বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎস্য খনি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণাঞ্চলে দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করেছে চাষ করা পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলাসহ প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। গ্রামে একসময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়তো। অথচ এখন অনেক গ্রামেই দেশি প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। শীতকালের বাইরে বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রও বলছে, দুই দশক আগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত। এখন এগুলো বিলুপ্তির পথে।
রাজধানীর শান্তিনগর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘১৫-১৬ বছর আগেও মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না আমার এলাকায়। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনার কথাই মনে পড়ে। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে খালে বা নদীতে চলে যেত। খালে, পুকুরে তখন এত মাছ ছিল যে, কেউ খালি হাতে নেমেও হাতিয়ে মাছ ধরতে পারতো।’
এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মৎস্য খামারি সালাউদ্দিন মুফতি বলেন, ‘‘বাড়িতে দু’টি পুকুর আছে। জন্মের পর থেকেই এই পুকুর দু’টি দেখছি। ২০ বছর আগেও পুকুর থেকে সারাবছর বাড়ির সবাই মাছ ধরত। শীতের মৌসুমে পুকুর ‘আউড়ান’ (অনেক মানুষ একসঙ্গে পুকুরে নেমে পানি ঘোলা করা, যেন ঘোলা পানি খেয়ে মাছ দুর্বল হয়ে ওপরে ভেসে উঠে এবং সহজে সেগুলো ধরা যায়) হতো। এরপর জাল, ডালা, খুচন নিয়ে মাছ ধরতে নেমে যেত ছোট-বড় সবাই। কেউ কেউ হাতিয়ে মাছ ধরত। শোল, গজার, টাকি, চিংড়ি, শিং, কই, টেংরা, পাবদা, ফলিসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ত। তবে এখন ওই দুই পুকুরে চেলা, পুঁটি, বেলে ছাড়া কোনও মাছ নেই।’
পিরোজপুরের নাজিরপুরের কলার দোয়ানিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আসলাম মিয়া বলেন, ‘স্থানীয় কলার দোয়ানিয়া বাজারেও হাটের দিন দেশি প্রজাতির অনেক মাছ উঠত। এখন আর সেসব মাছ ওঠে না। বাজার ভরা থাকে চাষের পাঙ্গাস আর তেলাপিয়ায়। মাঝে-মধ্যে সিজনে জাটকাও ওঠে।’ দেশি মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি ইরি ধান ও অন্যান্য সবজিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারকে দায়ী করেন।
সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে ১৪টি কারণে। এই কারণগুলো হলো- জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ করা ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো।
চলতি বছরের মার্চ মাসে নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাওর এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠেছিল। সংশ্লিষ্ট জেলার মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ধান পঁচে হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়ে অক্সিজেন কমে যাওয়ার কারণেই মাছ মরে গেছে। তবে হাওর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ভিদ পঁচে অ্যামোনিয়া তৈরি হয় না। অন্য কোনও কারণ আছে। সেগুলোকে খুঁজে বের করতে খুব দ্রুত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হবে বলা হলেও তা এখনও করা হয়নি। গবেষণার পরিকল্পনাও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নেই।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে আমরা বিষয়টি গভীরভাবে মনিটর করছি। বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যে মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ রক্ষা করতে গবেষণা চলছে। পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড় মাছের চাষ হচ্ছে। পাঙ্গাসের চাষ হচ্ছে আগে থেকেই। কৈ মাছেরও চাষ হচ্ছে। আরও গবেষণা হবে। দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় মৎস্য অধিদফতর প্রতিবছরই মৎস্য মেলার আয়োজন করে। একই কর্মসূচি জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক আগেও এ অঞ্চলে আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতায় এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন আর চোখে পড়ে না। বর্ষা মৌসুমে নদী, খাল, বিল থেকে কারেন্ট জাল দিয়ে ব্যাপক হারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশি মিঠা পানির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
পিরোজপুরের কয়েকজন প্রবীণ জানান, একসময় এলাকার বলেশ্বর, সন্ধ্যা ও পায়রা নদীতে ২ কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যেত। পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ। এমন কোনও মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের বিলে পাওয়া যেত না। এলাকার নলামারা বিলে তারা জাল দিয়ে ১২ কেজি ওজনের কালবাউশ মাছ ধরেছেন। বেলে, ডগরা, কাজলি, ভাঙ্গান, ভোলা প্রভৃতি মাছ তারা খাওয়ার অযোগ্য মনে করে ধরার পর ফেলে দিতেন। এখন আর সেদিন নেই বলে জানান তারা।
দেশি প্রজাতির মাছের হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ রক্ষায় এখন ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে; যেভাবে এখন পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড়, পাঙ্গাস ও কৈ মাছের চাষ হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক বলেন, ‘বর্তমান সরকারের যথাযথ উদ্যোগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন। মৎস্যবান্ধব সরকারের উন্নয়নমুখী উদ্যোগ ও সেবার কারণেই মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে।’
আগামী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) মধ্যেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে বলেও আশাবাদ জানান মন্ত্রী।
সংবাদ শিরোনাম :
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আব্দুল্লাহ মারা গেছেন
এক্স-রে করে বাসযাত্রীর পেটে মিলল স্বর্ণের ৮টি বার
হত্যা মামলায় কারাগারে মুকুল ও সোলাইমান
যে হারে পতন হয়েছে ফরাসি রানির, বিক্রি হলো ৫৭ কোটি টাকায়
বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী আজারবাইজান
লুটপাটের বিশেষ বিধান আইন ছিল কুইক রেন্টাল : শাহদীন মালিক
হাজতখানায় বসে টাকা হাতবদল : কনস্টেবল বরখাস্ত, ওসিসহ ৩ জনকে শোকজ
কেন সাবেক আইনমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন আইয়ুবুর, জানালেন নিজেই
সেনাদের প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করছে ইসরায়েল’
১৮৩ কোটি টাকা পাচার ফালুসহ ৩ জনকে অব্যাহতি
হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ
- বাঙ্গালী কণ্ঠ ডেস্ক
- আপডেট টাইম : ১২:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০১৭
- 430
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