, তাও প্রকাশ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মিতু হত্যার নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ না হলে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তিই প্রশ্নের মুখে পড়বে। অন্যদিকে এ ধরনের অপরাধপ্রবনতা আরো বাড়তে থাকবে। এসপি বাবুল আক্তারকেও কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে। তাই, সত্য যত কঠিনই হোক, পুলিশকেই তা তুলে ধরতে হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিতু খুনের মতো স্পর্শকাতর ঘটনা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অপরাধীরা ধরাও পড়েছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু নির্দেশদাতা কে, তা নিয়ে লুকোচুরি চলছে। এটা কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, এখন ফেসবুক, টুইটারের যুগ। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কে নির্দেশদাতা তাও বেরিয়ে আসবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, চার নেতা হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধেরও বিচার হচ্ছে। সুতরাং একটু দেরি হলেও এ খুনের নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। নইলে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার অবশ্য বলেন, ‘খুনে অংশ নেওয়া আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা পেশাদার অপরাধী। কার নির্দেশে তারা খুনে অংশ নিয়েছিলেন তা বলা যাচ্ছে না। সম্ভাব্য সব বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। হত্যাকাণ্ডে সাত-আট জন অংশ নেন। বাকি আসামিদেরও শনাক্ত করা গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’

সিএমপির কমিশনার আরও জানান, ‘মিতু হত্যাকাণ্ড টার্গেট কিলিং। কারা, কেন করিয়েছেন, তাও বলা যাচ্ছে না। নিশ্চিত না হয়ে বলা যাচ্ছে না জঙ্গি, চোরাকারবারি কিংবা বিরোধী কোনো গোষ্ঠী এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা।’ কেন, কার নির্দেশে পেশাদার অপরাধীরা মিতুকে খুন করেছেন— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ হলেই বলতে পারব।’

গত ৫ জুন নগরীর জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটন এবং আসামিদের গ্রেফতারে কাজ শুরু করেছে ডিবি, র?্যাব, সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিআই)সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য সংস্থাগুলো।

এরপর গত শুক্রবার গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুলকে। বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে তিনি কাউকে দেখা দিচ্ছেন না। কারও সঙ্গে কথাও বলছেন না। বাড়িতে দিনরাত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। শ্বশুরই সর্বক্ষণ সঙ্গ দিচ্ছেন জামাতাকে। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই বাবুল আক্তারের কথা বলা মানা বলেও জানিয়েছেন তার শ্বশুর। তবে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়েও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের রাখঢাকের মধ্যে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যাদের ধরেছি, তাদের সঙ্গে বাবুল আক্তারের কথা বলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কেন খুন করেছেন, সেজন্য…।’ রাতের বেলায় নিয়ে ১৫ ঘণ্টা কেন রাখা হয়েছিল— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সন্দেহভাজন ধরলে তা আসলে সঠিক ধরেছি কিনা সেজন্য বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল।’

মিতু খুন হওয়ার পর বাবুল আক্তার থাকছেন তার শ্বশুরালয়ে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ভূইয়াপাড়ার ২২০/এ নম্বর বাড়িতে বাস করেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। গতকাল দুপুরে গিয়ে বাবুল আক্তারের দেখা মেলেনি। তবে তার শ্বশুরের বাড়ির বাইরে পুলিশের পাহারা দেখা গেছে। বাবুল আক্তার অনেকটা অসহায় ও নার্ভাস হয়ে পড়েছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছেন না। বাইরেও খুব একটা বেরোচ্ছেন না। তবে মাঝেমধ্যে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসক দেখাচ্ছেন। তার মাইগ্রেনের সমস্যাও রয়েছে। বাইরে গেলেও পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে যাচ্ছেন। তার চিকিৎসক এস আই মল্লিক। শনিবারও হাসপাতালে যান বাবুল আক্তার। সঙ্গে নিয়ে যান তার সন্তানদেরও। ওই ঘটনার পর থেকে দুই সন্তান মানসিক চাপে পড়েছে। এ কারণেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।

বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘মিতুর দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির (৮) ও তাবাসসুম তাজমিন টাপুরও (৫) অনেকটা নার্ভাস। তারাও মানসিক চাপে আছে। সন্তানদের মানসিক চিকিৎসক দেখানো হচ্ছে। দুই সন্তানকে সামলাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। তারা বার বার মায়ের কথা বলে। মায়ের কাছে যেতে চায়। আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। খাবারও খেতে চায় না। জোর করে খাবার খাওয়ানো হয়। শারীরিকভাবেও মাহির ও টাপুর দুর্বল হয়ে পড়েছে।’

পরিবারের এক সদস্য জানান, মাহির ও টাপুরকে দেখাশোনা করছেন তার নানি, খালা ডা. শায়লা মোশাররফ ও বাবুল আক্তার নিজে। দোতলা ওই বাড়িতে ছয়টি রুম। বাবুল আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে দোতলায় থাকছেন। তারা মাকে খুঁজতে রুমে রুমে গিয়ে উঁকি দেয়। মাকে না পেয়ে চিৎকারও করে। কিন্তু ২২ দিন ধরেও মায়ের দেখা না পেয়ে তারা মা মা বলে ডাকে। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই।

মাহির ও টাপুরের ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এবার আমাদের ঈদ হবে না। কোনো শপিংও করা হয়নি। করার ইচ্ছাও নেই। তবে মিতু মারা যাওয়ার আগে কাজের মেয়ে ও দুই সন্তানের জন্য কাপড় কিনে সেলাই করতে দিয়েছিল। সেগুলো মিতু আনতে পারেনি। মিতু হত্যার নেপথ্য যারা রয়েছে, তাদের বিচার দাবি করছি। তবে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে।’

ঘটনার দিন থেকেই মোশাররফ হোসেনের বাসার সামনে পুলিশ প্রটেকশন থাকছে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কে কোন ধরনের মন্তব্য করছেন তা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। পারিবারিক কোনো সমস্যা ছিল না। অন্য বিষয়ে বলতে পারছি না।’

জানা গেছে, বাবুল ও মিতু দম্পতির দুই সন্তান মাহির ও টাপুরকে বিনোদনের মাধ্যমে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন স্বজনরা। তারা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস খেলছে। টেলিভিশনে কার্টুন দেখানো হচ্ছে। পছন্দের খাবার দেওয়া হচ্ছে। তাদের হাসিখুশি রাখতে সর্বদা চেষ্টা করছেন স্বজনরা।

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার নির্দেশদাতা কে— তা নিয়ে চট্টগ্রামেও চলছে ধূম্রজাল। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, গ্রেফতার আসামিরা মিতু হত্যায় কে নির্দেশ দিয়েছেন— জিজ্ঞাসাবাদে তা বলেছেন। কিন্তু মামলার তদন্তের স্বার্থে ‘ওই নির্দেশদাতা’র নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে নির্দেশদাতা ও তার এক ঘনিষ্ঠজনের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাদের নাম প্রকাশ হলে ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে একটি বাহিনী। তাই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে মিতু খুনের নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করছে না পুলিশ।

মিতু খুনের নির্দেশদাতা কে— এমন প্রশ্নের জবাবে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) দেবদাস ভট্টাচার্য্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসিম ও আনোয়ার এসপির স্ত্রী মিতু খুনের নির্দেশদাতার নাম বলেছেন। হয়তো ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও ওই নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করেছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এখনো হাতে পাইনি। হাতে পেলে বলতে পারব, নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করেছেন কিনা।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এখনো মামলার তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ হলেই নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করা হবে।’

