সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের চাপাতির আঘাতে খাদিজা আক্তার নার্গিসের ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ঘটনাটি ’টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। প্রবাসীসহ সারাদেশের জনগণ ফুঁসে ওঠেছে ‘বদ’ বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে।
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা নার্গিস রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী। ওইদিন বিকালে ক্যাম্পাসে কয়েকজন তরুণের হাত ধরেই মেডিক্যাল পর্যন্ত পৌঁছায় খাদিজার অচেতন দেহ। বদরুলের কবল থেকে উদ্ধা্র করে খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তারা।
এই সাহসী তরুণদের মধ্যে ইমরানের কথা ইতোমধ্যেই জেনেছেন দেশবাসী। এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওচিত্রের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে আরেক তরুণের কথা। যার লাথিতেই রক্তস্নাত সেই বিকেলে কুপোকাত হয়েছিল শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম।
জুনেদ আহমদ জনি নামের ওই তরুণের সাহসিকতা ছাড়িয়ে গেছে ইমরানকেও। ভিডিওটির সূত্র ধরে বের হয়ে আসে বদরুলের মাথায় ‘ফ্লাইং কিক ’দেওয়া তরুণ সিলেট এমসি কলেজের স্নাতক (বিএসএস) ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জুনেদ আহমদ জনি (২১)। তিনি ছাত্রলীগ কর্মী।
সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের দাসপাড়া বংশীধর গ্রামের প্রবাসী হাজী আব্দুর রহমান ও গৃহিণী নুরুন্নেসা খাতুন দম্পতির ছোট ছেলে জনি। ঘটনার সময় বদরুল তার দিকে চাপাতি হাতে ছুটে আসলেও ভয় পাননি জনি।বীরদর্পে উড়ন্ত লাথিতে বদরুলকে মাটিতে ফেলে দেন জনি।
জনি জানান, ঘটনার দিন বিকেল সোয়া পাঁচটায় মোটরসাইকেলে করে এমসি কলেজে যান। কলেজ অডিটোরিয়ামের সামনে গিয়ে দেখেন একটি ছেলে একটি মেয়েকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। মেয়েটির ওপর এই হামলা থামাতে ছাত্র সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে আরো এগিয়ে যান ক্যান্টিনের সামনে। যা ঘটনাস্থল থেকে কয়েক হাত দূরে। তিনি ছেলেটির দিকে চিৎকার করেন, গালিগালাজ করেন। ঢিল ছুড়েন।
ওই সময় বদরুল নামের নরপশুটি তাকেও আঘাত করতে চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসে। অনেক মানুষ উপস্থিত থাকলেও কেউ তখন এগিয়ে আসেনি। গলা ফাটিয়ে অনেককে ডেকেছেন জনি। কিন্তু কেউ সামনে এগিয়ে আসেনি।
এসময় বদরুল চাপাতি উচিয়ে তাড়া করে জনিকে এমসি কলেজ ক্যান্টিনের পাশের লেকের ব্রিজে নিয়ে যায়। পরে জনি আত্মরক্ষায় চলে যান রসায়নবিভাগের দিকে। বদরুলও আর এগিয়ে না এসে আহত অবস্থা মাটিতে লুটিয়ে থাকা খাদিজাকে ফের কোপাতে থাকে। জুনেদ তখন ক্যান্টিনের সামনের সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে চলে যান মসজিদের প্রবেশ মুখে ঘটনাস্থলের খুব কাছে পৌছে যায় (ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে তাকে আকাশি রঙের শার্ট পরনে দেখা যায়)।
ওইসময় ক্যান্টিন, কলেজ স্পোটর্স রুম ও ছাত্রসংসদ ভবনের সামনে প্রায় শতাধিক লোক ছিলেন। সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিলেন খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য। কেউ কেউ ভিডিওতেও ধারণ করছিলেন।
একসময় বদরুল খাদিজাকে ফেলে রেখে ক্যান্টিনের দিকে থাকা জনতাকে চাপাতি হাতে তাড়া করে। এ অবস্থায় মসজিদের সরু রাস্তা দিয়ে প্রথমেই এগিয়ে যান জুনেদ আহমদ জনি। তিনি প্রথমেই ক্ষতবিক্ষত খাদিজার মাথার রক্তপাত বন্ধ করতে তারই ওড়না দিয়ে বেঁধে দেন মাথা। উপস্থিত কয়েকজনকে ডাকেন এগিয়ে আসার জন্য।
ঘটনাস্থলের দক্ষিণ দিক থেকে তার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন ইমরান কবিরসহ আরো ২/৩ জন তরুণ। পরে জুনেদ, ইমরান, মাহফুজসহ আরো কয়েকজন ধরাধরি করে খাদিজার অচেতন দেহ নিয়ে যান গেটে। পরে একটি সিএনজি অটোরিকশাতে করে ইমরান ও আরো কয়েকজন খাদিজাকে নিয়ে যান সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে।
জনি জানান, মেডিক্যালে না গিয়ে তিনি ফিরে আসেন পুকুরপাড়ে। বদরুলের গুণ্ডামি আর উত্তাপ তখনও থামেনি।কাউকে পরোয়া না করে উল্টো বরং চাপাতি উচিয়ে তাড়া করতে থাকে উৎসুক জনতাকে। কলেজ ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদেরও তাড়া করেছে সে।
এরইমধ্যে জনি আবার চলে আসেন পুকুরের পূর্বপাড়ে ঘটনাস্থলে। তার উদ্দেশ্য থামাবেন বদরুলকে। বদরুলকে ধরার জন্য চিৎকারও দেন। মানুষদেরও এগিয়ে আসার জন্য ডাকেন। কেউ আসেনি।
বদরুলের হাতে ছিল রক্তমাখা চাপাতি। পরে কলেজ শহীদ মিনারের সামনে থেকে পুলিশ বদরুলের দিকে গুলি করার জন্য বন্দুক তাক করে, তখনও বদরুল হিংস্রভাকে চাপাতি হাতে পুলিশকেও মারার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল। হেঁটে হেঁটে বদরুল চলে আসে স্পোর্টস রুমের সামনে। আর এই সুযোগেই ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে দৌঁড়ে এসে জুনেদ পেছন দিক থেকে উড়ন্ত লাথি দেন বদরুলকে। তার এক লাথিতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বদরুল। (এসময় ভিডিওতে হলুদ টি-শার্ট পরেছিলেন জনি। আকাশি রংয়ের শার্টটি খাদিজার রক্তে ভিজে যাওয়ায় পরে তিনি হলুদ টি-শার্ট পড়েন।)
বদরুল মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরই পুলিশসহ অন্যরা এসে বদরুলকে গণপিটুনি দিতে থাকে। পরে পুলিশ তাকে আবার জনতার রোষ থেকে উদ্ধার করে আটক করে নিয়ে যায় থানাতে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বদরুলকে আঘাত করা প্রসঙ্গে জুনেদ বলেণ, খাদিজাকে যেভাবে নির্মমভাবে বদরুল কুপিয়েছে তা দেখে তিনি নিজেকে সামলাতে পারেননি। কোনো মানুষ এভাবে কাউকে মারতে পারে না। সে মানুষ নয়, সেজানোয়ার।
জুনেদকে বলা হয়, আপনি ছাত্রলীগ কর্মী আর বদরুলও শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। এটা জানলে কি আপনি বদরুলকে এভাবে লাথি মারতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন,. ‘বদরুলের স্থানে আমার আপন ভাই হলেও আমি একই কাজ করতাম।’