বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ থাইল্যান্ডের উত্তরের প্রদেশ চিয়াং মাই। একেবারে মিয়ানমারের সাথে। প্রদেশের প্রধান শহর বা রাজধানীর নামকরণ হয়েছে খোদ প্রদেশর নামে- চিয়াং মাই। ১২৯৪ সালে তৎকালীন রাজ লা না শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর পর যা রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। চিয়াং মাই অর্থ ‘নতুন শহর’। দেশের রাজধানী ব্যাংকক থেকে এই নতুন নগরীর দূরত্ব সাতশ কিলোমিটার। দেশের উঁচ্চতম পর্বতমালা এখানে অবস্থিত। যতদূর জানলাম সর্বোচ্চ পর্বত চূড়াটিও এখানেই রয়েছে।
২০১৭ সালে নগরীটি ইউনেস্কো কর্তৃক ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল নগরীর মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। কোন কোন মতে থাইল্যান্ডে দ্বিতীয় বৃহত্ততম সংখ্যক পর্যটকের সমাগমন ঘটে এখানে। ২০১৩ সালের হিসাব মতে এখানে ১৪.১ মিলিয়ন পর্যটকের আগমন ঘটে, যার মধ্যে বিদেশীর সংখ্যা ৪.৬ মিলিয়ন। প্রকৃতি দর্শনের পাশাপাশি এখানে আছে পুরনো নগরীর পরম্পরা হিসেবে চমৎকার একটি শহর। জ্যামস গেস্ট হাউজে অতিথিদের সেবার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ অন্তর্ভূক্ত। অতএব, এখানকার অবস্থানকে আরও অর্থবহ করে তোলার খাতিরে এর ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মধ্যে উল্লেখিত তথ্য প্রাপ্তির পর মনে হলো, এখানে এসে তেমন ভুল হয়নি। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম থাপায়া গেটের দিকে। মোড়ের ওপারে পিচ ঢালা চত্বর। তার পরেই প্রাচীন আদলের দীর্ঘ প্রাচীর। প্রাচীরের মধ্য ভাগে একটি দরজা। এই দরজাই থাপায়া গেট নামে পরিচিত, যার ফলে অত্র এলাকার নাম থাপায়া গেট। দ্বারের ওপাশে প্রায় সহস্রাব্দ পূর্বের সেই চিয়াং মাই নগরী। অতীতে এমনই প্রচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল পুরো নগরী। আজ প্রাচীর নেই তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষার খাতিরে প্রাচীরের ভিত্তিমূল থেকেই গেঁথে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন প্রাচীর, যেন অতীতের সেই নগরী ঘেরা সুরক্ষা প্রাচীরটিই দণ্ডায়মান। দুপুরের রোদে চত্বরের পারিপার্শ্বিকতায় এক ঝলমলে রূপ। শত শত কবুতর আপন মনে আধার খুঁটে খাচ্ছে। এক শ্রেণীর লোকেরা কবুতরকে খাওয়ানোর মোড়কজাত খাবার বিক্রিতে ব্যস্ত। পর্যটকগণ শখের বসে হাতে আধার নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে অথবা হাত বাড়িয়ে ধরলে মুক্ত কবুতরের দল সেখান থেকেই ঠোকর মেরে তুলে নিচ্ছে। প্রাচীর থেকে কয়েক ফুট ব্যাবধানে চমৎকার এক বৃক্ষ প্রজাতীর সারি। তার নিচেই দর্শনার্থীদের একটুখানি বসার ব্যবস্থা।
পাই থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার যাত্রার পর যখন শহরের দেখা পেলাম তখন মন অনেক খাবাপ হয়ে গিয়েছিল। অথচ, এখানকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্বন্ধে অবগতির পর বেকলই মনে হচ্ছে ইট পাথরের প্রতিটি গাঁথুনি খুলে খুলে দেখে আসি ইতিহাসের সেই সব দিনগুলি! দ্বার পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে যেন অন্য এক আবহে প্রবেশ করলাম। বহু মানুষের চলাচল। স্থাপনাগুলিতে সেই প্রাচীন চিহ্ন নেই। কেবলই মনে হচ্ছে বিচরণ করছি সুদূর কোন অতীত কালে! এই প্রচীর দ্বারা আবদ্ধ নগরীতে সৈন্য সামন্তের পাহারা থাকত, থাকত নানা শ্রেণী পেশার মানুষের পদচারণা, গমগম করত সারাক্ষণ। হঠাৎ সবকিছু থমকে যেত রাজা অথবা পদস্থ ব্যক্তির আগমনে। মাথানত প্রজাদের শত সহস্র নমস্কার প্রণামে বুক ফুলে উঠত তাদের! আজ সবই ইতিহাস। কোন রাজা নেই, নেই শান্ত্রি-মন্ত্রী অথবা শামন্ত। সারা পৃথিবী থেকে আগত লক্ষ মানুষের সৌখিন পদচারণা এখন প্রধান বিষয়। দোকানপাট, ব্যবসা বাণিজ্য সমস্ত কিছুই ওই পর্যটনকে কেন্দ্র করে।