সিএমপি সূত্র জানায়, মিতু কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী সাত পেশাদার অপরাধী, প্রভাবশালী একজন নির্দেশদাতা ও তার এক ঘনিষ্ঠজনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সাত সদস্য হলেন— আবু মুছা সিকদার, আনোয়ার হোসেন, মো. ওয়াসিম, মো. রাশেদ ওরফে ভাগ্নে রাশেদ, আবদুল নবী, মোহাম্মদ শাহজাহান ও এহতেশাম হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলা। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া মুছা, আনোয়ার, শাহজাহান, ওয়াসিম ও ভাগ্নে রাশেদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। তারা প্রত্যেকেই একসময় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে দলবদল করেন। তবে তারা সবাই পেশাদার অপরাধী। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ একাধিক মামলা ছিল। এ ছাড়া মুছা, আনোয়ার, ওয়াসিম পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। ভোলাও একজন পেশাদার অপরাধী। তবে তিনি মিতু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি। তিনি হত্যাকারীদের অস্ত্র ভাড়া দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। মুছার সঙ্গে তার ব্যবসা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মিতুকে খুনের পর মুছা, নবী ও ওয়াসিম মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। মুছা মোটরসাইকেল চালান, মাঝে বসা ছিলেন নবী আর সবার পেছনে ছিলেন ওয়াসিম। বাকিরা ব্যাকআপ টিম হিসেবে ছিলেন। মোটরসাইকেলটি তারা বড়গ্যারেজ এলাকায় রেখে পালিয়ে যান। খুনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী নবী ও ওয়াসিম কাকে খুন করেছেন তা জানতেন না। তারা মিতুকে ‘জঙ্গিনেত্রী’ হিসেবে জানতেন। খুনের পর গণমাধ্যমের খবর দেখে তারা নিশ্চিত হন খুন করা নারী হচ্ছেন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিতু খুনের নির্দেশদাতা কোনো অপরাধী বা উগ্রবাদী গোষ্ঠী হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সাত অপরাধীই মিতু হত্যার পরিকল্পনা করেন। নির্দেশদাতা কে, তাও নিশ্চিত হওয়া গেছে।’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

নির্দেশদাতাকে নিয়ে লুকোচুরি

আপডেট টাইম : ০৬:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুন ২০১৬

চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতাকে নিয়ে চলছে লুকোচুরি। খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তি দিলেও কার নির্দেশে তারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছেন তা বলেননি। এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে তাদের দেওয়া জবানবন্দিও প্রকাশ করা হচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অকারণে ওয়াসিম ও আনোয়ার খুন করেননি এসপির স্ত্রী মিতুকে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভাড়াটে হিসেবে তারা কাজটি করেছেন। কার নির্দেশে মিতুকে খুন করা হলো, কেন করা হলো— তা না জানালে ভবিষ্যতে আইনের শাসন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসপি বাবুল আক্তারকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, খোদ পুলিশ প্রশাসনেও নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। কোনো মামলার বাদীকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে নিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ নজিরবিহীন। এই দীর্ঘ সময় তিনি কী জবানবন্দি দিয়েছেন, তার মুখোমুখি অপরাধীরা কী বয়ান দিয়েছেন, তাও প্রকাশ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মিতু হত্যার নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ না হলে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তিই প্রশ্নের মুখে পড়বে। অন্যদিকে এ ধরনের অপরাধপ্রবনতা আরো বাড়তে থাকবে। এসপি বাবুল আক্তারকেও কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে। তাই, সত্য যত কঠিনই হোক, পুলিশকেই তা তুলে ধরতে হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিতু খুনের মতো স্পর্শকাতর ঘটনা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অপরাধীরা ধরাও পড়েছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু নির্দেশদাতা কে, তা নিয়ে লুকোচুরি চলছে। এটা কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, এখন ফেসবুক, টুইটারের যুগ। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কে নির্দেশদাতা তাও বেরিয়ে আসবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, চার নেতা হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধেরও বিচার হচ্ছে। সুতরাং একটু দেরি হলেও এ খুনের নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। নইলে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার অবশ্য বলেন, ‘খুনে অংশ নেওয়া আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা পেশাদার অপরাধী। কার নির্দেশে তারা খুনে অংশ নিয়েছিলেন তা বলা যাচ্ছে না। সম্ভাব্য সব বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। হত্যাকাণ্ডে সাত-আট জন অংশ নেন। বাকি আসামিদেরও শনাক্ত করা গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’

সিএমপির কমিশনার আরও জানান, ‘মিতু হত্যাকাণ্ড টার্গেট কিলিং। কারা, কেন করিয়েছেন, তাও বলা যাচ্ছে না। নিশ্চিত না হয়ে বলা যাচ্ছে না জঙ্গি, চোরাকারবারি কিংবা বিরোধী কোনো গোষ্ঠী এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা।’ কেন, কার নির্দেশে পেশাদার অপরাধীরা মিতুকে খুন করেছেন— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ হলেই বলতে পারব।’

গত ৫ জুন নগরীর জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটন এবং আসামিদের গ্রেফতারে কাজ শুরু করেছে ডিবি, র?্যাব, সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিআই)সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য সংস্থাগুলো।

এরপর গত শুক্রবার গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুলকে। বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে তিনি কাউকে দেখা দিচ্ছেন না। কারও সঙ্গে কথাও বলছেন না। বাড়িতে দিনরাত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। শ্বশুরই সর্বক্ষণ সঙ্গ দিচ্ছেন জামাতাকে। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই বাবুল আক্তারের কথা বলা মানা বলেও জানিয়েছেন তার শ্বশুর। তবে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়েও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের রাখঢাকের মধ্যে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যাদের ধরেছি, তাদের সঙ্গে বাবুল আক্তারের কথা বলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কেন খুন করেছেন, সেজন্য…।’ রাতের বেলায় নিয়ে ১৫ ঘণ্টা কেন রাখা হয়েছিল— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সন্দেহভাজন ধরলে তা আসলে সঠিক ধরেছি কিনা সেজন্য বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল।’

মিতু খুন হওয়ার পর বাবুল আক্তার থাকছেন তার শ্বশুরালয়ে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ভূইয়াপাড়ার ২২০/এ নম্বর বাড়িতে বাস করেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। গতকাল দুপুরে গিয়ে বাবুল আক্তারের দেখা মেলেনি। তবে তার শ্বশুরের বাড়ির বাইরে পুলিশের পাহারা দেখা গেছে। বাবুল আক্তার অনেকটা অসহায় ও নার্ভাস হয়ে পড়েছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছেন না। বাইরেও খুব একটা বেরোচ্ছেন না। তবে মাঝেমধ্যে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসক দেখাচ্ছেন। তার মাইগ্রেনের সমস্যাও রয়েছে। বাইরে গেলেও পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে যাচ্ছেন। তার চিকিৎসক এস আই মল্লিক। শনিবারও হাসপাতালে যান বাবুল আক্তার। সঙ্গে নিয়ে যান তার সন্তানদেরও। ওই ঘটনার পর থেকে দুই সন্তান মানসিক চাপে পড়েছে। এ কারণেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।

বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘মিতুর দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির (৮) ও তাবাসসুম তাজমিন টাপুরও (৫) অনেকটা নার্ভাস। তারাও মানসিক চাপে আছে। সন্তানদের মানসিক চিকিৎসক দেখানো হচ্ছে। দুই সন্তানকে সামলাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। তারা বার বার মায়ের কথা বলে। মায়ের কাছে যেতে চায়। আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। খাবারও খেতে চায় না। জোর করে খাবার খাওয়ানো হয়। শারীরিকভাবেও মাহির ও টাপুর দুর্বল হয়ে পড়েছে।’

পরিবারের এক সদস্য জানান, মাহির ও টাপুরকে দেখাশোনা করছেন তার নানি, খালা ডা. শায়লা মোশাররফ ও বাবুল আক্তার নিজে। দোতলা ওই বাড়িতে ছয়টি রুম। বাবুল আক্তার দুই সন্তানকে নিয়ে দোতলায় থাকছেন। তারা মাকে খুঁজতে রুমে রুমে গিয়ে উঁকি দেয়। মাকে না পেয়ে চিৎকারও করে। কিন্তু ২২ দিন ধরেও মায়ের দেখা না পেয়ে তারা মা মা বলে ডাকে। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই।

মাহির ও টাপুরের ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এবার আমাদের ঈদ হবে না। কোনো শপিংও করা হয়নি। করার ইচ্ছাও নেই। তবে মিতু মারা যাওয়ার আগে কাজের মেয়ে ও দুই সন্তানের জন্য কাপড় কিনে সেলাই করতে দিয়েছিল। সেগুলো মিতু আনতে পারেনি। মিতু হত্যার নেপথ্য যারা রয়েছে, তাদের বিচার দাবি করছি। তবে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে।’

