ঢাকা , রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের প্রিয় ঢেঁকিশাক কি বিষাক্ত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ফার্ণ ৩৫ কোটি বছরের পুরনো উদ্ভিদ। তবে আমরা যে ঢেঁকিশাক খাই তা অত পুরনো নয়, বিবর্তিত হয়ে এ পর্যায়ে আসতে অনেক সময় লেগেছে এর।

ঢেঁকিশাক জন্মে না এমন জায়গা দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া ভার। পাহাড়ে, সমতলে, পানিতে, গাছের ওপর, পাথরের ফাটলে সর্বত্রই ফার্ণ জন্মে। শুধু তপ্ত বালুতে ঢাকা মরু আর শীতল বরফে ঢাকা তুন্দ্রা অঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, দেশে-বিদেশে বেশ কিছু ঢেঁকিশাক রয়েছে যা বিষাক্ত, যার মধ্যে ব্র্যাকেন ফার্ণই সবচে বেশি আলোচিত। মানুষ ছাড়াও এগুলোর বিষাক্ত পাতা খেয়ে গৃহপালিত প্রাণীরা অসুস্থ হয়েছে, বিশেষ করে ঘোড়া। অবশ্য ঘোড়ার এক ধরনের আসক্তিও আছে এই গাছের প্রতি, নির্বিষ ভালো খাবার মুখের কাছে পেলেও সে এটা খাবেই খাবে। খেয়ে পস্তাবে, এমনকি জীবনও দেবে। এই বিষে অবশ্য জাবর কাটা প্রাণীদের তেমন ক্ষতি হয় না। কারণ, তাদের পাকস্থলিতে এটা অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়। এই বিষের নাম টেকিলোসাইড (Ptequiloside), সংক্ষেপে যা PTQ.

আশির দশকে ড্যানিশ বিজ্ঞানী রাস্‌মুসেন তার একটি আবিষ্কার দিয়ে মানুষকে এই বিষ সম্পর্কে সচকিত করে তোলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, যুক্তরাজ্যের ওয়েল্‌সের গাইনেড জনপদে বৃষ্টির পানিতে ফার্ণের পাতা থেকে ধুয়ে এই বিষ জলাধারে চলে যায়, আর পাইপ লাইনে লিকেজের কারণে মিশে যায় সাপ্লাইয়ের পানিতেও। রোজ রোজ সেই পানি খেয়ে মানুষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে।

গবাদি পশু ক্ষুধা নিবারণের জন্যে ঘাস-বিচালি না থাকলে অনেক সময় ফার্ণের পাতা খায়। বসন্ত কালের কচি ফার্ণের ডগা, হয়তো বা এমনিতেই রুচি করে খায়। পাতা খাবার পরে এই বিষ নষ্ট না হয়ে গবাদি পশুর দুধের ভেতর চলে আসে। পশুখামারের কর্মচারীরা দুধ থেকে মাখন তোলার পর উপাদেয় ঘোলটুকু রেখে দেন নিজেদের ও পরিবারের জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ঘোলেই থাকে দ্রবীভূত ও ঘণীভূত টেকিলোসাইড।

আমরা সাধারণত ঢেঁকিশাকের কচি ডাঁটাসহ ডগাটা খাই, যেটা দেখতে বেহালার মাথার মতো গোল হয়ে থাকে। বাঙালিদের একটি ভালো অভ্যাস হলো, কোনো জংলি জিনিস পারতপক্ষে তারা কাঁচা খায় না। এই অভ্যাস না থাকলে তারা বহুল পরিমাণে ক্যান্সার রোগের শিকার হতে পারতো। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাকস্থলির ক্যান্সার হয় জাপান ও কোরিয়ায়। কারণ, এই দু’দেশেই সালাদের সঙ্গে কাঁচা ঢেঁকিশাকের ডগা খাওয়া হয়।