বর্তমানে নগরীর চারিধারে বেষ্টনী প্রাচীর না থাকলেও চারকোণাকৃতির নকশা আজও অটুট। পরবর্তী সময়ে যা কিছুই উন্নয়ন হয়েছে তার সবই চতুষ্কোণাকৃতির নকশা কেন্দ্র করে। একে কেন্দ্র করে নগরীর ব্যাপ্তি চার দিকে প্রসারিত হয়েছে। রাস্তার উভয় পাশে পায়ে হাঁটার ফুটপাথ তারপর অনুচ্চ দালান। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর হাতের বাম পাশটায় বৃক্ষের ঘন ছায়া। ছোট্ট অরণ্যের মাঝ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মন্দির গৃহের শীর্ষদেশ এবং মটের সোনালী চূড়া। ছায়াতলে দুই দিকে খাবারের দোকান। বারটা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। সুতরাং, দুপুরের খাবার খাওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে আমরা এখনই খাচ্ছি না। তার আগে মন্দির ঘুরে দেখা দরকার। মন্দির গৃহের উঠানে সোনালী পাতে মোড়ানো মঠের চার ধারে ধর্মীয় বিভিন্ন সামগ্রীর অস্থায়ী খোলা দোকান। মঠের বারান্দায় কেউ কেউ মাথা নত করে প্রার্থনায় বসেছে। শব্দ যন্ত্রে অনর্গল বেজে চলেছে ধর্মের শ্লোক। মঠ পেছনে রেখে ধীর কদমে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলে ভেতর থেকে একজন ভিক্ষু ভেতরে আমন্ত্রণ জানালেন। পরনে ফুলপ্যান্ট না থাকায় এতক্ষণ সংশয়ে ছিলাম। সংশয়ের অবসান ঘটল এবং ভেতরে প্রবেশ করলাম। মিটিমিটি আলোয় ঘরের শেষ প্রান্তে বেদিতে স্থাপিত বৌদ্ধ মূর্তি, যেন স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। চকচকে মূর্তির আদল বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া বা নেপালের মতো নয়, একটু অন্য রকম। ছবি তুলতে চাইলে কোন বারণ নেই। ভিক্ষুগণ এক কোণায় বসে আলপরত। চোখে চোখ পড়তেই লক্ষ করি তাদের চোখে মুখে প্রশ্রয়ের শান্ত হাসি। এগিয়ে গেলে বসতে বলা হলো। আশা করা যায় এখন দু’চারটি কথা বলতে সমস্যা নেই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাতেই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ী। কয়েক মুহূর্ত পর দুইটি বই হাতে তুলে দিয়ে যেন রক্ষা পেলেন- যা জানার এর ভেতর থেকে জেনে নিন। বই পেয়ে আমি যার পর নেই খুশি। স্থানীয় ভাষার বই হলে কি, উপহার তো! এর চেয়ে মূল্যবান আর কি হতে পারে? বুঝতে বাকি রইল না বই দুটির মধ্যে বিস্তারিত দেয়া আছে। জানি সারা জীবনে বইয়ের একটি লাইনও অনুবাদ করতে পারার সাধ্য আমার নেই তবুও অনেক খুশির বিষয়। তা অবশ্য আমার সহযাত্রী সুজিতের নিকট একটু বিরক্তির উদ্রেক করল। পরে অনুভূতি বুঝিয়ে বলার পর সে শান্ত হয়।
প্রতিটি খাবারের দোকানে দাম এবং ছবিসহ খাদ্য তালিকা ঝুলিয়ে দেয়া আছে। আমরা পছন্দ করলাম বিশ বাথ মূল্যের একটি করে মাংস নুডুলস। নুডুলসের উপর ছড়ানো কলিজার কালো কালো অসংখ্য টুকরো। সাথে অতিরিক্ত হিসেবে দেয়া হলো মরিচ ভাজা। তেলে ভাজা মুচমুচে শুকনো মরিচ, আকৃতিতে বেটে হলে কি হবে ঝালে চূড়ান্ত! খাবার খেয়ে সুবিধা করা গেল না। পরিবেশনের পর অনেক খুশি হলাম- মাত্র বিশ বাথে এত কিছু! মুখে দিয়ে দেখা গেল কলিজা নয় ফুসফুসের টুকরো। থাইল্যান্ডে আসার পর এই প্রথম থালিতে অনেকটা খাবার রেখে উঠে পরলাম। বাইরে ভীষণ রোদ। এখানে গাছের ছায়ায় বসে থাকতে ভালোই লাগছে। এরই মধ্যে এ দোকান সে দোকান ঘুরে দুই হাতে দুটি থালি নিয়ে এগিয়ে এলো সুজিত। খুঁজে বের করেছে মিষ্টান্নের দোকান। পাঁচ থেকে সাত পদের মাত্র একটি করে এনেছে। আগেই বলে রাখল খেয়ে ভালো লাগলে আর এক দফা আনবে। বিক্রেতা তাকিয়ে আছে, তাকেও বোধহয় একই কথা বলে এসেছে। মিষ্টান্ন বটে, তবে অন্নে মিষ্টির সংযোগে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তাছাড়া, চেহারাতেও আমাদের উপমহাদেশীয় নয়। টুপটুপো রসে ডোবানো রসগোল্লা আর ক্ষীর-সন্দেশে অভ্যস্ত বাঙালির জিহ্বাকে বশে আনা এত সহজ নয়! পুনঃদফা না খেলেও বিক্রেতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অরণ্য থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছনটায় স্থানীয় নানান জিনিসপত্র বিশেষ করে প্রসাধনী ও গহনার পসরা নিয়ে বসে গেছে বেশ কিছু দোকান। সময় কাটানোর এক দারুণ ব্যবস্থা হলো। এরই মধ্যে জেনে গেছি অদূরেই শুক্রবারের রাত্রিকালীন বাজার বসবে। আর আজ ঠিক শুক্রবার। মাঝখানে আনেকটা সময়। হোস্টেলের ওই উত্তপ্ত ঘরে এই লম্বা সময় ধরে বসে থাকা অসম্ভব। ভালোই হলো দোকান ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু দেখা এবং শেখা উভয়ই হবে। পছন্দ হলে কিছু কেনাও যাবে।