ঢাকা , রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউরোপে এখন সামার

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ সৃষ্টির রহস্য নিয়ে বেশ ভাবছি। আনন্দ লাগছে। কী চমৎকার চিন্তা-চেতনার ভাণ্ডার স্রষ্টা বসিয়ে দিয়েছেন আমাদের দেহের ওপরে। মুখ থেকে যেকোনো একটি কথা হতে পারে একটি রাসায়নিক বোমার মতো, যা করতে পারে জাপানের হিরোশিমার মতো কারও মনকে ধ্বংস।

আবার একটি সুন্দর কথা করতে পারে পরিবর্তন পুরো জীবনকে। এই মুখটির অতি কাছে রয়েছে দুটি চোখ, রয়েছে নাক এবং দুটি কান। মন, প্রাণ, ভাবনা এবং চিন্তা সবই ডেলিভারি হয় মুখ দিয়ে। তার মানে আমাদের পুরো চিন্তা এবং কর্মের ফলাফল মুখের বাণীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

মুখ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম তাকে সঠিকভাবে যত্ন করে রাখার দায়িত্ব আমার নিজের। জীবনের এই দায়িত্বটাই ঠিকমতো পালন করতে যদি না পারি তাহলে অন্যের দায়িত্ব বা একটি দেশ বা বিশ্বের দায়িত্ব নেবো কীভাবে!

লকডাউনে শুধু লকডাউন না থেকে ঘোরাঘুরি করছি, স্রষ্টাকে অনুভব করছি। সহধর্মিণীর ছুটি। তার সঙ্গে মন, প্রাণ দিয়ে ঘুরছি। জীবনের বর্তমান সময়টিকে উপভোগ করছি। নিখিলের এত শোভা এত রূপ! আহ! দেখছি আর ভাবছি। ভাবছি আর দেখছি। সবকিছু নতুন মনে হচ্ছে।

ইউরোপের দেশ সুইডেন চার ঋতুর দেশ। জুন, জুলাই এবং অগাস্ট এই তিন মাস এখানে সামার। জুন মাসের ১৫ তারিখ অবধি বেশ ঠাণ্ডা ছিল, তারপর মাঝেমধ্যে বাতাস ও বৃষ্টি হয়েছে। ২০ জুন সুইডিশ মিডসামারের পর থেকে ওয়েদার চমৎকার। এবারের সামার বেশ আলাদা অন্যান্য বছরের তুলনায়।

সুইডিশ জাতি সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে সময় কাটায়, বিধায় তাদের সবাইকে একসঙ্গে লোকালয়ে, লেকের ধারে বা সাগরের পাড়ে দেখা মেলেনি। যা এবার বেশ চোখে পড়ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে লেক, মেলারেন (ছোট ছোট লেকের সমন্বয়) এবং সাগরের কুলে।

লেখক রহমান মৃধা পারিবারিক আড্ডায়

আমি এবং আমার স্ত্রীর গতকাল থেকে চেনা-অচেনা জায়গাগুলো নতুন করে আবিষ্কার করছি। গতকাল স্টকহোমের হগা পার্ক ঘুরেছি। ১৭৮৩ সালে সুইডেনের তৃতীয় রাজা কার্ল গুসতাভ পার্কটিকে তাঁর মনঃপূত করে সাজিয়ে গেছেন।

সেই ১৭৮৩ সালে প্রায় ৩০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন যা এখনও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও পার্কটি ওয়াইল্ড পার্ক বলে পরিচিত, তা সত্ত্বেও সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। পার্কের তিন পাশ দিয়ে পানি। একপাশে রয়েছে সোলনা শহর যা পরস্পরকে রূপে এবং সৌন্দর্যে জড়িয়ে রেখেছে।

