বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত বিষয়। কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন যার সময়কাল কয়েক যুগ থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত হতে পারে, একেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তন বলি। বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন নির্ভরশীল, যেমন-জৈব প্রক্রিয়াসমূহ, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, প্লেট টেকটোনিক, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে এখন মানবসৃষ্ট কার্যক্রমকেই দায়ী করা হচ্ছে।
মানবসৃষ্ট এসব নেতিবাচক কার্যকলাপ জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমান সময়ে গ্রিন হাউস গ্যাসের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
শীতপ্রধান উন্নত দেশগুলোতে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনের জন্য তৈরি বিশেষ এক ধরনের কাচের ঘরকে সবুজ ঘর বা গ্রিন হাউস বলে। কাচ স্বাভাবিকভাবেই সূর্যের আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গের সৌর বিকিরণকে কোনোভাবেই বাইরে বেরোতে দেয় না, ফলে এ ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা আটকে পড়ে ক্রমশ ঘরের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শাকসবজি বা গাছপালা জন্মানোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও অনেকটা গ্রিন হাউসের মতোই, সূর্যকিরণ থেকে পৃথিবীতে মোট যে পরিমাণ বিকিরণ আসে তার ৩৪ ভাগ বিকিরণ মেঘপুঞ্জ, ধূলিকণা প্রভৃতি দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়।
পৃথিবী থেকে সূর্যরশ্মি প্রত্যাবর্তনের এই প্রাকৃতিক ঘটনাকে অ্যালবেডো বলে। এই প্রতিফলিত অ্যালবেডো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে কোনোভাবেই উত্তপ্ত করতে পারে না, ফলে তা পৃথিবীর তাপের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস যেমন-কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি পৃথিবীর তাপমাত্রাকে ধরে রাখছে গ্রিন হাউসের কাচের দেয়ালের মতো। এ গ্যাসগুলোও গ্রিন হাউসের কাচের মতো সূর্যের আগত তরঙ্গ রশ্মিকে ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। কিন্তু প্রতিফলিত দীর্ঘ তরঙ্গের অ্যালবেডোকে পুরোপুরি বাইরে বেরোতেও আটকে দেয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলসহ পৃথিবীর মধ্যে তাপমাত্রা আটকে গড় তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবী এখন এর নেতিবাচকতার স্বীকার। বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে।
এই চারটি মানদণ্ডেই বাংলাদেশ, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার শীর্ষে। বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, মরুকরণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস, সুপেয় পানির অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যে অনন্য। এদেশে একেকটি ঋতু আসে তার নিজস্ব রং-রূপ নিয়ে। প্রতিটি ঋতুকেই আলাদা আলাদাভাবে বোঝা যায় এদের বৈচিত্র্যতার কারণে। গ্রীষ্মের উষ্ণ দমকা হাওয়া ও কালবৈশাখী ঝড়, বর্ষার অবিরাম বৃষ্টি, শরতের মেঘমুক্ত পরিষ্কার নির্মল আবহাওয়া, হেমন্তের কিঞ্চিৎ শীতল বৃষ্টিহীন পরিবেশে পাকা ধান কাটার মৌসুম, শীতের কুয়াশাঘেরা ঠাণ্ডা শীতল আবহাওয়া এবং বসন্তের উষ্ণ দখিনা হাওয়ায় ফুল পাখির কলতান এই তো আমাদের চিরচেনা ষড়ঋতু।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই ঋতুবৈচিত্র্যকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। গ্রীষ্মতে বর্ষার আবহাওয়া প্রকট হয়ে উঠছে। এ বছরে তা তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। গ্রীষ্মকাল যেন বর্ষার বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। বর্ষার সব ধরনের বৈশিষ্ট্য গ্রীষ্মকালে ছিল। আর বর্ষাকাল গত কয়েক বছর ছিল বৃষ্টিহীন। এ বছর মোটামুটি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
গত কয়েক বছর শীতকালে আগের মতো ঠাণ্ডা অনুভূত হয় না। শীতের তীব্রতা নেই বললেই চলে। শীতকাল হয়ে গেছে ক্ষণস্থায়ী। আবার শীতপ্রধান দেশে শীত হচ্ছে তুলনামূলক বিচারে দীর্ঘস্থায়ী, এ বছর তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। শীত-বসন্ত পুরোপুরি গ্রাস করেছে গ্রীষ্ম। আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডাসহ অন্যান্য শীতপ্রধান দেশে এবারে বসন্তকাল বলে কিছু ছিল না।
অথচ বসন্তকাল দেশগুলোর কাছে কতই না আরাধ্য! বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর থেকেই এ পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষণীয়। বৃষ্টি চলিত মৌসুমী চরিত্র অনুযায়ী হয়নি। যখন কম হওয়ার কথা তখন বেশি হয়েছে।
আর যখন বেশি হওয়ার কথা তখন কম হয়েছে, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণই এর প্রমাণ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও পানির লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যা কৃষি উৎপাদনকে ফেলছে ঝুঁকিতে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন চলতে থাকলে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে কোনো কোনো ঋতু হয়তো হারিয়ে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো ঋতু হতে পারে দীর্ঘ।
গত বছর শরৎ ও হেমন্তে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা যেন ভরা বর্ষাকেও হার মানায়। দেশের বেশিরভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করেছে।
সাধারণত গ্রীষ্মে এ ধরনের গরম অনুভূত হলেও গত বছর সেপ্টেম্বরের একটি বড় সময় পর্যন্ত এবং অক্টোবরেও গরম অনুভূত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার এ পরিবর্তন গত ৩০ বছর ধরেই ঘটছে। এ বছরে গ্রীষ্মজুড়েই প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ আজ তিনটি ঋতুর দেশ বলে মনে হয়। বেড়েছে শীত, গরমের তীব্রতা, অসময়ের বৃষ্টিপাত।
জলবায়ুর এ ধরনের রূপান্তর যখন দশকজুড়ে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তখনই তাকে সাধারণভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব এসব সংজ্ঞার আওতা ছাড়িয়েও অনেক দূর বিস্তৃত ও গভীর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটে।
পরিবর্তন ঘটে শস্যচক্রের, আবির্ভাব ঘটে নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের। এ পরিবর্তনগুলো ইতিমধ্যেই আমরা দেখছি। জলবায়ু পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবে ভূ-ভাগবেষ্টিত অঞ্চলগুলোর প্রায় পুরোটাই মরুভূমিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
একটা বিরাট অংশ তলিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের তলে। সুপেয় পানির অভাব হয়ে উঠতে পারে প্রকটতর, সৃষ্টি হতে পারে জলবায়ু উদ্বাস্তু, এমনকি ধ্বংস হতে পারে গোটা দুনিয়ার এত দিনের সভ্যতা। তাই এ সমস্যার আশু সমাধানে পুরো পৃথিবীর একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, তবেই রক্ষা পাবে সভ্যতা। সবুজ পৃথিবী ঋতুবৈচিত্র্যে থাকবে অমলিন।
লেখক : প্রকৃতিবিষয়ক লেখক