ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কচুরিপানা খাবার কথা কেউ বিবেচনা করলাম না কেন

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কচুরিপানা খাওয়া যায়। না, আমি ফুলের কথা বলছি না, কচুরিপানার সবুজ পাতা আর কাণ্ডের কথা বলছি। এ ইনফরমেশন এ যুগে যে কেউ গুগল করলেই দেখতে পারেন কচুরিপানার খাদ্যমূল্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গবেষণা করেছে।

এর পুষ্টিমূল্য এমন যে এতে প্রোটিন আছে ১৮ শতাংশ, শর্করা ৩৬ শতাংশ, ফাইবার ১৭ শতাংশ, আছে ভিটামিন এ, বি১, বি২। তাইওয়ান এবং জাভায় কচুরিপানার সবুজ পাতা এবং কাণ্ড সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর আমাদের দেশের অনেকেরই তো কচুরিপানা ফুলের (কুমড়ো ফুলের মতো) বড়া খাবার অভিজ্ঞতা আছে।

একটি সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আছে অবশ্য- কোনো কোনো জায়গার কচুরিপানা খেলে কারও কারও গলা চুলকাতে পারে। অবশ্য গলা চুলকাতে পারে এমন একটি সবজি ‘কচু’তো আমরা এখন খাই হরহামেশাই; কিনিও বেশ দাম দিয়েই।

কচুরিপানার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসার আগে এ কলামের আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ‘যোগাযোগ’ নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যাক। আপনি যদি কারও লিখিত কোনো বক্তব্য পড়েন, তাহলে শুধু টেক্সট পড়ে সম্পূর্ণ যোগাযোগের মাত্র ৭ শতাংশ পূর্ণ হয়।

যদি কারও বক্তব্য আপনি শোনেন, তাহলে টেক্সট-এর সঙ্গে বলার স্ট্রেস, ইনটোনেশন (একসঙ্গে যাকে ইনফ্লেক্সন বলা হয়) যুক্ত হয়ে যোগাযোগের ৪৫ শতাংশ পূর্ণ হয়। আর কারও সামনাসামনি গিয়ে তার মুখে কথা শুনলে তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মিলিয়ে বাকি ৫৫ শতাংশ যুক্ত হয়ে শতভাগ যোগাযোগ সম্পন্ন হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কোনো ‘গ্ল্যামারাস’ মন্ত্রণালয়ের নয়; স্বাভাবিকভাবে মন্ত্রীও সেটি নন। কিন্তু এ পরিকল্পনামন্ত্রীই তিন সপ্তাহ আগে এক বক্তব্যের কারণে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। ‘সিটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেনি তাদের একটি বড় অংশ খুব আরাম-আয়েশে আছে।

বাসায় বসে খুব আরামে বসে পোলাও খাচ্ছে। সরকারের ওপর আস্থা বেশি আছে বলেই মানুষ আরামে থাকছে।’ ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটারের ভীষণ কম উপস্থিতি নিয়ে এমন একটি মন্তব্য করেও পরিকল্পনামন্ত্রী তখন খুব বেশি সমালোচনার শিকার হননি।

আসলে সেই সময়টায় এরকম একটার পর একটা ‘অমর বাণী’ প্রসব করছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, মন্ত্রী, মেয়র প্রার্থীসহ খুব উঁচু পর্যায়ের মানুষ।

আবার ভোট ব্যবস্থার প্রতি মানুষের চরম অনাস্থাও মানুষকে এসব ব্যাপারে আর খুব বেশি আহত করেনি; কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনা করলে এ মন্তব্যটি ভয়ংকর রকম আপত্তিকর ছিল; কিন্তু সেটি থেকে অল্পতেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

এবার তার ভাগ্য আর সুপ্রসন্ন ছিল না আগের মতো। কিছুদিন আগে কচুরিপানা খাওয়া যায় কিনা সেটি নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে খুব হালকা ধরনের একটি মন্তব্যের জন্য তিনি আরও অনেক বেশি বিপদে পড়েছেন।

সমালোচনার মুখে তাকে রীতিমতো ব্যাখ্যা করে বলতে হয়েছে তিনি কচুরিপানা খেতে বলেননি, বলেছেন সেটি খাওয়া যায় কি না, সেই ব্যাপারে গবেষণা করতে। আসলেই তিনি সেটাই বলেছিলেন; কিন্তু কেন তার চরম মুণ্ডুপাত করা হল?

সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আজ পেপারে দেখলাম আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে তাহলে মানুষ কেন খেতে পারবে না। আমাদের দেশে কি এখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে যে কচুরিপানা খেতে হবে? আজ তো পরিকল্পনামন্ত্রী আসেননি।

আমরা তো কিছু কচুরিপানা নিয়ে আসছিলাম। ওনাকে দিতাম। তিনি আরও বলেন, গরুর খাবার কী মানুষ খেতে পারবে নাকি মানুষের খাবার গরু খেতে পারবে। ঘাসের মধ্যে তো অনেক ভিটামিন আছে, তাহলে আমরা ঘাস খাই না কেন?

রওশন এরশাদকে সরকারের খুব কঠোর সমালোচনা করতে খুব কদাচিৎই দেখা যায়। তিনিও যখন এমন কঠোর মন্তব্য করেন তখন খুব ভালোভাবেই যে কেউ অনুমান করতে পারেন, পরিকল্পনামন্ত্রীর এ উক্তি নিয়ে কী হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কয়েকটি দিন পুরো ফেসবুক ভেসে গিয়েছিল নানা রকম ট্রোলে।

কচুরিপানা নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্যের একটা খণ্ডিত অংশ নিয়ে দেশের প্রায় সব পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল শিরোনাম করেছে। ভেতরে কেউ কেউ তার বলা কথাগুলো বিস্তারিত লিখেছেন। এরই মধ্যে তার বলা কথাগুলো সবাই জেনে গেছে, তাই সেটার পুনরুল্লেখ করছি না।

শুরুতেই বলেছিলাম কারও বক্তব্যের টেক্সট থেকে শুধু ৭ শতাংশ যোগাযোগ হয়। এমনকি এ যোগাযোগের মধ্যেও এটি খুব স্পষ্ট ছিল, তিনি গবেষকদের একটি অনুষ্ঠানে আরও কিছু বিষয়ে গবেষণার সঙ্গে কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, সেই ব্যাপারে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি আসলেই কাউকেই কচুরিপানা খেতে বলেননি; কিন্তু সেটিও আমরা বুঝতে চাইলাম না। অবিশ্বাস্যভাবে সেটি বুঝতে চাইল না পত্রিকাগুলোও। কেউ শিরোনাম এভাবে করল না- কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, সেই গবেষণার আহ্বান জানালেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটির ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়। কেউ কি দেখেছেন তিনি কথাগুলো কী ঢঙে বলেছেন? আচ্ছা, সাংবাদিকরা তো সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তারা তো দেখেছেন কথাগুলো কীভাবে বলা হয়েছে। ভিডিওতে তার বক্তব্যটি আমি কয়েকবার দেখেছি।

আগে যেমন বললাম এখানে তার ভয়েস-এর ইনফ্লেকশন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন সব মিলিয়ে তিনি আসলে কী বলতে চেয়েছেন, কথাটা কীভাবে বলতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। খুব মজা করে হাসতে হাসতেই কথাগুলো বলেছেন তিনি।

এমনকি যে গরু খায় যুক্তিটাকেই প্রধান করা হয়েছে তার বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে, সেটিও তিনি নিজে বলেননি, তার সামনে কেউ এটি তুলেছিল তারপর তিনি তাদের সায় দিয়ে বলেছেন ওভাবে। সব কথা বলা হয়েছে মজা করতে করতেই।

অনেকেই সংবাদ পড়ে এ খবর জেনেছেন, তাই বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকরা তো তার সামনে ছিলেন, স্পষ্টভাবে দেখেছেন তিনি কীভাবে কথাগুলো বলেছেন, তাদের তো এ ব্যাপারটা উল্লেখ করা দরকার ছিল।

সেটি না করে তারা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে খবরটি মানুষের সামনে নিয়ে আসেন। সংবাদপত্র বাজার বোঝে। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল এভাবে পরিবেশন করলেই পাঠক ‘খাবে’ সে খবর।

এখন যদি পরিকল্পনামন্ত্রীর ভিডিও সবাইকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তিনি আসলে কী করেছেন তবুও কি মানুষ তাকে ছাড় দেবে? মানুষ কি বুঝবে, এ মানুষটির প্রতি এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর ভীষণ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?

বাংলাদেশের মতো একটা এককেন্দ্রিক দেশে বিকেন্দ্রীকরণের একটা ধাপ হিসেবে উপজেলা অবশ্যই অসাধারণ একটা স্থানীয় সরকার ইউনিট। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন উপজেলা ধারণাটি আমাদের সামনে নিয়ে আসেন তখন সেটার প্রচণ্ড বিরোধিতা হয়েছিল।

হুবহু সেরকম না হলেও উপজেলা কিন্তু এখন আছে এবং আমরা সেটার খুব প্রশংসা করি, উপজেলা পরিষদকে আরও ক্ষমতায়িত করার কথা বলি। কিন্তু এরশাদ সেটি নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চরম বিরোধিতা হয়েছিল, কারণ এরশাদ সবার কাছে এতই অজনপ্রিয় তখন যে, তার এমনকি ভালো পদক্ষেপও গ্রহণ করা দূরেই থাকুক, বিবেচনা করার মানসিকতা কারও ছিল না।

কচুরিপানার ক্ষেত্রে ঠিক একই ঘটনাটিই ঘটছে। বর্তমান সরকারের ওপর নানা যৌক্তিক কারণে মানুষ বিক্ষুব্ধ। তাই মানুষ আজ সরকারি দলের কোনো সদস্যের কোনো আপত্তিকর মন্তব্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চায় তাকে। কে কোন কথা কোন টোনে বলেছেন সেসব বিবেচনা করার সময় বা মানসিকতা কারোই থাকে না। মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ বেরিয়ে আসে এভাবেই।

কচুরিপানা-কাণ্ড নিয়ে ঘটে যাওয়া তোলপাড়ের মধ্যেই থিতিয়ে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু এটি সরকারকে বার্তা দিতে পারত, সতর্ক করতে পারত মানুষের চরম ক্ষোভ নিয়ে। সরকার জানতে পারত শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য টিকে থাকতে গিয়ে মানুষকে যখন বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়, তখন সেটি সরকারের জন্য কোনোদিন চরম বিপর্যয় তৈরি করবেই।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

কচুরিপানা খাবার কথা কেউ বিবেচনা করলাম না কেন

আপডেট টাইম : ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ মার্চ ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কচুরিপানা খাওয়া যায়। না, আমি ফুলের কথা বলছি না, কচুরিপানার সবুজ পাতা আর কাণ্ডের কথা বলছি। এ ইনফরমেশন এ যুগে যে কেউ গুগল করলেই দেখতে পারেন কচুরিপানার খাদ্যমূল্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গবেষণা করেছে।

এর পুষ্টিমূল্য এমন যে এতে প্রোটিন আছে ১৮ শতাংশ, শর্করা ৩৬ শতাংশ, ফাইবার ১৭ শতাংশ, আছে ভিটামিন এ, বি১, বি২। তাইওয়ান এবং জাভায় কচুরিপানার সবুজ পাতা এবং কাণ্ড সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর আমাদের দেশের অনেকেরই তো কচুরিপানা ফুলের (কুমড়ো ফুলের মতো) বড়া খাবার অভিজ্ঞতা আছে।

একটি সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আছে অবশ্য- কোনো কোনো জায়গার কচুরিপানা খেলে কারও কারও গলা চুলকাতে পারে। অবশ্য গলা চুলকাতে পারে এমন একটি সবজি ‘কচু’তো আমরা এখন খাই হরহামেশাই; কিনিও বেশ দাম দিয়েই।

কচুরিপানার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসার আগে এ কলামের আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ‘যোগাযোগ’ নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যাক। আপনি যদি কারও লিখিত কোনো বক্তব্য পড়েন, তাহলে শুধু টেক্সট পড়ে সম্পূর্ণ যোগাযোগের মাত্র ৭ শতাংশ পূর্ণ হয়।

যদি কারও বক্তব্য আপনি শোনেন, তাহলে টেক্সট-এর সঙ্গে বলার স্ট্রেস, ইনটোনেশন (একসঙ্গে যাকে ইনফ্লেক্সন বলা হয়) যুক্ত হয়ে যোগাযোগের ৪৫ শতাংশ পূর্ণ হয়। আর কারও সামনাসামনি গিয়ে তার মুখে কথা শুনলে তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মিলিয়ে বাকি ৫৫ শতাংশ যুক্ত হয়ে শতভাগ যোগাযোগ সম্পন্ন হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কোনো ‘গ্ল্যামারাস’ মন্ত্রণালয়ের নয়; স্বাভাবিকভাবে মন্ত্রীও সেটি নন। কিন্তু এ পরিকল্পনামন্ত্রীই তিন সপ্তাহ আগে এক বক্তব্যের কারণে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। ‘সিটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেনি তাদের একটি বড় অংশ খুব আরাম-আয়েশে আছে।

বাসায় বসে খুব আরামে বসে পোলাও খাচ্ছে। সরকারের ওপর আস্থা বেশি আছে বলেই মানুষ আরামে থাকছে।’ ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটারের ভীষণ কম উপস্থিতি নিয়ে এমন একটি মন্তব্য করেও পরিকল্পনামন্ত্রী তখন খুব বেশি সমালোচনার শিকার হননি।

আসলে সেই সময়টায় এরকম একটার পর একটা ‘অমর বাণী’ প্রসব করছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, মন্ত্রী, মেয়র প্রার্থীসহ খুব উঁচু পর্যায়ের মানুষ।

আবার ভোট ব্যবস্থার প্রতি মানুষের চরম অনাস্থাও মানুষকে এসব ব্যাপারে আর খুব বেশি আহত করেনি; কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনা করলে এ মন্তব্যটি ভয়ংকর রকম আপত্তিকর ছিল; কিন্তু সেটি থেকে অল্পতেই বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

এবার তার ভাগ্য আর সুপ্রসন্ন ছিল না আগের মতো। কিছুদিন আগে কচুরিপানা খাওয়া যায় কিনা সেটি নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে খুব হালকা ধরনের একটি মন্তব্যের জন্য তিনি আরও অনেক বেশি বিপদে পড়েছেন।

সমালোচনার মুখে তাকে রীতিমতো ব্যাখ্যা করে বলতে হয়েছে তিনি কচুরিপানা খেতে বলেননি, বলেছেন সেটি খাওয়া যায় কি না, সেই ব্যাপারে গবেষণা করতে। আসলেই তিনি সেটাই বলেছিলেন; কিন্তু কেন তার চরম মুণ্ডুপাত করা হল?

সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আজ পেপারে দেখলাম আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে তাহলে মানুষ কেন খেতে পারবে না। আমাদের দেশে কি এখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে যে কচুরিপানা খেতে হবে? আজ তো পরিকল্পনামন্ত্রী আসেননি।

আমরা তো কিছু কচুরিপানা নিয়ে আসছিলাম। ওনাকে দিতাম। তিনি আরও বলেন, গরুর খাবার কী মানুষ খেতে পারবে নাকি মানুষের খাবার গরু খেতে পারবে। ঘাসের মধ্যে তো অনেক ভিটামিন আছে, তাহলে আমরা ঘাস খাই না কেন?

রওশন এরশাদকে সরকারের খুব কঠোর সমালোচনা করতে খুব কদাচিৎই দেখা যায়। তিনিও যখন এমন কঠোর মন্তব্য করেন তখন খুব ভালোভাবেই যে কেউ অনুমান করতে পারেন, পরিকল্পনামন্ত্রীর এ উক্তি নিয়ে কী হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কয়েকটি দিন পুরো ফেসবুক ভেসে গিয়েছিল নানা রকম ট্রোলে।

কচুরিপানা নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্যের একটা খণ্ডিত অংশ নিয়ে দেশের প্রায় সব পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল শিরোনাম করেছে। ভেতরে কেউ কেউ তার বলা কথাগুলো বিস্তারিত লিখেছেন। এরই মধ্যে তার বলা কথাগুলো সবাই জেনে গেছে, তাই সেটার পুনরুল্লেখ করছি না।

শুরুতেই বলেছিলাম কারও বক্তব্যের টেক্সট থেকে শুধু ৭ শতাংশ যোগাযোগ হয়। এমনকি এ যোগাযোগের মধ্যেও এটি খুব স্পষ্ট ছিল, তিনি গবেষকদের একটি অনুষ্ঠানে আরও কিছু বিষয়ে গবেষণার সঙ্গে কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, সেই ব্যাপারে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি আসলেই কাউকেই কচুরিপানা খেতে বলেননি; কিন্তু সেটিও আমরা বুঝতে চাইলাম না। অবিশ্বাস্যভাবে সেটি বুঝতে চাইল না পত্রিকাগুলোও। কেউ শিরোনাম এভাবে করল না- কচুরিপানা খাওয়া যায় কি না, সেই গবেষণার আহ্বান জানালেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটির ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়। কেউ কি দেখেছেন তিনি কথাগুলো কী ঢঙে বলেছেন? আচ্ছা, সাংবাদিকরা তো সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তারা তো দেখেছেন কথাগুলো কীভাবে বলা হয়েছে। ভিডিওতে তার বক্তব্যটি আমি কয়েকবার দেখেছি।

আগে যেমন বললাম এখানে তার ভয়েস-এর ইনফ্লেকশন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন সব মিলিয়ে তিনি আসলে কী বলতে চেয়েছেন, কথাটা কীভাবে বলতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। খুব মজা করে হাসতে হাসতেই কথাগুলো বলেছেন তিনি।

এমনকি যে গরু খায় যুক্তিটাকেই প্রধান করা হয়েছে তার বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে, সেটিও তিনি নিজে বলেননি, তার সামনে কেউ এটি তুলেছিল তারপর তিনি তাদের সায় দিয়ে বলেছেন ওভাবে। সব কথা বলা হয়েছে মজা করতে করতেই।

অনেকেই সংবাদ পড়ে এ খবর জেনেছেন, তাই বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকরা তো তার সামনে ছিলেন, স্পষ্টভাবে দেখেছেন তিনি কীভাবে কথাগুলো বলেছেন, তাদের তো এ ব্যাপারটা উল্লেখ করা দরকার ছিল।

সেটি না করে তারা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে খবরটি মানুষের সামনে নিয়ে আসেন। সংবাদপত্র বাজার বোঝে। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল এভাবে পরিবেশন করলেই পাঠক ‘খাবে’ সে খবর।

এখন যদি পরিকল্পনামন্ত্রীর ভিডিও সবাইকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তিনি আসলে কী করেছেন তবুও কি মানুষ তাকে ছাড় দেবে? মানুষ কি বুঝবে, এ মানুষটির প্রতি এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর ভীষণ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?

বাংলাদেশের মতো একটা এককেন্দ্রিক দেশে বিকেন্দ্রীকরণের একটা ধাপ হিসেবে উপজেলা অবশ্যই অসাধারণ একটা স্থানীয় সরকার ইউনিট। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন উপজেলা ধারণাটি আমাদের সামনে নিয়ে আসেন তখন সেটার প্রচণ্ড বিরোধিতা হয়েছিল।

হুবহু সেরকম না হলেও উপজেলা কিন্তু এখন আছে এবং আমরা সেটার খুব প্রশংসা করি, উপজেলা পরিষদকে আরও ক্ষমতায়িত করার কথা বলি। কিন্তু এরশাদ সেটি নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চরম বিরোধিতা হয়েছিল, কারণ এরশাদ সবার কাছে এতই অজনপ্রিয় তখন যে, তার এমনকি ভালো পদক্ষেপও গ্রহণ করা দূরেই থাকুক, বিবেচনা করার মানসিকতা কারও ছিল না।

কচুরিপানার ক্ষেত্রে ঠিক একই ঘটনাটিই ঘটছে। বর্তমান সরকারের ওপর নানা যৌক্তিক কারণে মানুষ বিক্ষুব্ধ। তাই মানুষ আজ সরকারি দলের কোনো সদস্যের কোনো আপত্তিকর মন্তব্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চায় তাকে। কে কোন কথা কোন টোনে বলেছেন সেসব বিবেচনা করার সময় বা মানসিকতা কারোই থাকে না। মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ বেরিয়ে আসে এভাবেই।

কচুরিপানা-কাণ্ড নিয়ে ঘটে যাওয়া তোলপাড়ের মধ্যেই থিতিয়ে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু এটি সরকারকে বার্তা দিতে পারত, সতর্ক করতে পারত মানুষের চরম ক্ষোভ নিয়ে। সরকার জানতে পারত শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য টিকে থাকতে গিয়ে মানুষকে যখন বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়, তখন সেটি সরকারের জন্য কোনোদিন চরম বিপর্যয় তৈরি করবেই।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট