বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ভারতের দিল্লিতে এনআরসি নিয়ে সংগঠিত দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। যেখানে দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেক মুসলিম। এই দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে অচেনা অনেকেরই জীবন। যাদের জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু অন্যরকম গল্প নিয়েই ডেইলি বাংলাদেশের আজকের আয়োজন।
একপাশে হানাহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের লীলাখেলা, অন্যপাশে সম্প্রীতি আর ভালোবাসার অদ্ভুত এক মেলবন্ধন- এই দুই রূপে সেজেছে ভারত। তাই হয়তো আসল ব্যাপারটা বুঝতে একটু হিমশিম খেতেই হয়।
একপাশে লক্ষ্মী সাবান স্টোর, অন্য পাশে যাদব’স সু স্টোর। মাঝখানের দোকানটা আলী মোহাম্মদের, মশলার দোকান ছিল সেটা। দোকানের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দুই পাশের দুটো দোকান নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে আছে, আর আলীর দোকানের শাটার ভেঙে ভেতরের সব জিনিসপত্র লুট করে নেয়া হয়েছে। পাশের দুটো দোকানে কেউ হাতও দেয়নি, অথচ আলীর দোকানটাকে আস্ত রাখা হয়নি। কারণ আলী মুসলমান, বাকী দুজন হিন্দু। বেছে বেছে এভাবেই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চালানো হয়েছে লুটপাট। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে দিল্লি। এক কথায় বলতে হয়, ভারতের হৃৎপিণ্ড পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে।
আগুনটা বাষ্পীভূত ছিল অনেকদিন ধরেই। নাগরিকত্ব আইন আর নাগরিক পঞ্জি নিয়ে ভারত উত্তাল অনেক আগে থেকেই। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে, সরকার তাদের দাবীতে কান দেয়নি, ক্ষমতাসীন দল নিজেদের জনপ্রিয়তার কারণে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, পাত্তা দেয়নি মানুষের আবেগ আর অনুভূতিকে। একটা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের প্রতি নিজেদের ক্ষোভ জারী রেখেই বিভাজনের রাজনীতির পথে হেঁটেছে, সংখ্যাগুরু ভোটব্যাংকটাকে নিজেদের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক মেরুকরণের মাধ্যমে। সেটারই ফল এখন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে হাতেনাতে পাচ্ছে দিল্লির মানুষ।
দিল্লি অগ্নিগর্ভে পাওয়া যাচ্ছে লাশের পর লাশ। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে। আসলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, সেটা বারোশো মাইল দূরে বসে ভিডিও ফুটেজ দেখে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যুগে যুগে মানুষকে বিভক্ত করার জন্যে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম। এখানেও তার ভিন্ন কিছু ঘটেনি। মসজিদ ভাঙচুর হয়েছে, মিনারে চড়ানো হয়েছে হিন্দুত্বের প্রতীক গেরুয়া পতাকা, পোড়ানো হয়েছে কোরআন শরীফ।
বাচ্চাদের জন্যে খাবার কিনে ঘরে ফিরতে পারেননি বাবা, ফিরেছে তার লাশ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল মরেছেন গুলি খেয়ে, কোথাও আবার পুলিশকেই দেখা গেছে দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে একজোট হয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর হামলা চালাতে, তাদের দোকানে লুটপাট করতে।
গুজরাট দাঙ্গার ধরন অনুসরণ করেই এগিয়েছিল দিল্লির ঘটনা, লক্ষণ আর ফলাফলগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই মিলে যায়। নিয়ন্ত্রণের বদলে ঘটনাটি আরো ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। উত্তরপ্রদেশ, যোগীর রামরাজ্য যেখানে বর্তমান, সেখান থেকে হাজার হাজার লোক ঢুকেছে দিল্লিতে, এদের অনেকেই সশস্ত্র। মুসলমানদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে তারাও, অভিযোগ এসেছে লোকজনকে আটকে রেখে প্যান্ট খুলে ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হবারও। এটাই ছিল দিল্লির পরিস্থিতি।
দিল্লি এখন অরাজক এক নগরী, ভারতের রাজধানী শহরের ছাপটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না রাজপথে। চারপাশে ধ্বংসস্তুপের মেলা, ভাংচুর আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে প্রতিটা সেকেন্ড পার করছেন মুসলমানেরা। কোথাও আবার মুসলিমদের কেউ কেউ হানাহানির রাস্তা বেছে নিয়েছে, হাতে তুলেছে অস্ত্র, পাল্টা হামলা চালিয়েছে তারাও।
এরই মাঝেও মন ভালো করে দেয়া অজস্র গল্পের জন্ম হয়েছে। আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষার জন্যে গুরুদ্বারের দরজা খুলে দিয়েছে শিখ সম্প্রদায়, দলিতেরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে পাড়া, যাতে বহিরাগত কেউ তাদের মুসলমান ভাই-বোনদের ওপর হামলা করতে না পারে! একদিকে আরএসএস ক্যাডারেরা হামলা চালাচ্ছে, ভাংচুর করছে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি, পিটিয়ে মেরে ফেলছে মানুষ। আবার বিজেপিরই স্থানীয় নেতা ছুটে এসে বাঁচাচ্ছে আক্রান্ত মুসলমানের প্রাণ, বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে আগুয়ান ভীড়ের সামনে- হিংসার সামনে জিতে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব, জিতে যাচ্ছে ভালোবাসা। এমন অনেক ঘটনা কারো অজানা নয়। দাঙ্গায় অনেক প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি, তবে হাজারটা প্রাণ বেঁচে যাওয়ার গল্পও কিন্ত জমে গেছে।
এখন দিল্লিতে ১৪৪ ধারা তুলে নিলেও থেমে যায়নি আতঙ্ক। মুসলিমদের মধ্যে মৃত্যুর ভয় এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে আঁতকে ওঠেন সেই ভয়ানক হামলার ঘটনা মনে করে। একই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সবারই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দিল্লির পরিস্থিতি হয়তো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, কিন্তু মুসলিমদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ভয়ানক ঘটনা সবার মনে দাগ কেটে যাবে।