চেনা গ্রামের পথ ধরে চলেছে এক পথিক। ক্লান্তি আর তৃষ্ণায় রীতিমতো কাতর। পথিমধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? পথিকের সোজা উত্তর- জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ তো জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম এনে দিতে পারি… ।
সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকের ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত এই পথিককে একটু পানি পান করতে বিস্তর বিপত্তি পোহাতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। আহা, একটা ডাব যদি পাওয়া যেত তখন! মোক্ষম পানীয় বটে। তৃষ্ণা তো মিটতোই, সমস্ত ক্লান্তি টুটে গিয়ে শরীরও হয়ে উঠতো মুহূর্তেই সতেজ।
কেবল তৃষিত ক্লান্ত পথিকপ্রবরের জন্যেই এটি উপকারী, তা নয়; বরং প্রতিদিনই বিশেষত গরমের দিনে ডাবের পানি পান একজন মানুষকে সবদিক থেকেই রাখতে পারে সুস্থ সতেজ আর প্রাণদীপ্ত। সর্বগুণ বিচারে ডাবের পানি এক অমূল্য প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পানীয়।
প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি দারুণ জনপ্রিয়। বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এটি মিশে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে।
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মানুষের কাছে ডাবের পানি হলো স্বর্গ থেকে আসা জলবিন্দু। সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যেও একে অভিহিত করা হচ্ছে সুপারফুড, মিরাকল ড্রিংক্স ইত্যাদি নামে।
বিভিন্ন কৃত্রিম ও অস্বাস্থ্যকর পানীয়, এনার্জি ড্রিংক্স, স্পোর্টস ড্রিংক্স ইত্যাদির ক্ষতিকর দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি তারা বিভিন্ন প্রচারণায় প্রাকৃতিক পানীয়, বিশেষত ডাবের উপকারিতা সম্বন্ধে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে চাইছে। বহুকাল ধরে আমাদের দেশেও গ্রামীণ জনপদের অত্যাবশ্যকীয় এক ফলজ উপাদান ডাব। অতিথির আপ্যায়নপর্ব শুরুই হতো ডাবের পানি দিয়ে।
কী আছে ডাবের পানিতে? হরেক উপাদান আর নানা উপকারিতার খোঁজ মেলে ডাবের পানিতে। ডাবের পানিতে পর্যাপ্ত পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, আয়োডিন, সেলেনিয়াম, সালফারসহ মোট ১৯টি খনিজ উপাদান বা মিনারেল্স রয়েছে।
আছে ভিটামিন বি, এমাইনো এসিড ও বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় এনজাইম। কিন্তু ফ্যাট বা কোলেস্টেরল প্রায় নেই বললেই চলে। ডাবের পানিতে রয়েছে কিছু জরুরি ঔষধি গুণ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে এর ভূমিকা রয়েছে।
কারণ, ধমনীপথে অযাচিত রক্ত জমাটবাঁধা ঠেকানোর গুণাবলি রয়েছে এতে। এছাড়াও এর পটাসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে সহায়ক।
উল্লেখ্য, একটি বড় আকারের ডাবের পানিতে রয়েছে চারটি কলার সমপরিমাণ পটাসিয়াম। তাই অতিরিক্ত বমি বা কোনো কারণে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হলে ডাবের পানি দারুণ কার্যকরী।
এছাড়াও কিডনি ও মূত্রনালিতে পাথর জমা এবং মূত্রনালির সংক্রমণ রোধ করে এই প্রাকৃতিক পানীয়। ফিলিপাইনের চাইনিজ জেনারেল হাসপাতালের ইউরোলজিস্ট ড. ইউজেনিও ম্যাকলাঙ পরিচালিত একটি গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে।
এর পাশাপাশি ডায়রিয়াসহ যে-কোনো পানিশূন্যতা পূরণে ডাবের পানি এক অব্যর্থ পথ্য। ডাবের পানি শরীরের পিএইচ মান ঠিক রাখে। খাবার হজম ও পরিপাকে সাহায্য করার পাশাপাশি এসিডিটি, আলসার নিয়ন্ত্রণ করে।
দেহাভ্যন্তরে বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এই পুষ্টিকর পানীয়। আছে এর ক্যান্সার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যও। ডাবের পানি তারুণ্য ধরে রাখে। কারণ, এতে রয়েছে উদ্ভিদজাত একটি হরমোন সাইটোকাইনিন।
গবেষকরা বলছেন, সাইটোকাইনিন এর সংস্পর্শে এলে মানুষের দেহকোষের বার্ধক্যগতি ধীর হয়ে পড়ে। ফলে নিয়মিত ডাবের পানি পানে বাড়ে তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী তারুণ্যের সম্ভাবনা। এই অমূল্য পানীয়ের রয়েছে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
দীর্ঘ ভ্রমণজনিত, অসুস্থতাজনিত কিংবা যেকোনো তীব্র ক্লান্তি নিমেষে দূর করে এটি দেহ-মনে তাৎক্ষণিক শক্তি, সতেজতা ও উদ্যম জোগায়।
এর প্রধান কারণ হলো, ডাবের পানি সারা শরীরের শিরা ও ধমনীপথে এবং সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সমৃদ্ধ সুষম রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করে।
ফলে দেহকোষ, ত্বক, চুল, নখ পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় এবং এদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। ত্বকের ভাঁজ ও বলিরেখা এবং নখের ভঙ্গুরতা দূর হয়। সেইসাথে মজবুত হয়ে ওঠে দাঁত ও হাঁড়।
এছাড়াও মুখের ত্বকে বসন্তের দাগ, ব্রণের ক্ষত, চোখের নিচে কালি ইত্যাদি দূর করতেও কচি ডাবের পানিতে মুখ ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-ডাবের পানি স্নায়বিক দুর্বলতা দূর করে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
নিয়মিত ডাবের পানি পান করলে খাবারে রুচি বাড়ে। যে-কোনো ভারী পরিশ্রম ও ভারী ব্যায়ামের পরেও এটিই সর্বোত্তম পানীয়। উল্লেখ্য, ডায়াবেটিস রয়েছে যাদের, সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলেই কেবল তারা ডাব খেতে পারেন। আর কিডনিতে পাথরসহ যে-কোনো কিডনি জটিলতায় ভুগছেন যারা, তাদের ডাব খেতে বারণ।