ঢাকা , মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাছ খাওয়া বাড়লেও অনুপুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ

নদী-নালা ও খাল-বিলের দেশে এক সময় প্রাকৃতিক জলাশয় মাছে ভরপুর ছিল। দিন দিন দখল-দূষণে নদী-নালা ও খাল-বিলের মাছ কমে গেছে। দেশের মানুষের মুক্ত জলাশয়ের মাছ খাওয়ার হারও কমেছে। গত ২০ বছরে কমেছে ৩৩ শতাংশ। ফলে প্রাকৃতিক মাছের উচ্চ অনুপুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ। গত ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান সাময়িকী প্লাস ওয়ানে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল-এই ২০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক মাছের উত্পাদন কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে চাষের মাছের উত্পাদন ৮ শতাংশ করে বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ২০ বছর আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি মাছ খেলেও মাছ থেকে পাওয়া অনুপুষ্টির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে চাষের মাছ থেকে ক্যালসিয়াম ও আয়রনের প্রাপ্তি কমেছে। ভিটামিন, জিঙ্ক ও ভিটামিন-১২ যে পরিমাণ পাওয়ার কথা তাও পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের যৌথ এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্ত জলাশয়ের মাছের মধ্যে ছোট মাছই বেশি। এসব মাছ মাথা, লেজ ও কাঁটাসহ খাওয়া হয়। এতে বেশি পরিমাণে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। উচ্চমানের আমিষও থাকে প্রচুর পরিমাণে। চাষের মাছে সেগুলো মেলে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে বছরে জনপ্রতি মাছ খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৬ কেজি। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ২ কেজি। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের খাদ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণা ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী ও সহযোগী অধ্যাপক ড. লুত্ফুল বারী বলেন, আমরা মূল্যবান প্রাকৃতিক মাছ ধ্বংস করে চাষের মাছের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। যার ফলে অনুপুষ্টি ঘাটতিজনিত যেসব সঙ্কট তৈরি হতে পারে, গবেষণাটিতে সেগুলো বেরিয়ে এসেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক মাছ বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টির আধার। শরীরের নানা পুষ্টি পূরণ প্রাকৃতিক মাছ থেকেই হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. নেসার আহমেদ বলেন, দেশি মাছে পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। ক্যালসিয়াম, আয়রন ও জিঙ্কসহ বিভিন্ন ভিটামিনের পরিমাণও বেশি থাকে। বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছ থাকায় মানুষ প্রাকৃতিক মাছ থেকে নানা পুষ্টিগুণ পেতে পারে। কিন্তু চাষের মাছের ক্ষেত্রে সেটি হবে না। কিন্তু অনেক দেশি মাছ মুক্ত জলাশয়ের দূষণ দখল, নির্বিচারে ধরা ও আশ্রয়ের অভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রতিবছর মুক্ত জলাশয়ের মাছের উত্পাদন কমছে। তবে মত্স্যবিজ্ঞান কর্মকর্তারা জানান, দেশে জলাভূমি দূষণ-দখল-ভরাট ও মাত্রাতিরিক্ত নিধনে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উত্পাদন কমে আসছে। বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি জাতের অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ মাছের প্রজাতি। মত্স্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, হাওর, লেক ও প্লাবন ভূমিতে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি কমে আসায় বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছের উত্পাদন থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে পাশাপাশি নদী, হাওর ও বিলসহ জলাভূমির মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ ক্ষুদ্র জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মত্স্য অধিদফতরের হিসাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৫৩ হেক্টর আয়তনের নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক, প্লাবন ভূমিতে মোট ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮০৫ টন প্রাকৃতিক মাছ উত্পাদন হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যার আয়তন ছিল ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৯৩৪ হেক্টর। মোট উত্পাদন ছিল ১০ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৭ টন। এই সময় মোট উত্পাদন কমেছে ৩৪ হাজার ১৩২ টন ও আয়তন কমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৮১ হেক্টর। অন্যদিকে অধিদফতরের হিসাবে, মাছের মোট উত্পাদনে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অবদান গত ৩০ বছরে ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মুক্ত জলাশয়ের অবদান ৬৩ শতাংশ হলেও ২০১৩-১৪ সালে এ ক্ষেত্রের অংশ দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, মুক্ত জলাশয় ভরাট, দূষণ, মাছের অতি আহরণ, প্রাকৃতিক উত্স থেকে পোনা সংগ্রহ, বিদেশি প্রজাতির মাছ অন্তর্ভুক্তি, কৃষি জমিতে নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মুক্ত জলাশয়ের মাছের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। ফলে মানুষের পাতে মুক্ত জলাশয়ের মাছ যাওয়ার পরিমাণও কমেছে। তিনি বলেন, মুক্ত জলাশয়ে মাছের উত্পাদন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে পোনামুক্ত কার্যক্রম ও বিল নার্সারি স্থাপনের মাধ্যমে মুক্ত জলাশয়ে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এছাড়া মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেশি মাছের বিচরণ ক্ষেত্র সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলা হয়। অভয়াশ্রম স্থাপনের ফলে বিপন্নপ্রায় চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউস, আইড়, টেংরা, বাইম, পাবদা, রিটা, কাজলি, মেনি ও গজারসহ বিভিন্ন মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

