ঢাকা , শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

বাজেটে চাপে পড়বে মধ্যবিত্ত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘বড়লোক হয়ে শুধু এক দায়! কত বড় হয়েছি তা মাপতেই দিন যায়’- প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘বড়লোক’ কবিতার এ দুটি লাইন এবারের জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে দু’ভাবে প্রযোজ্য। প্রথমত-বাজেট বক্তব্য আগের চেয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও অনেক অংশজুড়েই অর্থনীতির বড় বড় অর্জনের গুণগান। দ্বিতীয়ত-বড় বা ধনী লোকদের জন্য আরও উদার হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বড়লোকরা আরও কত বড় হবেন সেই ভাবনার খোরাক জুগিয়েছেন তিনি। তবে মধ্যবিত্তদের জন্য উদার হননি অর্থমন্ত্রী। নিজের প্রথম বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনেক পদক্ষেপ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চাপে ফেলবে। তবে গরিবদের তুষ্ট করার নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি।

জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কয়েক বছর ধরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়েনি। এবার বাজেটের আগে অনেক পক্ষের সুপারিশ ছিল, আগামী অর্থবছরে (২০১৯-২০) এ সীমা কিছুটা হলেও বাড়ানো হোক। মধ্যবিত্তের পক্ষে এ সুপারিশ বাজেট প্রস্তাবে জায়গা পায়নি। করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মধ্যবিত্তের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের চাপও বেশি পড়বে মধ্যবিত্তের ওপর। মোবাইল ফোন ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, যা মধ্যবিত্তের খরচ বাড়িয়ে দেবে। স্মার্টফোনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে, যা তরুণদের মনোকষ্টের কারণ হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে অবশ্য বলা হয়েছে, স্মার্টফোন দেশের বিত্তবান লোকজন ব্যবহার করে।

বাজেটে সয়াবিন তেল, পামওয়েল, পল্গাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা কম আয়ের লোকদের চাপে ফেলবে। পরিবহন খাতের কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুল্ক্ক-কর ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে। নন-এসি হোটেল-রেস্তোরাঁর সেবায় বাড়তি ভ্যাট কিংবা দেশি ব্র্যান্ডের পোশাক বিপণনে বাড়তি ভ্যাটের চাপ মধ্যবিত্তের ওপরই পড়বে। আসবাবপত্রের উৎপাদকদের ওপর বাড়তি ভ্যাট ও নির্মাণ সংস্থার সেবার ওপর বাড়তি ভ্যাটের ওপর প্রভাব তো ক্রেতাদের ওপরই পড়বে।

এবার ধনীদের কথায় আসি। নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেটে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসন খাতে আগে থেকেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। এ সুযোগ অব্যাহত রেখে করহার আরও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। শিল্প খাতে ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৫ বছর। ধনীরা সম্পদের ওপর যে সারচার্জ দেন, সেখানেও ছাড় এসেছে। সারচার্জ আরোপে সম্পদের নিম্নসীমা বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য ধনীদের সবকিছুতেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলা যাবে না। যেমন- ধনীদের চার্টার্ড বাহন ও হেলিকপ্টারের ওপর সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতা বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী দরিদ্র শ্রেণির প্রতি বিশেষ সুনজর দিয়েছেন। বাজেটের ১৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন সামাজিক নিরাপত্তায়। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এ পদক্ষেপের জন্য নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসা পাবেন। অনেক দিনের দাবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। উপবৃত্তির হার বাড়ানো হয়েছে। কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে মনোযোগ বাড়িয়েছেন। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির জন্য শস্যবীমা চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। ধানের দাম যাতে না কমে সে জন্য চাল আমদানির ওপর সম্প্রতি আরোপ করা বাড়তি শুল্ক্ক বহাল রাখা হয়েছে। তবে ধানের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার কারণে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কোনো ঘোষণা নেই। গবেষণা সংস্থা সিপিডি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৫ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল।

