বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীর মাঝে আড়িয়ল বিলের অবস্থান। প্রায় ২০ হাজার একরের এ বিল ঢাকার নবাবগঞ্জের উত্তর-পশ্চিম, দোহারের পশ্চিম ও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরজুড়ে বিস্তৃত। বর্ষা মৌসুমে বিলের প্রায় সর্বত্র পানি থাকে। তখন বিল অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম হয় ডিঙি নৌকা। ভরা বর্ষায় আমরা নৌকা নিয়েই গিয়েছিলাম আড়িয়ল বিল।
নৌকা নিয়ে বিলের মাঝে যখন আসি তখন মধ্যদুপুর। সূর্যের তেজও বেশ। বিলের স্বচ্ছ পানি দেখে লোভও সামলাতে পারিনি। তাই গামছা পরে টুপ করে নেমে পড়ি। তারপর দিই ডুব। মুহূর্তেই শরীর যেন শীতল হয়ে গেল। আসলে বিলের পানি কেবল দেখতেই স্বচ্ছ নয়, প্রচুর ঠান্ডাও। এ ঠান্ডায় শরীরের ক্লান্তি যেটুকু ছিল, সবই যেন নেমে গেল।
বিলে নামার আগে দেখতে আসি শ্রীনগরের উত্তর বালাসুর গ্রামের বিক্রমপুর জাদুঘর ও নৌকা জাদুঘর। জাদুঘর দেখার পর হাতে সময় ছিল প্রায় সারাদিন। তাই ভাবি আড়িয়ল বিলের পানিতে গোসলটা সেরে নিই। জাদুঘর থেকে হেঁটে আসি উত্তর বালাসুর বাজার। স্থানীয় হাশেম আলী জানান, একটু এগোলেই দেখা মিলবে বিলের। তার কথা শুনে হাঁটা শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতেই পরিচয় হলো মাঝবয়সী লাল চাঁনের সঙ্গে। তিনি দুধ ব্যবসায়ী। তাকে জানাই বিলের পানিতে গোসল করতে চাই; কোন পথে গেলে ভালো হয়?
উত্তরে তিনি আমাকে তার সঙ্গে হাঁটতে বললেন।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর ডিঙি নৌকায় পার হই বাইন্না খাল। তারপর আরও কিছুটা পথ হেঁটে আসি লাল চাঁনের বাড়ি। দোতলা টিনের ঘর তার। দেখতে দারুণ। এ অঞ্চলে প্রায় সব বাড়িতেই দেখা মিলল এমন দোতলা টিনের ঘর। লাল চাঁনের বাড়ির সঙ্গেই বাইন্না খাল। আর খালের সঙ্গেই আড়িয়ল বিল। বাড়ির ঘাটেই লাল চাঁনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা বাঁধা। লাল চাঁন আমাকে নিয়ে উঠলেন তার নৌকায়। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন শিশু-কিশোর উঠল। এরা কেউ লাল চাঁনের ছেলে, কেউ লাল চাঁনের ভাইয়ের ছেলে।
নৌকায় রওনা হই বিলের দিকে। দেখি খাল ধরে ডিঙি নৌকায় অনেক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ফিরছেন বিল থেকে। তাদের কেউ ফিরছেন গোসল সেরে, কেউ ফিরছেন মাছ ধরে। কেউ আবার ফিরছেন শাপলা তুলে বা গরুর জন্য খাদ্য হিসেবে কচুরিপানা নিয়ে। এসব দেখতে দেখতে অল্প সময়ের মধ্যে খাল পার হয়ে আসি মাঝবিলে। তারপর থামানো হয় নৌকা।
চোখ যতদূর যায়, কেবল বিল আর বিল। হঠাৎই মনে পড়ল হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘ভালো থেকো’ ছড়ায় আড়িয়ল বিল নিয়েও একটি লাইন আছে। লাইনটি এমনÑ ‘ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল।’ ছড়ার কথা মনে করতেই দেখি বিলে অনেক বকের উপস্থিতিও আছে।
পুরো বিলেই শাপলা-শালুক আর কচুরিপানায় ভরা। বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকা-বাঁকা সরু খাল। বিলজুড়ে অনেক ডিঙি নৌকাও আছে। এসব নৌকায় কেউ ঘুরে ঘুরে শাপলা তুলছেন, কেউ বসে বসে মাছ ধরছেন, কেউ আবার মাছ ধরছেন জাল দিয়ে। কিংবা কেউ কাটছেন কচুরিপানা। বিলের কিছু স্থানে ছোট ছোট বসতিরও দেখা মিলল।
আমাদের নৌকায় যে শিশু-কিশোররা এসেছে তারা সবাই বিলের পানিতে নেমে সাঁতার কাটছে মনের অনন্দে। তাদের সাঁতার আর স্বচ্ছ পানি দেখে থাকতে পারিনি, গামছা পরে আমিও নেমে পড়ি। এমন স্বচ্ছ আর ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কেটে-ডুব দিয়ে গোসল করাতে মনে হলো নাগরিক জীবনের শত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেছে; যেন ফিরে পেয়েছি অনাবিল প্রশান্তির পরশ।
বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে উঠি নৌকায়। তারপর আরও কিছুটা বিলের মাঝে বেড়িয়ে ফিরি লাল চাঁনের বাড়িতে। লাল চাঁনের স্ত্রী খেতে দিয়েছেন। সত্যিই গ্রামের মানুষের আতিথ্য এখনো অনন্য। লাল চাঁন জানান, ঢাকার দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীর মাঝে এ বিলের অবস্থান। এর আকার প্রায় ২০ হাজার একর। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার একর রয়েছে ঢাকার নবাবগঞ্জের উত্তর-পশ্চিম ও দোহারের পশ্চিমে। বাকিটা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার উত্তর বালাসুর, হাঁসারা, বাড়ইখালী, ষোলঘর, শ্যামসিদ্ধ, শ্রীধরপুর, আলমপুর, লস্করপুর, পুঁটিমারা, আটধিপাড়া, দয়হাটা, সেলামতি, মত্তগাঁও, শিমুলিয়া, মদনখালী, গদিঘাট, আমারগাঁও, বাগরাসহ এর আশপাশের গ্রাম নিয়ে বিস্তৃত।
বর্ষা মৌসুমে এ বিলের প্রায় সর্বত্র পানি থাকে। কোথায়ও দুই ফুট, কোথায়ও চার ফুট, আবার কোথায়ও থাকে পাঁচ থেকে ছয় ফুট। তখন বিল অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম হয় ডিঙি নৌকা। সেজন্য বিল অঞ্চলের প্রায় সবার বাড়ির ঘাটেই ডিঙি নৌকা বাঁধা থাকে। বর্ষার পর পানি কমলেও বিলের কোথাও কোথাও পানি স্থায়ীভাবে রয়ে যায়। আর যেখানে পানি থাকে না সেখানে ধান চাষ করা হয়। বাকিটা সময় এসব বিলে কেবল পানি আর পানি।
লাল চাঁনের বাড়ি থেকে আসি বালাসুর বাসট্যান্ড। স্ট্যান্ডের সামাদ ভাইয়ের টি-স্টলে গরুর দুধের চা খেতে খেতে কথা হলো স্থানীয়দের সঙ্গে। তারাও জানান বিল অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের নানা কথা। সামাদ ভাইয়ের চায়ের স্বাদ দারুণ। এককাপ শেষ করে আরেককাপ খেতে খেতে অপেক্ষা করি ঢাকার বাসের জন্য।