পরিবার, বন্ধু, বান্ধবী বা একাকী যেখানে-সেখানে রোদের মধ্যে শুয়ে আছে। কেউ কেউ শুধু বিকিনি আবার কখনও শুধু নিচের অংশ পরে মনের আনন্দে মেতে আছে। সূর্যের আলো এদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কারণ তিন মাস সামার থাকা সত্ত্বেও জানা মুশকিল কখন, কতক্ষণ বা কতদিন সূর্য পাওয়া যাব তা কেউ জানে না। এছাড়া আবহাওয়া অফিস হয়ত বললো বৃষ্টি হবে কিন্তু দেখা গেলো রৌদ উঠেছে। তাই এখানে প্রতিটিক্ষণ জীবনের এক আনন্দঘন মুহূর্ত যদি সূর্যের মুখটা দেয়া যায়।

শরীরে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘ডি’ সঙ্গে সাদা ধবধবে চামড়াকে রোদে পুড়িয়ে সোনালী অথবা বাদামি করা যা চেহারার সৌন্দর্যকে অপরূপ করতে সাহায্য করে। দিন অনেক বড় বিধায় সন্ধ্যা বা অন্ধকার রাত দশটার আগে হয় না। এসময় সবাই বাইরে গ্রিল বা বার্বিকিউ করে।

আমি নিজেই বলতে গেলে প্রতিদিনই আমাদের বাড়ির পেছনের গার্ডেনে ডিনারের আয়োজন করি। বাইরে রান্না করা এবং একসঙ্গে মিলেমিশে বার্বিকিউ করা, পরস্পর পরস্পরকে চেনা জানারও একটি চমৎকার সময় এখন।

সুইডিশ জাতি সামারে বেশ বই পড়ে। তবে বর্তমানে স্মার্টফোনের কারণে সময় ব্যয় হয় সেখানেই বেশি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মানুষই প্রকৃতিকে সত্যিই মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করে।

এবার অন্য বছরের মতো যখন তখন যেখানে খুশি যাওয়া যাবে না করোনার কারণে। ভাবছি সুইডেনকেই মন ভরে দেখবো। বোটে করে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ ভ্রমণ করবো। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে যখন ঘরে ফিরবো তখন বেলা ডুবে যাবে ঠিকই, তবে সন্ধ্যা আর অন্ধকার হবে না সামারের এই সময়টি।

এই যা লিখতে বসেছি ওদিকে রাত অনেক হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হোতরিয়েতে বাজার করতে যেতে হবে। কাল বিকেলে দুইজন নতুন মেহমান আসবে। তাদের একজনের বাড়ি ইরান এবং অন্যজনের বাড়ি ইরাকে।

জন্মসূত্রে একজন শিয়া, অন্যজন সুন্নি। বর্তমানে থাকে সুইডেনে। একজন কেমিস্ট অন্যজন ডাক্তার এবং বিয়ে করেছে একে অপরকে এখানে। পারিবারিকভাবে দুই দেশের রাজনীতি এবং রীতিনীতি জীবনের জন্য কিছুটা বাঁধা, যার কারণে নিজ নিজ দেশ ছেড়ে তাদের বসবাস এখন সুইডেনে।

কোনো এক সময় আমার স্ত্রী আলির স্ত্রী ইলাফকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে তাদের জানাশোনা। আমি তাদের এর আগে দেখিনি, আজ দেখা হবে বাড়ির বাগানে। ভ্রমণ এবং ছুটির দিনগুলোতে অনেক কিছু দেখছি, বেশ এক্সাইটেড।

আজকের মেহমানদের আগমনের কথা শুনে আমার তেমন আনন্দ লাগেনি, কারণ আরব দেশের মানুষের প্রতি আমার আবার দুর্বলতা কম। কারণ সব কিছু দেখে শুনে কেন যেন এমনটি হয়েছে।

আমার স্ত্রী বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। সে আমাকে বলেছে, “মানুষের যত বড় উপকারই করোনা কেন, কোনো এক সময় তোমার সামান্য ভুলের কারণে তারা সব ভুলে যাবে। এসব জেনেশুনেই মানুষের সঙ্গে মিশবে। তাহলে মন খারাপ হবে না। জীবনে একটি জিনিষ মনে রাখতে হবে তা হোল অন্য কেও খারাপ বা অধম বলে তোমাকেও যে তার মত হতে হবে এমন কোন কথা নেই।” তাঁর এই কথাটি মনে বেশ ধরেছে।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ইউরোপে এখন সামার