দেশের অন্যতম সমস্যা বেকারত্ব। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ কাজ পাচ্ছে না। তবে কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ তিন কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা থাকলেও ব্যাংক কমিশন গঠন করতে আরও দেরি করবেন এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কাটিয়ে ওঠার বিশেষ ঘোষণা নেই। খেলাপি ঋণ কমানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমন উক্তি অর্থমন্ত্রী এর আগেও করেছেন; কিন্তু কঠোর ব্যবস্থা কী হবে, তা আগের মতোই সুনির্দিষ্ট করেননি। বীমা খাতের প্রতি এবারের বাজেটে সুনজর রয়েছে।

গতকাল জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী দেশের ৪৮তম বাজেট উপস্থাপন করেন। তার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রার বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। ১০০ পৃষ্ঠার বক্তব্যের শুরুতে তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই বলে যে, জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের এ বিরল সুযোগ না পেলে তার জীবন অপূর্ণ হয়ে থাকত।

অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাকে একাধিকবার হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতার কারণে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাজেট বক্তব্য শেষ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আনন্দ মিছিল করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে আজ। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ধনী ও সুবিধাভোগী শ্রেণির কথা চিন্তা করেই এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে। বাম দলগুলোর নেতাদের অনেকেই বলেছেন, এই বাজেট গতানুগতিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটের ওপর বড় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। ব্যবসা শুরুর জন্য তহবিল রাখার প্রস্তাবকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন। করপোরেট কর না কমানোয় অখুশি হয়েছেন।

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ম্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ম্ফীতির এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

আয়ের লক্ষ্যমাত্রা : বাজেটে আগামী অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮০১ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুুলনায় ১১ শতাংশ ও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে তিন লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের যে প্রবণতা রয়েছে, তাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আগামী অর্থবছরে এনবিআর থেকে আসবে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআরের বাইরে থেকে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব আসবে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।

ব্যয় পরিকল্পনা : আগামী অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ব্যয়ের আগামী অর্থবছরের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ শতাংশ বেশি। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিপির আকার দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা। প্রতি বছর সরকার ব্যয়ের যে পরিকল্পনা করে, তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলে থাকেন, সরকার বাজেটের অঙ্ক বড় করে দেখায়।

বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন : আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা (অনুদান ছাড়া) হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। অনুদান পাওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতির আকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

বাজেটে চাপে পড়বে মধ্যবিত্ত

আপডেট টাইম : ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুন ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘বড়লোক হয়ে শুধু এক দায়! কত বড় হয়েছি তা মাপতেই দিন যায়’- প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘বড়লোক’ কবিতার এ দুটি লাইন এবারের জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে দু’ভাবে প্রযোজ্য। প্রথমত-বাজেট বক্তব্য আগের চেয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও অনেক অংশজুড়েই অর্থনীতির বড় বড় অর্জনের গুণগান। দ্বিতীয়ত-বড় বা ধনী লোকদের জন্য আরও উদার হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বড়লোকরা আরও কত বড় হবেন সেই ভাবনার খোরাক জুগিয়েছেন তিনি। তবে মধ্যবিত্তদের জন্য উদার হননি অর্থমন্ত্রী। নিজের প্রথম বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনেক পদক্ষেপ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে চাপে ফেলবে। তবে গরিবদের তুষ্ট করার নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি।

জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কয়েক বছর ধরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়েনি। এবার বাজেটের আগে অনেক পক্ষের সুপারিশ ছিল, আগামী অর্থবছরে (২০১৯-২০) এ সীমা কিছুটা হলেও বাড়ানো হোক। মধ্যবিত্তের পক্ষে এ সুপারিশ বাজেট প্রস্তাবে জায়গা পায়নি। করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। মধ্যবিত্তের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হলো, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের চাপও বেশি পড়বে মধ্যবিত্তের ওপর। মোবাইল ফোন ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, যা মধ্যবিত্তের খরচ বাড়িয়ে দেবে। স্মার্টফোনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে, যা তরুণদের মনোকষ্টের কারণ হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে অবশ্য বলা হয়েছে, স্মার্টফোন দেশের বিত্তবান লোকজন ব্যবহার করে।