মাছ খাওয়া বাড়লেও অনুপুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ

আপডেট টাইম : ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ এপ্রিল ২০১৭

নদী-নালা ও খাল-বিলের দেশে এক সময় প্রাকৃতিক জলাশয় মাছে ভরপুর ছিল। দিন দিন দখল-দূষণে নদী-নালা ও খাল-বিলের মাছ কমে গেছে। দেশের মানুষের মুক্ত জলাশয়ের মাছ খাওয়ার হারও কমেছে। গত ২০ বছরে কমেছে ৩৩ শতাংশ। ফলে প্রাকৃতিক মাছের উচ্চ অনুপুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ। গত ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান সাময়িকী প্লাস ওয়ানে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল-এই ২০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক মাছের উত্পাদন কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে চাষের মাছের উত্পাদন ৮ শতাংশ করে বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ২০ বছর আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি মাছ খেলেও মাছ থেকে পাওয়া অনুপুষ্টির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষ করে চাষের মাছ থেকে ক্যালসিয়াম ও আয়রনের প্রাপ্তি কমেছে। ভিটামিন, জিঙ্ক ও ভিটামিন-১২ যে পরিমাণ পাওয়ার কথা তাও পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের যৌথ এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্ত জলাশয়ের মাছের মধ্যে ছোট মাছই বেশি। এসব মাছ মাথা, লেজ ও কাঁটাসহ খাওয়া হয়। এতে বেশি পরিমাণে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। উচ্চমানের আমিষও থাকে প্রচুর পরিমাণে। চাষের মাছে সেগুলো মেলে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে বছরে জনপ্রতি মাছ খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৬ কেজি। ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ২ কেজি। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের খাদ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণা ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী ও সহযোগী অধ্যাপক ড. লুত্ফুল বারী বলেন, আমরা মূল্যবান প্রাকৃতিক মাছ ধ্বংস করে চাষের মাছের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। যার ফলে অনুপুষ্টি ঘাটতিজনিত যেসব সঙ্কট তৈরি হতে পারে, গবেষণাটিতে সেগুলো বেরিয়ে এসেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক মাছ বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টির আধার। শরীরের নানা পুষ্টি পূরণ প্রাকৃতিক মাছ থেকেই হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. নেসার আহমেদ বলেন, দেশি মাছে পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। ক্যালসিয়াম, আয়রন ও জিঙ্কসহ বিভিন্ন ভিটামিনের পরিমাণও বেশি থাকে। বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছ থাকায় মানুষ প্রাকৃতিক মাছ থেকে নানা পুষ্টিগুণ পেতে পারে। কিন্তু চাষের মাছের ক্ষেত্রে সেটি হবে না। কিন্তু অনেক দেশি মাছ মুক্ত জলাশয়ের দূষণ দখল, নির্বিচারে ধরা ও আশ্রয়ের অভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রতিবছর মুক্ত জলাশয়ের মাছের উত্পাদন কমছে। তবে মত্স্যবিজ্ঞান কর্মকর্তারা জানান, দেশে জলাভূমি দূষণ-দখল-ভরাট ও মাত্রাতিরিক্ত নিধনে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উত্পাদন কমে আসছে। বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি জাতের অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ মাছের প্রজাতি। মত্স্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, হাওর, লেক ও প্লাবন ভূমিতে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি কমে আসায় বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছের উত্পাদন থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে পাশাপাশি নদী, হাওর ও বিলসহ জলাভূমির মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ ক্ষুদ্র জেলে পরিবারগুলোর জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মত্স্য অধিদফতরের হিসাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৯ লাখ ১০ হাজার ৫৩ হেক্টর আয়তনের নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক, প্লাবন ভূমিতে মোট ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮০৫ টন প্রাকৃতিক মাছ উত্পাদন হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যার আয়তন ছিল ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৯৩৪ হেক্টর। মোট উত্পাদন ছিল ১০ লাখ ২৯ হাজার ৯৩৭ টন। এই সময় মোট উত্পাদন কমেছে ৩৪ হাজার ১৩২ টন ও আয়তন কমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৮১ হেক্টর। অন্যদিকে অধিদফতরের হিসাবে, মাছের মোট উত্পাদনে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অবদান গত ৩০ বছরে ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মুক্ত জলাশয়ের অবদান ৬৩ শতাংশ হলেও ২০১৩-১৪ সালে এ ক্ষেত্রের অংশ দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, মুক্ত জলাশয় ভরাট, দূষণ, মাছের অতি আহরণ, প্রাকৃতিক উত্স থেকে পোনা সংগ্রহ, বিদেশি প্রজাতির মাছ অন্তর্ভুক্তি, কৃষি জমিতে নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মুক্ত জলাশয়ের মাছের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। ফলে মানুষের পাতে মুক্ত জলাশয়ের মাছ যাওয়ার পরিমাণও কমেছে। তিনি বলেন, মুক্ত জলাশয়ে মাছের উত্পাদন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে পোনামুক্ত কার্যক্রম ও বিল নার্সারি স্থাপনের মাধ্যমে মুক্ত জলাশয়ে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এছাড়া মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেশি মাছের বিচরণ ক্ষেত্র সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলা হয়। অভয়াশ্রম স্থাপনের ফলে বিপন্নপ্রায় চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউস, আইড়, টেংরা, বাইম, পাবদা, রিটা, কাজলি, মেনি ও গজারসহ বিভিন্ন মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।