আপডেট টাইম : ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুন ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ সৃষ্টির রহস্য নিয়ে বেশ ভাবছি। আনন্দ লাগছে। কী চমৎকার চিন্তা-চেতনার ভাণ্ডার স্রষ্টা বসিয়ে দিয়েছেন আমাদের দেহের ওপরে। মুখ থেকে যেকোনো একটি কথা হতে পারে একটি রাসায়নিক বোমার মতো, যা করতে পারে জাপানের হিরোশিমার মতো কারও মনকে ধ্বংস।

আবার একটি সুন্দর কথা করতে পারে পরিবর্তন পুরো জীবনকে। এই মুখটির অতি কাছে রয়েছে দুটি চোখ, রয়েছে নাক এবং দুটি কান। মন, প্রাণ, ভাবনা এবং চিন্তা সবই ডেলিভারি হয় মুখ দিয়ে। তার মানে আমাদের পুরো চিন্তা এবং কর্মের ফলাফল মুখের বাণীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

মুখ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম তাকে সঠিকভাবে যত্ন করে রাখার দায়িত্ব আমার নিজের। জীবনের এই দায়িত্বটাই ঠিকমতো পালন করতে যদি না পারি তাহলে অন্যের দায়িত্ব বা একটি দেশ বা বিশ্বের দায়িত্ব নেবো কীভাবে!

লকডাউনে শুধু লকডাউন না থেকে ঘোরাঘুরি করছি, স্রষ্টাকে অনুভব করছি। সহধর্মিণীর ছুটি। তার সঙ্গে মন, প্রাণ দিয়ে ঘুরছি। জীবনের বর্তমান সময়টিকে উপভোগ করছি। নিখিলের এত শোভা এত রূপ! আহ! দেখছি আর ভাবছি। ভাবছি আর দেখছি। সবকিছু নতুন মনে হচ্ছে।

ইউরোপের দেশ সুইডেন চার ঋতুর দেশ। জুন, জুলাই এবং অগাস্ট এই তিন মাস এখানে সামার। জুন মাসের ১৫ তারিখ অবধি বেশ ঠাণ্ডা ছিল, তারপর মাঝেমধ্যে বাতাস ও বৃষ্টি হয়েছে। ২০ জুন সুইডিশ মিডসামারের পর থেকে ওয়েদার চমৎকার। এবারের সামার বেশ আলাদা অন্যান্য বছরের তুলনায়।

সুইডিশ জাতি সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে সময় কাটায়, বিধায় তাদের সবাইকে একসঙ্গে লোকালয়ে, লেকের ধারে বা সাগরের পাড়ে দেখা মেলেনি। যা এবার বেশ চোখে পড়ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে লেক, মেলারেন (ছোট ছোট লেকের সমন্বয়) এবং সাগরের কুলে।

লেখক রহমান মৃধা পারিবারিক আড্ডায়

আমি এবং আমার স্ত্রীর গতকাল থেকে চেনা-অচেনা জায়গাগুলো নতুন করে আবিষ্কার করছি। গতকাল স্টকহোমের হগা পার্ক ঘুরেছি। ১৭৮৩ সালে সুইডেনের তৃতীয় রাজা কার্ল গুসতাভ পার্কটিকে তাঁর মনঃপূত করে সাজিয়ে গেছেন।

সেই ১৭৮৩ সালে প্রায় ৩০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন যা এখনও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও পার্কটি ওয়াইল্ড পার্ক বলে পরিচিত, তা সত্ত্বেও সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। পার্কের তিন পাশ দিয়ে পানি। একপাশে রয়েছে সোলনা শহর যা পরস্পরকে রূপে এবং সৌন্দর্যে জড়িয়ে রেখেছে।

