ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে পালতোলা নৌকা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ একসময় নওগাঁর আত্রাইয়ের নদীগুলোতে সারি সারি পালতোলা নৌকা চোখে পড়তো। এখন সময়ের বিবর্তন, জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোক-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক পালতোলা নৌকা। বিলুপ্ত পথে পালতোলা নৌকার করুণ হাল নিয়ে লিখেছেন দৈনিক জাগরণ এর আত্রাই (নওগাঁ) সংবাদদাতা নাজমুল হক নাহিদ

হাতে গোনা দু’একটা পালের নাও বাদামি নাও চোখে পড়লেও নেই আগের মতো জৌলুস। এসব নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নববধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়নাও আর ধরে না।

যমুনা নদীবেষ্টিত আত্রাই উপজেলার বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল নদী আর পালের নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ বিভিন্ন নৌকার। এই তো ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর বুক চিড়ে বয়ে বেড়াতো সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল। স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের পত পত শব্দ অন্যরকম অনুভূতি জুগিয়ে যেতো প্রাণ।

পালতোলা নৌকায় নদীভ্রমণে যতটা না তৃপ্ত হতো মন তার চেয়ে দূর পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরীর পাড় থেকে সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল উড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠেছে।

আত্রাইয়ের বুক চিরে বয়ে চলা যমুনা নদীর পাড়ে দল বেঁধে মানুষ পালতোলা নৌকার সে দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে আসতো। আর মাঝনদী থেকে ভেসে আসা দরাজকণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের সুর শুনে মনে তৃপ্ত এনে দিতো।

নদীকে ঘিরে একসময় পালতোলা নৌকা ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। এপাড় থেকে ওপাড়ের যাত্রীদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত নৌকা। তবে কালের পরিক্রমায় এসব নৌকা এখন অতীত।

এখন নদীতে যেটুকু সময় পানি থাকে বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নৌকা চলাচল করে। এখন পালতোলা নৌকার দেখা মিলে না। এক সময় সাম্পান, গয়না, একমালাই নৌকা, কোষা নৌকা, ছিপ নাও, ডিঙি, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাওসহ বিভিন্ন ধরনের পালের নাওয়ের ব্যবহার ছিল।

যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন। মাঝে-মধ্যে দু’একটা পালের নাও এখনও নদ-নদীতে দেখা যায়।

পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত গল্প, কবিতা, ছড়া, পালাগান। চিত্রকর এঁকেছেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশিদের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নাও।

বিভিন্ন আকার ও ধরনের নৌকাই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এসব নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল একসময়। প্রবীণ মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাদের হিসেব রাখতে হতো জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের।

কথিত আছে, বিজ্ঞ মাঝিরা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিক নির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হতো আকাশের তারার ওপর। তাই আগেভাগেই শিখে নিতে হতো কোন তারার অবস্থান কোন দিকে।

‘শিরোনাম’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক এমরান মাহমুদ প্রত্যয় বলেন, নৌকাই ছিল আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সবসময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।

আগে ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন সেই ঘাট দখল করে নিয়েছে শ্যালো ইঞ্জিলচালিত নৌকা। এসব নৌকার ভট ভট বিকট শব্দে নদীর শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। কালের আবর্তে এক সময় পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে, ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও’ ইত্যাদি ছড়া। বিচিত্র রঙের পালের বাহারিতে ঝলমল করবে না, এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

বিলুপ্তির পথে পালতোলা নৌকা

আপডেট টাইম : ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ একসময় নওগাঁর আত্রাইয়ের নদীগুলোতে সারি সারি পালতোলা নৌকা চোখে পড়তো। এখন সময়ের বিবর্তন, জৌলুস হারানো নদ-নদীর করুণ অবস্থা আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান গ্রামবাংলার লোক-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক পালতোলা নৌকা। বিলুপ্ত পথে পালতোলা নৌকার করুণ হাল নিয়ে লিখেছেন দৈনিক জাগরণ এর আত্রাই (নওগাঁ) সংবাদদাতা নাজমুল হক নাহিদ

হাতে গোনা দু’একটা পালের নাও বাদামি নাও চোখে পড়লেও নেই আগের মতো জৌলুস। এসব নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নববধূ শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য পালতোলা নৌকার বায়নাও আর ধরে না।

যমুনা নদীবেষ্টিত আত্রাই উপজেলার বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল নদী আর পালের নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ বিভিন্ন নৌকার। এই তো ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর বুক চিড়ে বয়ে বেড়াতো সারি সারি নৌকা। এসব নৌকায় ছিল রঙিন পাল। স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের পত পত শব্দ অন্যরকম অনুভূতি জুগিয়ে যেতো প্রাণ।

পালতোলা নৌকায় নদীভ্রমণে যতটা না তৃপ্ত হতো মন তার চেয়ে দূর পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরীর পাড় থেকে সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল উড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠেছে।

আত্রাইয়ের বুক চিরে বয়ে চলা যমুনা নদীর পাড়ে দল বেঁধে মানুষ পালতোলা নৌকার সে দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে আসতো। আর মাঝনদী থেকে ভেসে আসা দরাজকণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের সুর শুনে মনে তৃপ্ত এনে দিতো।

নদীকে ঘিরে একসময় পালতোলা নৌকা ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। এপাড় থেকে ওপাড়ের যাত্রীদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত নৌকা। তবে কালের পরিক্রমায় এসব নৌকা এখন অতীত।

এখন নদীতে যেটুকু সময় পানি থাকে বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নৌকা চলাচল করে। এখন পালতোলা নৌকার দেখা মিলে না। এক সময় সাম্পান, গয়না, একমালাই নৌকা, কোষা নৌকা, ছিপ নাও, ডিঙি, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাওসহ বিভিন্ন ধরনের পালের নাওয়ের ব্যবহার ছিল।

যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেলচালিত ইঞ্জিন। মাঝে-মধ্যে দু’একটা পালের নাও এখনও নদ-নদীতে দেখা যায়।

পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন কত শত গল্প, কবিতা, ছড়া, পালাগান। চিত্রকর এঁকেছেন নান্দনিক শিল্পকর্ম। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশিদের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নাও।

বিভিন্ন আকার ও ধরনের নৌকাই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পরিবহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এসব নৌকা চালানোর জন্য পালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি পালের ব্যবহার ছিল নৌকাগুলোতে। পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল একসময়। প্রবীণ মাঝিরা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাদের হিসেব রাখতে হতো জোয়ার-ভাটার, বিভিন্ন তিথির এবং শুভ-অশুভ ক্ষণের।

কথিত আছে, বিজ্ঞ মাঝিরা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিক নির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হতো আকাশের তারার ওপর। তাই আগেভাগেই শিখে নিতে হতো কোন তারার অবস্থান কোন দিকে।

‘শিরোনাম’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক এমরান মাহমুদ প্রত্যয় বলেন, নৌকাই ছিল আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সবসময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।

আগে ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন সেই ঘাট দখল করে নিয়েছে শ্যালো ইঞ্জিলচালিত নৌকা। এসব নৌকার ভট ভট বিকট শব্দে নদীর শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। কালের আবর্তে এক সময় পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে, ‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও’ ইত্যাদি ছড়া। বিচিত্র রঙের পালের বাহারিতে ঝলমল করবে না, এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল।