বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। ১৯৮৩ সালে জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। চলতি মাসেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব পেয়েছেন। সম্প্রতি একটি দৈনিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন জনতা ব্যাংক নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা। সাক্ষাৎকার অংশটি হুবহু তুলে ধরা হলো
জনতা ব্যাংক কেমন চলছে?
সাবেক এমডি (আবদুস সালাম) বিদায় নেয়ার পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আমি জনতা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব নিই। এরপর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছি। বিদায়ী এমডির দায়িত্ব গ্রহণের সময় জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। তিনি বিদায় নেয়ার সময় রেখে গেছেন ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
দায়িত্ব গ্রহণের পর ত্বরিতগতিতে খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পথচলার রূপরেখা তৈরি করেছি। সে আলোকে বিভাগভিত্তিক সম্মেলন করে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জাগিয়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বিপুল সাড়াও পেয়েছি। চলতি বছর শেষে আমরা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে পারব। যদিও বছর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি, সেটিও অর্জন করা সম্ভব হবে। খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায়, পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ও অতিরিক্ত সুদ আদায় করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা হয়েছে।
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের আমানত ৬৫ হাজার ৯২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ৪৩ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে এডি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৬৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এছাড়া ২০ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় কেমন হচ্ছে?
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থেকে মোট ১ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এর মধ্যে নগদ আদায় ৪১৯ কোটি টাকা। বছর শেষে নগদ আদায়ের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা ছাড়াবে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় গত বছর জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় বেশি ছিল। চলতি বছরও এ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে। অবলোপনকৃত ঋণ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৭ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকের মোট পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩ কোটি টাকা। এ বছর পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বাড়বে। খেলাপি ঋণ কমে আসায় বছর শেষে নিট মুনাফার পরিমাণও বেশি হবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ২০৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি থাকলেও বছর শেষে তা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। এরই মধ্যে আমরা মূলধন ঘাটতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি।
বড় কিছু গ্রাহকের কাছে জনতা ব্যাংকের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ায় সব মহল থেকে উদ্বেগ আছে। ঋণের বিকেন্দ্রীকরণে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণই বড় কিছু গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। জনতা ব্যাংকও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় বাড়িয়ে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমাদের ওপর ঋণের বোঝা কমানোর জন্য বড় গ্রাহকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক সময় ঋণের কেন্দ্রীভবন থেকে বেরোনো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করছি। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত ভালো আছি।
২০১৫ সালে পুনর্গঠিত বড় ঋণগুলোর সর্বশেষ অবস্থা কী?
জনতা ব্যাংকের পুনর্গঠিত ঋণের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তারাও উচ্চ আদালতে রিট করেছে।
পুনর্গঠন করা অন্য সাতটি গ্রুপের ঋণের মধ্যে দু-তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোও ঋণ নিয়মিত করেছে। ঋণ পুনর্গঠন করা কয়েক গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পুনঃতফসিল চেয়ে আবেদন করেছিল। জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে কোনো আবেদন জানানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃতফসিলের সুযোগ দেবে না বলে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা জেনেছি।
বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জনতা ব্যাংকের নাম জড়িয়েছিল। খেলাপি হওয়া সে ঋণের কী অবস্থা?
২০০৪ সাল থেকে বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এমএস হিন্দোল ওয়ালি টেক্সটাইল মিলস জনতা ব্যাংকের গ্রাহক ছিল। পরে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠান শাহরিজ কম্পোজিট টাওয়েলে জনতা ব্যাংক প্রজেক্ট ঋণ দেয়। সব মিলিয়ে বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের কাছে আমাদের ঋণ ছিল সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার মতো। পরবর্তীতে সুদ যুক্ত হওয়ায় সে ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে এ ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঋণের টাকা আদায়ে আমরা দুটি মামলা করেছি। তবে বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী ও চেয়ারম্যান নওরীন হাসিবের কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই। আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এতদিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে আলোচনা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সোনালী ব্যাংক হলমার্ক নিয়ে কিংবা জনতা ব্যাংক বিসমিল্লাহ্ কেলেঙ্কারি নিয়ে সমালোচিত হয়েছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমালোচিত। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকসহ পদচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ থেকে অন্য ব্যাংকগুলোকে শিক্ষা নিতে হবে। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোয় আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছতা এসেছে। আমরা প্রতি মাসেই জনতা ব্যাংকের এডি রেশিও পর্যালোচনা করছি। ফলে আমরা ব্যাংকের প্রকৃত তথ্য জানতে পারছি। ওভার এক্সপোজারে যাচ্ছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআরের টাকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
জনতা ব্যাংক নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
চলতি বছরে জনতা ব্যাংক একটি ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে আমরা নতুন বছর শুরু করতে চাই। যেকোনো এমডির শেষ সময়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। জনতা ব্যাংকও তার ব্যতিক্রম নয়। নতুন বছরে ব্যাংকের অভ্যন্তরে আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকের তুলনায় জনতা ব্যাংক যে ব্যতিক্রম, সেটি প্রমাণ করা হবে। বিগত দিনের ভাবমূর্তির তুলনায় ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তি উন্নত করা হবে। জনতা ব্যাংককে জনতার ব্যাংক হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। এটি আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এটিই আমার স্বপ্ন। (বণিক বার্তা)