ঢাকা , শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গরিবের নাগালের বাইরে কম দামি ব্রয়লার মুরগি

গরু কিংবা খাসির মাংসের দামে যেখানে হাত পুড়ছে, সেখানে ভরসা কেবল মুরগির বাজার। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। মুরগির বাজারে সব থেকে কম দামি ব্রয়লার মুরগিটার দামও এখন ডবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গেছে। ছুটির দিন কিংবা বাড়িতে মেহমান এলে পাতে মাংস রাখতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল এ মুরগি। কিন্তু এক সময় নাগালে থাকা ব্রয়লারের কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা পর্যন্ত। এ দামে কিনে খেতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। এমনকি মধ্যবিত্তদেরও হিসাব করে কিনতে হচ্ছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বাড়িতে মেহমান আসায় গতকাল বাজারে মুরগির মাংস কিনতে আসেন কদমতলী এলাকার বাসিন্দা মোসাম্মত নাসিমা আক্তার। কিন্তু ব্রয়লারের কেজি ২১০ টাকা শুনে থমকে গেলেন যেন। তারপরও দোকানের সবচেয়ে ছোট ব্রয়লারটি ওজন দিতে বললেন। দোকানি ১ কেজি ৭০০ গ্রামের একটি মেপে দাম জানালেন ৩৫৭ টাকা। এতখানি দাম সামর্থ্যরে বাইরে চলে যাওয়ায় অন্য দোকানের পথ ধরলেন মধ্য বয়সী এ নারী।

কথা হলে নাসিমা বলেন, বাড়িতে বৃদ্ধ স্বামী কর্মহীন। টিনের ডিব্বা তৈরির কারখানায় কাজ করে যে সামান্য টাকা আয় হয় তা দিয়ে এই দামে একটা মুরগি খাওয়া অনেক খরচের। দেখি অন্য দোকানে আরও কম ওজনের পাওয়া যায় কিনা।

আরেক ক্রেতা মো. আনিস রহমান এক এক করে সোনালি, কক, লেয়ার ও ব্রয়লারের দাম করে শেষমেশ কোনোটিই কিনলেন না। তিনিও আক্ষেপ করে বললেন, কম বেতনের টাকায় গরুর মাংস খাওয়া দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনালির কেজি ৩২০ টাকার নিচে নেই। ককের দাম ২৮০-২৯০ চাচ্ছে। সবচেয়ে কম দামের ব্রয়লারের দামও ২০০ ছাড়িয়েছে। একটা ব্রয়লারে দাম পড়ছে ৩৫০-৪০০ টাকা। এই দামে আগে দেশি মুরগি কেনা যেত। যা পরিস্থিতি, তাতে মুরগির মাংসটাও কপাল থেকে বাদ পড়ছে।

ব্রয়লারের বাজার নিয়ে জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতা মো. জিসান হোসেন বলেন, শুক্রবার হওয়ায় চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারিতে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। ২১০ টাকার নিচে বিক্রি করলে লাভ থাকে না। তারপরও ক্রেতা ধরতে কম লাভে ২০০ টাকাও বিক্রি করছি। এর চেয়ে কমে বিক্রি সম্ভব না। ব্যবসায়ীরা জানান, গত মাসেও এ মুরগি ১৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ধাপে ধাপে তা বেড়ে ১৮০, ২০০ এবং এখন ২১০ টাকায় ঠেকেছে। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে কম দামের এ মুরগিটিও স্বল্প আয়ের মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের বাজার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, এক মাস আগে ব্রয়লারের সর্বনিম্ন দাম ছিল ১৭০ টাকা, যা বর্তমানে ২০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ২১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মাসের ব্যবধানে মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ১১ শতাংশ।

মালিবাগ বাজারেও ব্রয়লারের কেজি ২০০ টাকার নিচে মিলছে না। সেখানকার ক্রেতারাও সবচেয়ে কম দামের মুরগির এত দাম নিয়ে হতাশার কথা তুলে ধরেন। খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, দফায় দফায় দাম বেড়েছে।

এ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. ফারুক হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাইকারিতে দাম আরও বেড়েছে। পাইকারিতে ব্রয়লারের কেনাই পড়েছে ১৮৫ টাকা কেজি। এর সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য খরচের পর ২০০ টাকার নিচে বিক্রি সম্ভব নয়।

এ বাজারের মুরগি আসে কাপ্তান বাজার থেকে। কথা হলে কাপ্তানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. খলিল মিয়া বলেন, শীতে বিয়ে-সাদি, বারবিকিউসহ নানা অনুষ্ঠানের কারণে চাহিদা বেড়ে যায়। তার ওপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চাহিদা আরও

বাড়ে। কিন্তু সরবরাহ সেভাবে নেই। তা ছাড়া খামারেও উৎপাদন খরচ বেশি। পাইকারিতে ব্রয়লারের দর এখন ১৭৮ থেকে ১৮২ টাকা কেজি।

মুরগি ও ডিমের বাজারে কারসাজি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। কথা হলে তিনি বলেন, বাজার অস্থির হলেই আলোচনা হয়। অন্য সময় কোনো আলোচনা নেই। তাই সমাধান হচ্ছে না। এক দিনের বাচ্চা ও ফিডের বাজার বড় করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। হুটহাট বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্রয়লারের এক দিনের বাচ্চার নির্ধারিত মূল্য ৪৯ টাকা, সেখানে কিনতে হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা। এটা আবার ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদল হয়। কখনও কখনও ৭০ টাকাতেও ঠেকে। এভাবে খামারিদের উৎপাদন খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত বাচ্চা আর ফিডের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং এগুলোর বাজারে কারসাজি বন্ধ না হবে, তত দিন বাজারে স্বস্তি ফিরবে না। খামারিরাও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। ছোট খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইনও বলেন, কিছুদিন পরপরই মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। সরকরের অনুসন্ধানে এর পেছনের কারণগুলোও উঠে এসেছে। কিন্তু তারপরও ভোক্তারা পরিত্রাণ পাচ্ছে না। বাজারের সব থেকে কম দামি মুরগিও এখন নাগালের বাইরে। অন্যান্য পণ্যেও একই চিত্র। আমাদের আইন আছে; কিন্তু প্রয়োগ দেখি না। অপরাধীরা পার পেয়ে গিয়ে বারবার করসাজি করে। এর মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভ্যাট বৃদ্ধির অজুহাত। যেখানে ভ্যাটের প্রভাব নেই সেখানেও দাম বাড়াচ্ছে কেউ কেউ। যেমন- বিদেশি ফলের সঙ্গে এখন দেশি ফলেরও দাম বাড়ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

গরিবের নাগালের বাইরে কম দামি ব্রয়লার মুরগি

আপডেট টাইম : এক ঘন্টা আগে

গরু কিংবা খাসির মাংসের দামে যেখানে হাত পুড়ছে, সেখানে ভরসা কেবল মুরগির বাজার। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। মুরগির বাজারে সব থেকে কম দামি ব্রয়লার মুরগিটার দামও এখন ডবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গেছে। ছুটির দিন কিংবা বাড়িতে মেহমান এলে পাতে মাংস রাখতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল এ মুরগি। কিন্তু এক সময় নাগালে থাকা ব্রয়লারের কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা পর্যন্ত। এ দামে কিনে খেতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। এমনকি মধ্যবিত্তদেরও হিসাব করে কিনতে হচ্ছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বাড়িতে মেহমান আসায় গতকাল বাজারে মুরগির মাংস কিনতে আসেন কদমতলী এলাকার বাসিন্দা মোসাম্মত নাসিমা আক্তার। কিন্তু ব্রয়লারের কেজি ২১০ টাকা শুনে থমকে গেলেন যেন। তারপরও দোকানের সবচেয়ে ছোট ব্রয়লারটি ওজন দিতে বললেন। দোকানি ১ কেজি ৭০০ গ্রামের একটি মেপে দাম জানালেন ৩৫৭ টাকা। এতখানি দাম সামর্থ্যরে বাইরে চলে যাওয়ায় অন্য দোকানের পথ ধরলেন মধ্য বয়সী এ নারী।

কথা হলে নাসিমা বলেন, বাড়িতে বৃদ্ধ স্বামী কর্মহীন। টিনের ডিব্বা তৈরির কারখানায় কাজ করে যে সামান্য টাকা আয় হয় তা দিয়ে এই দামে একটা মুরগি খাওয়া অনেক খরচের। দেখি অন্য দোকানে আরও কম ওজনের পাওয়া যায় কিনা।

আরেক ক্রেতা মো. আনিস রহমান এক এক করে সোনালি, কক, লেয়ার ও ব্রয়লারের দাম করে শেষমেশ কোনোটিই কিনলেন না। তিনিও আক্ষেপ করে বললেন, কম বেতনের টাকায় গরুর মাংস খাওয়া দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনালির কেজি ৩২০ টাকার নিচে নেই। ককের দাম ২৮০-২৯০ চাচ্ছে। সবচেয়ে কম দামের ব্রয়লারের দামও ২০০ ছাড়িয়েছে। একটা ব্রয়লারে দাম পড়ছে ৩৫০-৪০০ টাকা। এই দামে আগে দেশি মুরগি কেনা যেত। যা পরিস্থিতি, তাতে মুরগির মাংসটাও কপাল থেকে বাদ পড়ছে।

ব্রয়লারের বাজার নিয়ে জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতা মো. জিসান হোসেন বলেন, শুক্রবার হওয়ায় চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারিতে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। ২১০ টাকার নিচে বিক্রি করলে লাভ থাকে না। তারপরও ক্রেতা ধরতে কম লাভে ২০০ টাকাও বিক্রি করছি। এর চেয়ে কমে বিক্রি সম্ভব না। ব্যবসায়ীরা জানান, গত মাসেও এ মুরগি ১৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ধাপে ধাপে তা বেড়ে ১৮০, ২০০ এবং এখন ২১০ টাকায় ঠেকেছে। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে কম দামের এ মুরগিটিও স্বল্প আয়ের মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের বাজার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, এক মাস আগে ব্রয়লারের সর্বনিম্ন দাম ছিল ১৭০ টাকা, যা বর্তমানে ২০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ২১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মাসের ব্যবধানে মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ১১ শতাংশ।

মালিবাগ বাজারেও ব্রয়লারের কেজি ২০০ টাকার নিচে মিলছে না। সেখানকার ক্রেতারাও সবচেয়ে কম দামের মুরগির এত দাম নিয়ে হতাশার কথা তুলে ধরেন। খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, দফায় দফায় দাম বেড়েছে।

এ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. ফারুক হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাইকারিতে দাম আরও বেড়েছে। পাইকারিতে ব্রয়লারের কেনাই পড়েছে ১৮৫ টাকা কেজি। এর সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য খরচের পর ২০০ টাকার নিচে বিক্রি সম্ভব নয়।

এ বাজারের মুরগি আসে কাপ্তান বাজার থেকে। কথা হলে কাপ্তানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. খলিল মিয়া বলেন, শীতে বিয়ে-সাদি, বারবিকিউসহ নানা অনুষ্ঠানের কারণে চাহিদা বেড়ে যায়। তার ওপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চাহিদা আরও

বাড়ে। কিন্তু সরবরাহ সেভাবে নেই। তা ছাড়া খামারেও উৎপাদন খরচ বেশি। পাইকারিতে ব্রয়লারের দর এখন ১৭৮ থেকে ১৮২ টাকা কেজি।

মুরগি ও ডিমের বাজারে কারসাজি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। কথা হলে তিনি বলেন, বাজার অস্থির হলেই আলোচনা হয়। অন্য সময় কোনো আলোচনা নেই। তাই সমাধান হচ্ছে না। এক দিনের বাচ্চা ও ফিডের বাজার বড় করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। হুটহাট বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্রয়লারের এক দিনের বাচ্চার নির্ধারিত মূল্য ৪৯ টাকা, সেখানে কিনতে হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা। এটা আবার ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদল হয়। কখনও কখনও ৭০ টাকাতেও ঠেকে। এভাবে খামারিদের উৎপাদন খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত বাচ্চা আর ফিডের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং এগুলোর বাজারে কারসাজি বন্ধ না হবে, তত দিন বাজারে স্বস্তি ফিরবে না। খামারিরাও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হবেন। ছোট খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইনও বলেন, কিছুদিন পরপরই মুরগি ও ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। সরকরের অনুসন্ধানে এর পেছনের কারণগুলোও উঠে এসেছে। কিন্তু তারপরও ভোক্তারা পরিত্রাণ পাচ্ছে না। বাজারের সব থেকে কম দামি মুরগিও এখন নাগালের বাইরে। অন্যান্য পণ্যেও একই চিত্র। আমাদের আইন আছে; কিন্তু প্রয়োগ দেখি না। অপরাধীরা পার পেয়ে গিয়ে বারবার করসাজি করে। এর মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভ্যাট বৃদ্ধির অজুহাত। যেখানে ভ্যাটের প্রভাব নেই সেখানেও দাম বাড়াচ্ছে কেউ কেউ। যেমন- বিদেশি ফলের সঙ্গে এখন দেশি ফলেরও দাম বাড়ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।