বাজেটে সয়াবিন তেল, পামওয়েল, পল্গাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা কম আয়ের লোকদের চাপে ফেলবে। পরিবহন খাতের কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুল্ক্ক-কর ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে। নন-এসি হোটেল-রেস্তোরাঁর সেবায় বাড়তি ভ্যাট কিংবা দেশি ব্র্যান্ডের পোশাক বিপণনে বাড়তি ভ্যাটের চাপ মধ্যবিত্তের ওপরই পড়বে। আসবাবপত্রের উৎপাদকদের ওপর বাড়তি ভ্যাট ও নির্মাণ সংস্থার সেবার ওপর বাড়তি ভ্যাটের ওপর প্রভাব তো ক্রেতাদের ওপরই পড়বে।

এবার ধনীদের কথায় আসি। নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেটে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসন খাতে আগে থেকেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। এ সুযোগ অব্যাহত রেখে করহার আরও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। শিল্প খাতে ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৫ বছর। ধনীরা সম্পদের ওপর যে সারচার্জ দেন, সেখানেও ছাড় এসেছে। সারচার্জ আরোপে সম্পদের নিম্নসীমা বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য ধনীদের সবকিছুতেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলা যাবে না। যেমন- ধনীদের চার্টার্ড বাহন ও হেলিকপ্টারের ওপর সম্পূরক শুল্ক্ক বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতা বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী দরিদ্র শ্রেণির প্রতি বিশেষ সুনজর দিয়েছেন। বাজেটের ১৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন সামাজিক নিরাপত্তায়। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এ পদক্ষেপের জন্য নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসা পাবেন। অনেক দিনের দাবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। উপবৃত্তির হার বাড়ানো হয়েছে। কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে মনোযোগ বাড়িয়েছেন। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির জন্য শস্যবীমা চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। ধানের দাম যাতে না কমে সে জন্য চাল আমদানির ওপর সম্প্রতি আরোপ করা বাড়তি শুল্ক্ক বহাল রাখা হয়েছে। তবে ধানের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার কারণে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কোনো ঘোষণা নেই। গবেষণা সংস্থা সিপিডি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৫ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল।

দেশের অন্যতম সমস্যা বেকারত্ব। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ কাজ পাচ্ছে না। তবে কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ তিন কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা থাকলেও ব্যাংক কমিশন গঠন করতে আরও দেরি করবেন এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কাটিয়ে ওঠার বিশেষ ঘোষণা নেই। খেলাপি ঋণ কমানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমন উক্তি অর্থমন্ত্রী এর আগেও করেছেন; কিন্তু কঠোর ব্যবস্থা কী হবে, তা আগের মতোই সুনির্দিষ্ট করেননি। বীমা খাতের প্রতি এবারের বাজেটে সুনজর রয়েছে।

গতকাল জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী দেশের ৪৮তম বাজেট উপস্থাপন করেন। তার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রার বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’। ১০০ পৃষ্ঠার বক্তব্যের শুরুতে তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই বলে যে, জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের এ বিরল সুযোগ না পেলে তার জীবন অপূর্ণ হয়ে থাকত।

অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাকে একাধিকবার হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতার কারণে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাজেট বক্তব্য শেষ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আনন্দ মিছিল করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে আজ। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ধনী ও সুবিধাভোগী শ্রেণির কথা চিন্তা করেই এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে। বাম দলগুলোর নেতাদের অনেকেই বলেছেন, এই বাজেট গতানুগতিক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটের ওপর বড় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। ব্যবসা শুরুর জন্য তহবিল রাখার প্রস্তাবকে তারা স্বাগত জানিয়েছেন। করপোরেট কর না কমানোয় অখুশি হয়েছেন।

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ম্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ম্ফীতির এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

আয়ের লক্ষ্যমাত্রা : বাজেটে আগামী অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮০১ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুুলনায় ১১ শতাংশ ও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে তিন লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের যে প্রবণতা রয়েছে, তাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আগামী অর্থবছরে এনবিআর থেকে আসবে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআরের বাইরে থেকে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব আসবে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।

ব্যয় পরিকল্পনা : আগামী অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ব্যয়ের আগামী অর্থবছরের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ শতাংশ বেশি। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিপির আকার দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা। প্রতি বছর সরকার ব্যয়ের যে পরিকল্পনা করে, তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলে থাকেন, সরকার বাজেটের অঙ্ক বড় করে দেখায়।

বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন : আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা (অনুদান ছাড়া) হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। অনুদান পাওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতির আকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা।