বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ইতিহাসের গন্ধেই নদীয়া হাউজের দরজায় কড়া নাড়লাম। প্রবেশের অনুমতি মিলল খানিক পরে। বাইরে তখন হাড়-জ্বালানো গরম, গাড়ির উদ্ধত চিৎকার, উৎকন্ঠিত মানুষ। সেসব চৌহদ্দি পেরিয়ে নদীয়া হাউজে প্রবেশের পর মনে হল একটা ভিন্ন অঞ্চল! শান্ত, নিশ্চুপ। সহসা দু-একটি পাখির ডাক। চোখ ছনাবড়া নয়ন-জুড়োনো ঝাড়বাতি দেখে। দেয়ালে টাঙানো শিকারের অসংখ্য চিহ্ন। হরিণ থেকে শুরু করে হিংস্র পশু। যেন টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গেছি ‘এক যে ছিল রাজা’দের আমলে।
কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই নদীয়া হাউজে। অবশ্য ‘মেরি ভিল’, ‘গুড হোপ ভিল’ এসব নানান নামকরণ ও বেশ কয়েকবার মালিকানা বদলের পরে এই বিশাল বাড়ি এসে পৌঁছায় কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের হাতে। বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্যের জগতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই রাজপরিবারের।
কলকাতার নদীয়া হাউজের বাসিন্দা ছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজা ক্ষৌণীশচন্দ্র রায়। সংযুক্ত বাংলার গভর্নরের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। তার উপস্থিতিই ঐতিহাসিক করে তোলে এই বাড়িকে। এরপর কৃষ্ণনগরের মহারাজা সৌরীশচন্দ্র বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে তোলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের খ্যাতিমান ছাত্র ছিলেন তিনি। কলকাতার নানান তথ্যের হদিশ ছিল তার নখদর্পণে।
দেখা হলো সেই রাজপরিবারেরই বংশধর শ্রীমণীশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। মেঝে থেকে শুরু করে প্রায় সিলিং ছুঁয়ে যাচ্ছে কলকাতার প্রাচীন আমল। তারই মাঝে বসে মণীশচন্দ্র রায়। তারই মুখে শোনা হলো এখানকার নানান গল্প। সবচেয়ে ভিন্ন ছিল সৌরীশচন্দ্র রায়ের বিয়ের গল্পটা!
দিনটি ছিল ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ। সৌরীশচন্দ্র রায় তখন মহারাজকুমার। তার বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল বিরাট প্রীতিভোজ ও উৎসব-অনুষ্ঠানের। বড় অফিসার থেকে শুরু করে সমাজের সবচেয়ে গরিব মানুষটিও আমন্ত্রণ পেয়েছিল সেই বিয়েতে। যেন পুরো অঞ্চল খুশি আর উৎসবের জোয়ারে ভাসছিল।
রাজকীয় প্রীতিভোজে অতি সুখাদ্যের বিপুল সম্ভার তো ছিলই, তার সঙ্গে রয়েছে নাচ-গান আর নাটকের রাশি রাশি আনন্দ। বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নিজে এসেছিলেন নদিয়ার রাজবাড়িতে সংগীত পরিবেশন করতে। রাজবাড়িতে বিদেশ থেকে আনা প্রজেক্টরে একাধিক সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা ছিল! সে যুগে যা ছিল অতি বিরল।
এত সব আয়োজনের সঙ্গে মূল আকর্ষণ ছিল খাবারের মেনু! ১৩৮টি পদ! মহারাজকুমারের বিয়েতে খেয়ে আমন্ত্রিতরা সবাই খুব খুশি ও তৃপ্ত হয়েছিলেন, এতে সন্দেহ নেই। এমন কোনো পদ ছিল না যে মেনু কার্ডে নেই! সাদা ভাত, ছানার পোলাও, চিংড়ি মাছের কাশ্মিরী পোলাও, কই মাছের পাতারি, রোষ্ট, ডিমের মামলেট, নারিকেলের ফ্রাইসহ আরো কত কি!
যারা আমিষ খান না, তাদের জন্যও চমকপ্রদ ব্যবস্থা ছিল। ফুলকপির মোগলাই কারী, মোচার চপ, বাঁধাকপির মিজ্জাপুরী, লাউ রায়তা, পাঁপড় কারী, আলুর জয় হিন্দ, ছানার কারীসহ আরো অনেক পদ!
চাটনি কিংবা আচারেরও কমতি ছিল না। চাটনির মধ্যে ছিল আনারস, রসমুণ্ডি, আদা, কমলালেবু, আলুবখরা ও খেজুরের বিভিন্ন পদ। বিয়েতে খাবারের পাতে দেয়া হয়েছিল বাহারি নামের আচার; যেমন- করমচার আচার, লঙ্কার আচার, ফুলকপির আচার, ম্যাঙ্গো সুইট, আদার আচার।
মহারাজার বিয়েতে ফল থাকবে না তা কী করে হয়! বেদানা, আঙুর, আমেরিকান পেস্তা, বাদাম, এফ্রিকট, কিসমিস, কমলালেবু, আনারস, পেঁপে, আপেল, সবেদা, পাকা আমসহ হরেক রকমের ফল ছিল। এছাড়া সন্দেশ, মোরব্বা, সরবত ও পানীয় তো ছিলই।
এতকিছু খেলে যদি হজমের সমস্যা হয়? চিন্তা নেই, বিয়ের ভেন্যু ত্যাগ করার আগেই সবার হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের হজমির ট্যাবলেট। আর পান-সিগারেটের ব্যবস্থা তো ছিলই। নদীয়া হাউজে গিয়ে এই মেনু দেখে, শত বছর আগের কোনো এক বিয়েতে হাজির হওয়ার ইচ্ছে জাগলো! আহা… সেকাল…!