ঢেঁকিশাকের ভেতর শুধু যে টেকিলোসাইড থাকে তা নয়, এতে থাকে আরো দুটো মারাত্মক বিষ, যার একটি হল থায়ামিনেজ। এটা খেলে শরীরে ভিটামিন বি-১ এর প্রচণ্ড ঘাটতি হয়ে বেরিবেরি রোগ দেখা দেয়, সিনহালিজ ভাষায় যার অর্থ ‘আমি পারি না, আমি পারি না’। এমন অদ্ভুত নামের কারণ হয়ত, এই রোগে পায়ে অসাড়তা আসে বলে মানুষ ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না।

পোল্যান্ডের রসায়নবিদ ক্যাসিমির ফাঙ্ক ভিটামিনসমৃদ্ধ লালচালের ফ্যান খাইয়ে এই রোগ দূর করেন এবং বলেন, এটা হচ্ছে Vital Amine, যেখান থেকে Vitamine শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

অনেক সময় ফার্ণের কচি পাতা বা ফ্রন্ড ভাংলে একটু বাদামের মতো গন্ধ আসে। এমন গন্ধ নাকে এলে বুঝতে হবে এর ভেতর হাইড্রোজেন সায়ানাইড আছে, যা এক ধরনের তীব্র বিষ। এই বিষ যে মানুষের জন্যে কেমন ক্ষতিকর তা বলাই বাহুল্য। এটা ব্যবহার করা হয় তিমি শিকারের হার্পুনে এবং কীটনাশক হিশেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে এটা ব্যবহার হয়েছে গ্যাস চেম্বারে গণহত্যার জন্যে এবং রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র হিশেবে।

কোনো কোনো সময় এমনও দেখা যায় একই জাতীয় ফার্ণের এক গাছে বিষ আছে আবার আরেক গাছে নেই। আমাদের দেশের ছাগল যখন আমপাতা কাঁঠাল পাতা কিছু পায় না তখন ফার্ণের কচি পাতা খায়, কিন্তু মরে না, অসুস্থও হয় না। এর কারণ, ছাগল গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে কোন পাতায় সায়ানাইড আছে আর কোন পাতায় নাই। জাবরকাটা প্রাণীদের রয়েছে পাকস্থলিতে বিষ নষ্ট করার ক্ষমতা।

আমাদের দেশের মানুষ এই ফার্ণ বিষাক্ত হলেও খেয়ে অভ্যস্ত। রান্নায় তাপের কারণে নষ্ট হয় কিছু বিষ। আর এমন তো নয় যে কেউ দিনের পর দিন এগুলো খেতে থাকে খেশারির ডালের মতো, যেটা খেলে ল্যাথিরিজম হতে পারে। ফার্ণের পুষ্ট পাতা যার নিচের দিকে স্পোর থাকে তা কখনো খাওয়া ঠিক নয়, কারণ স্পোর Carcenogenic, যা খেলে ক্যান্সার হতে পারে।

আলোচ্য বিষয়গুলো খেয়াল রাখা ভালো। বিতর্কিত কোনো ভেষজই না জেনে খাওয়া ঠিক নয়।

ব্র্যাকেন ফার্ণ, অস্ট্রিচ ফার্ণ, লেডি ফার্ণ, দারুচিনি ফার্ণ প্রভৃতি ছাড়াও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আরো প্রায় ৪০ ধরনের এদেশীয় ফার্ণ পরীক্ষা করে দেখেছেন, যার ভেতরে আছে টেকিলোসাইড অথবা ওইজাতীয় কোনো বিষাক্ত রসায়ন। কোন ফার্ণ খাওয়া যাবে, বা যাবে না, তা নির্ধারণের জন্যে আমাদের দেশে ফার্ণ বিশেষজ্ঞ বা টেরিডোলজিস্টও নেই, কাজেও ঢেঁকিশাক খাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। শুধু একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কটূগন্ধ কোনো ফার্ণ এড়িয়ে যেতে হবে, স্পোর এবং পুষ্ট পাতা বাদ দিয়ে কচি ফ্রন্ড খেতে হবে এবং একনাগাড়ে অনেকদিন ধরে খাওয়া যাবে না, এমন কি এক সপ্তাহ ধরেও।

মনে রাখবেন, ঘাঘরা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, আমরুল শাকে যখন ফুল হয় তখন শাকে টেকিলোসাইড জমা হয়ে বিষাক্ত হয়ে যায়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

আমাদের প্রিয় ঢেঁকিশাক কি বিষাক্ত

আপডেট টাইম : ১০:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ফার্ণ ৩৫ কোটি বছরের পুরনো উদ্ভিদ। তবে আমরা যে ঢেঁকিশাক খাই তা অত পুরনো নয়, বিবর্তিত হয়ে এ পর্যায়ে আসতে অনেক সময় লেগেছে এর।

ঢেঁকিশাক জন্মে না এমন জায়গা দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া ভার। পাহাড়ে, সমতলে, পানিতে, গাছের ওপর, পাথরের ফাটলে সর্বত্রই ফার্ণ জন্মে। শুধু তপ্ত বালুতে ঢাকা মরু আর শীতল বরফে ঢাকা তুন্দ্রা অঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, দেশে-বিদেশে বেশ কিছু ঢেঁকিশাক রয়েছে যা বিষাক্ত, যার মধ্যে ব্র্যাকেন ফার্ণই সবচে বেশি আলোচিত। মানুষ ছাড়াও এগুলোর বিষাক্ত পাতা খেয়ে গৃহপালিত প্রাণীরা অসুস্থ হয়েছে, বিশেষ করে ঘোড়া। অবশ্য ঘোড়ার এক ধরনের আসক্তিও আছে এই গাছের প্রতি, নির্বিষ ভালো খাবার মুখের কাছে পেলেও সে এটা খাবেই খাবে। খেয়ে পস্তাবে, এমনকি জীবনও দেবে। এই বিষে অবশ্য জাবর কাটা প্রাণীদের তেমন ক্ষতি হয় না। কারণ, তাদের পাকস্থলিতে এটা অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়। এই বিষের নাম টেকিলোসাইড (Ptequiloside), সংক্ষেপে যা PTQ.

আশির দশকে ড্যানিশ বিজ্ঞানী রাস্‌মুসেন তার একটি আবিষ্কার দিয়ে মানুষকে এই বিষ সম্পর্কে সচকিত করে তোলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, যুক্তরাজ্যের ওয়েল্‌সের গাইনেড জনপদে বৃষ্টির পানিতে ফার্ণের পাতা থেকে ধুয়ে এই বিষ জলাধারে চলে যায়, আর পাইপ লাইনে লিকেজের কারণে মিশে যায় সাপ্লাইয়ের পানিতেও। রোজ রোজ সেই পানি খেয়ে মানুষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে।

গবাদি পশু ক্ষুধা নিবারণের জন্যে ঘাস-বিচালি না থাকলে অনেক সময় ফার্ণের পাতা খায়। বসন্ত কালের কচি ফার্ণের ডগা, হয়তো বা এমনিতেই রুচি করে খায়। পাতা খাবার পরে এই বিষ নষ্ট না হয়ে গবাদি পশুর দুধের ভেতর চলে আসে। পশুখামারের কর্মচারীরা দুধ থেকে মাখন তোলার পর উপাদেয় ঘোলটুকু রেখে দেন নিজেদের ও পরিবারের জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ঘোলেই থাকে দ্রবীভূত ও ঘণীভূত টেকিলোসাইড।

আমরা সাধারণত ঢেঁকিশাকের কচি ডাঁটাসহ ডগাটা খাই, যেটা দেখতে বেহালার মাথার মতো গোল হয়ে থাকে। বাঙালিদের একটি ভালো অভ্যাস হলো, কোনো জংলি জিনিস পারতপক্ষে তারা কাঁচা খায় না। এই অভ্যাস না থাকলে তারা বহুল পরিমাণে ক্যান্সার রোগের শিকার হতে পারতো। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাকস্থলির ক্যান্সার হয় জাপান ও কোরিয়ায়। কারণ, এই দু’দেশেই সালাদের সঙ্গে কাঁচা ঢেঁকিশাকের ডগা খাওয়া হয়।

ঢেঁকিশাকের ভেতর শুধু যে টেকিলোসাইড থাকে তা নয়, এতে থাকে আরো দুটো মারাত্মক বিষ, যার একটি হল থায়ামিনেজ। এটা খেলে শরীরে ভিটামিন বি-১ এর প্রচণ্ড ঘাটতি হয়ে বেরিবেরি রোগ দেখা দেয়, সিনহালিজ ভাষায় যার অর্থ ‘আমি পারি না, আমি পারি না’। এমন অদ্ভুত নামের কারণ হয়ত, এই রোগে পায়ে অসাড়তা আসে বলে মানুষ ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না।

পোল্যান্ডের রসায়নবিদ ক্যাসিমির ফাঙ্ক ভিটামিনসমৃদ্ধ লালচালের ফ্যান খাইয়ে এই রোগ দূর করেন এবং বলেন, এটা হচ্ছে Vital Amine, যেখান থেকে Vitamine শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

অনেক সময় ফার্ণের কচি পাতা বা ফ্রন্ড ভাংলে একটু বাদামের মতো গন্ধ আসে। এমন গন্ধ নাকে এলে বুঝতে হবে এর ভেতর হাইড্রোজেন সায়ানাইড আছে, যা এক ধরনের তীব্র বিষ। এই বিষ যে মানুষের জন্যে কেমন ক্ষতিকর তা বলাই বাহুল্য। এটা ব্যবহার করা হয় তিমি শিকারের হার্পুনে এবং কীটনাশক হিশেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে এটা ব্যবহার হয়েছে গ্যাস চেম্বারে গণহত্যার জন্যে এবং রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র হিশেবে।

কোনো কোনো সময় এমনও দেখা যায় একই জাতীয় ফার্ণের এক গাছে বিষ আছে আবার আরেক গাছে নেই। আমাদের দেশের ছাগল যখন আমপাতা কাঁঠাল পাতা কিছু পায় না তখন ফার্ণের কচি পাতা খায়, কিন্তু মরে না, অসুস্থও হয় না। এর কারণ, ছাগল গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে কোন পাতায় সায়ানাইড আছে আর কোন পাতায় নাই। জাবরকাটা প্রাণীদের রয়েছে পাকস্থলিতে বিষ নষ্ট করার ক্ষমতা।

আমাদের দেশের মানুষ এই ফার্ণ বিষাক্ত হলেও খেয়ে অভ্যস্ত। রান্নায় তাপের কারণে নষ্ট হয় কিছু বিষ। আর এমন তো নয় যে কেউ দিনের পর দিন এগুলো খেতে থাকে খেশারির ডালের মতো, যেটা খেলে ল্যাথিরিজম হতে পারে। ফার্ণের পুষ্ট পাতা যার নিচের দিকে স্পোর থাকে তা কখনো খাওয়া ঠিক নয়, কারণ স্পোর Carcenogenic, যা খেলে ক্যান্সার হতে পারে।

আলোচ্য বিষয়গুলো খেয়াল রাখা ভালো। বিতর্কিত কোনো ভেষজই না জেনে খাওয়া ঠিক নয়।

ব্র্যাকেন ফার্ণ, অস্ট্রিচ ফার্ণ, লেডি ফার্ণ, দারুচিনি ফার্ণ প্রভৃতি ছাড়াও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আরো প্রায় ৪০ ধরনের এদেশীয় ফার্ণ পরীক্ষা করে দেখেছেন, যার ভেতরে আছে টেকিলোসাইড অথবা ওইজাতীয় কোনো বিষাক্ত রসায়ন। কোন ফার্ণ খাওয়া যাবে, বা যাবে না, তা নির্ধারণের জন্যে আমাদের দেশে ফার্ণ বিশেষজ্ঞ বা টেরিডোলজিস্টও নেই, কাজেও ঢেঁকিশাক খাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। শুধু একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কটূগন্ধ কোনো ফার্ণ এড়িয়ে যেতে হবে, স্পোর এবং পুষ্ট পাতা বাদ দিয়ে কচি ফ্রন্ড খেতে হবে এবং একনাগাড়ে অনেকদিন ধরে খাওয়া যাবে না, এমন কি এক সপ্তাহ ধরেও।

মনে রাখবেন, ঘাঘরা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, আমরুল শাকে যখন ফুল হয় তখন শাকে টেকিলোসাইড জমা হয়ে বিষাক্ত হয়ে যায়।