পরিবার, বন্ধু, বান্ধবী বা একাকী যেখানে-সেখানে রোদের মধ্যে শুয়ে আছে। কেউ কেউ শুধু বিকিনি আবার কখনও শুধু নিচের অংশ পরে মনের আনন্দে মেতে আছে। সূর্যের আলো এদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কারণ তিন মাস সামার থাকা সত্ত্বেও জানা মুশকিল কখন, কতক্ষণ বা কতদিন সূর্য পাওয়া যাব তা কেউ জানে না। এছাড়া আবহাওয়া অফিস হয়ত বললো বৃষ্টি হবে কিন্তু দেখা গেলো রৌদ উঠেছে। তাই এখানে প্রতিটিক্ষণ জীবনের এক আনন্দঘন মুহূর্ত যদি সূর্যের মুখটা দেয়া যায়।

শরীরে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘ডি’ সঙ্গে সাদা ধবধবে চামড়াকে রোদে পুড়িয়ে সোনালী অথবা বাদামি করা যা চেহারার সৌন্দর্যকে অপরূপ করতে সাহায্য করে। দিন অনেক বড় বিধায় সন্ধ্যা বা অন্ধকার রাত দশটার আগে হয় না। এসময় সবাই বাইরে গ্রিল বা বার্বিকিউ করে।

আমি নিজেই বলতে গেলে প্রতিদিনই আমাদের বাড়ির পেছনের গার্ডেনে ডিনারের আয়োজন করি। বাইরে রান্না করা এবং একসঙ্গে মিলেমিশে বার্বিকিউ করা, পরস্পর পরস্পরকে চেনা জানারও একটি চমৎকার সময় এখন।

সুইডিশ জাতি সামারে বেশ বই পড়ে। তবে বর্তমানে স্মার্টফোনের কারণে সময় ব্যয় হয় সেখানেই বেশি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মানুষই প্রকৃতিকে সত্যিই মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করে।

এবার অন্য বছরের মতো যখন তখন যেখানে খুশি যাওয়া যাবে না করোনার কারণে। ভাবছি সুইডেনকেই মন ভরে দেখবো। বোটে করে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ ভ্রমণ করবো। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে যখন ঘরে ফিরবো তখন বেলা ডুবে যাবে ঠিকই, তবে সন্ধ্যা আর অন্ধকার হবে না সামারের এই সময়টি।

এই যা লিখতে বসেছি ওদিকে রাত অনেক হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হোতরিয়েতে বাজার করতে যেতে হবে। কাল বিকেলে দুইজন নতুন মেহমান আসবে। তাদের একজনের বাড়ি ইরান এবং অন্যজনের বাড়ি ইরাকে।

জন্মসূত্রে একজন শিয়া, অন্যজন সুন্নি। বর্তমানে থাকে সুইডেনে। একজন কেমিস্ট অন্যজন ডাক্তার এবং বিয়ে করেছে একে অপরকে এখানে। পারিবারিকভাবে দুই দেশের রাজনীতি এবং রীতিনীতি জীবনের জন্য কিছুটা বাঁধা, যার কারণে নিজ নিজ দেশ ছেড়ে তাদের বসবাস এখন সুইডেনে।

কোনো এক সময় আমার স্ত্রী আলির স্ত্রী ইলাফকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে তাদের জানাশোনা। আমি তাদের এর আগে দেখিনি, আজ দেখা হবে বাড়ির বাগানে। ভ্রমণ এবং ছুটির দিনগুলোতে অনেক কিছু দেখছি, বেশ এক্সাইটেড।

আজকের মেহমানদের আগমনের কথা শুনে আমার তেমন আনন্দ লাগেনি, কারণ আরব দেশের মানুষের প্রতি আমার আবার দুর্বলতা কম। কারণ সব কিছু দেখে শুনে কেন যেন এমনটি হয়েছে।

আমার স্ত্রী বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। সে আমাকে বলেছে, “মানুষের যত বড় উপকারই করোনা কেন, কোনো এক সময় তোমার সামান্য ভুলের কারণে তারা সব ভুলে যাবে। এসব জেনেশুনেই মানুষের সঙ্গে মিশবে। তাহলে মন খারাপ হবে না। জীবনে একটি জিনিষ মনে রাখতে হবে তা হোল অন্য কেও খারাপ বা অধম বলে তোমাকেও যে তার মত হতে হবে এমন কোন কথা নেই।” তাঁর এই কথাটি মনে বেশ ধরেছে।

রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com