ঘটনার দিন থেকেই মোশাররফ হোসেনের বাসার সামনে পুলিশ প্রটেকশন থাকছে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কে কোন ধরনের মন্তব্য করছেন তা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। পারিবারিক কোনো সমস্যা ছিল না। অন্য বিষয়ে বলতে পারছি না।’

জানা গেছে, বাবুল ও মিতু দম্পতির দুই সন্তান মাহির ও টাপুরকে বিনোদনের মাধ্যমে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন স্বজনরা। তারা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস খেলছে। টেলিভিশনে কার্টুন দেখানো হচ্ছে। পছন্দের খাবার দেওয়া হচ্ছে। তাদের হাসিখুশি রাখতে সর্বদা চেষ্টা করছেন স্বজনরা।

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার নির্দেশদাতা কে— তা নিয়ে চট্টগ্রামেও চলছে ধূম্রজাল। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, গ্রেফতার আসামিরা মিতু হত্যায় কে নির্দেশ দিয়েছেন— জিজ্ঞাসাবাদে তা বলেছেন। কিন্তু মামলার তদন্তের স্বার্থে ‘ওই নির্দেশদাতা’র নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে নির্দেশদাতা ও তার এক ঘনিষ্ঠজনের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। কিন্তু তাদের নাম প্রকাশ হলে ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে একটি বাহিনী। তাই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে মিতু খুনের নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করছে না পুলিশ।

মিতু খুনের নির্দেশদাতা কে— এমন প্রশ্নের জবাবে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) দেবদাস ভট্টাচার্য্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসিম ও আনোয়ার এসপির স্ত্রী মিতু খুনের নির্দেশদাতার নাম বলেছেন। হয়তো ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও ওই নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করেছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এখনো হাতে পাইনি। হাতে পেলে বলতে পারব, নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করেছেন কিনা।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এখনো মামলার তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ হলেই নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করা হবে।’

সিএমপি সূত্র জানায়, মিতু কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী সাত পেশাদার অপরাধী, প্রভাবশালী একজন নির্দেশদাতা ও তার এক ঘনিষ্ঠজনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সাত সদস্য হলেন— আবু মুছা সিকদার, আনোয়ার হোসেন, মো. ওয়াসিম, মো. রাশেদ ওরফে ভাগ্নে রাশেদ, আবদুল নবী, মোহাম্মদ শাহজাহান ও এহতেশাম হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলা। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া মুছা, আনোয়ার, শাহজাহান, ওয়াসিম ও ভাগ্নে রাশেদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। তারা প্রত্যেকেই একসময় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে দলবদল করেন। তবে তারা সবাই পেশাদার অপরাধী। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ একাধিক মামলা ছিল। এ ছাড়া মুছা, আনোয়ার, ওয়াসিম পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। ভোলাও একজন পেশাদার অপরাধী। তবে তিনি মিতু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি। তিনি হত্যাকারীদের অস্ত্র ভাড়া দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। মুছার সঙ্গে তার ব্যবসা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মিতুকে খুনের পর মুছা, নবী ও ওয়াসিম মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। মুছা মোটরসাইকেল চালান, মাঝে বসা ছিলেন নবী আর সবার পেছনে ছিলেন ওয়াসিম। বাকিরা ব্যাকআপ টিম হিসেবে ছিলেন। মোটরসাইকেলটি তারা বড়গ্যারেজ এলাকায় রেখে পালিয়ে যান। খুনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী নবী ও ওয়াসিম কাকে খুন করেছেন তা জানতেন না। তারা মিতুকে ‘জঙ্গিনেত্রী’ হিসেবে জানতেন। খুনের পর গণমাধ্যমের খবর দেখে তারা নিশ্চিত হন খুন করা নারী হচ্ছেন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিতু খুনের নির্দেশদাতা কোনো অপরাধী বা উগ্রবাদী গোষ্ঠী হলে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সাত অপরাধীই মিতু হত্যার পরিকল্পনা করেন। নির্দেশদাতা কে, তাও নিশ্চিত হওয়া গেছে।’