প্রথমবারের মতো ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চাকরি বিধিমালা’ ভেঙে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকার বাইরে বদলি শুরু হয়েছে। যদিও এর আগে ২০১৮ সালে এক কর্মকর্তার আবেদন এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাহিদার প্রেক্ষিতে বদলির ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। তবে সেটি ছিল রাজউকের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী হাওলাতি প্রেষণে প্রেরণ। এবারই প্রথম তিনজনকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে এবং একজনকে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর এবং ৪ নভেম্বর দুটি পৃথক আদেশে চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। রাজউক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
রাজউকের চাকরি বিধিমালা-২০১৩ অনুযায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি করা হয়ে থাকে। এছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে কর্মকর্তাদের সেখানে পাঠানো হয়। প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা রাজউকে কর্মরত রয়েছেন। এসব কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে পাঠানো হয়। তবে রাজউকের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংস্থা থেকেই বদলি, পদোন্নতি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ অক্টোবর এক অফিস আদেশে সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর মো. শরিফ উদ্দিনকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নূর আলম হেলালকে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়। তারপর গত ৪ নভেম্বর ইমারত পরিদর্শক কাজী মো. আমীর খসরু এবং পাম্পচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি করা হয়।
হঠাৎ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তঃবদলিতে শঙ্কিত অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের মতে, একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার জন্যই রাজউকে যোগদান করেছি। ঢাকার বাইরে বদলি করা হবে জানলে অন্য চাকরিতেই যেতে পারতেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন রাজউকে চাকরি করার ফলে সন্তানদের লেখাপড়াও ঢাকাকেন্দ্রিক। হঠাৎ এমন বদলিতে পরিবারও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
খুলনায় বদলি হওয়া মো. শরিফ উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আগে হয়েছে শুনেছি। কেন কী কারণে খুলনায় বদলি করা হয়েছে, জানি না। যেহেতু সরকারি চাকরি করি, তাই আদেশ মানতে তো হবেই। তবে পরিবার যেহেতু ঢাকায় থাকে, একটু সমস্যাতো হচ্ছেই। যাইহোক মন্ত্রণালয় যে আদেশ দেবে, সেটিই মেনে নেব।
এমন বদলির ক্ষেত্রে সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২৩ এর ৪০ ধারা অনুসরণ করছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। সেই ধারায় বলা হয়েছে, আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি। সরকার জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের এক কর্তৃপক্ষ হতে অন্য কর্তৃপক্ষে বদলি করতে পারবে। এখানে অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সময় সময় আইনের ধারা প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ কোনো কর্তৃপক্ষ।
এদিকে রাজউকের নিজস্ব চাকরি বিধিমালা, ২০১৩ অনুযায়ী; নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে বদলির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। রাজউক কর্মকর্তা ও কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০১৩ এর বিধিমালা (২) রাজউকের সব সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়েছে। বিধিমালা (৩) অনুযায়ী, হাওলাত গ্রহণকারী সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মচারীর চাকরির আবশ্যকতা রয়েছে- মর্মে প্রয়োজনীয়তা বোধ করলে রাজউক কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরূপ আবশ্যকার কারণ বর্ণনা করে অনুরোধ জানাবে এবং উক্তরূপ অনুরোধ প্রাপ্তির পর রাজউক উক্ত কর্মচারীর সম্মতি নিয়ে হাওলাত গ্রহণকারী সংস্থা কর্তৃক উল্লেখিত শর্তাবলীর ভিত্তিতে প্রেষণের শর্তাবলী নির্ধারণ করবে।
অর্থাৎ রাজউক থেকে কোনো কর্মচারীকে অন্য সংস্থা নিতে চাইলে আবেদন করতে হবে রাজউক বরাবর এবং রাজউক সেই কর্মচারীর সম্মতি পেলে প্রেষণে পাঠাতে পারবে। এই বিধিমালার ভিত্তিতে ২০১৮ সালে ইন্সপেক্টর ডেভিড চাকমাকে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রেষণে পাঠানো হয়। জানা গেছে, তার বাড়িও কক্সবাজারে। তিনি সেখানে যেতে আগ্রহী ছিলেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, রাজউক একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আলাদা প্রতিষ্ঠান। সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইন দিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়তো বিধি-বিধানের বাইরে বদলি করতে পারে না।
বিষয়টি জানতে রাজউক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর সরকারকে একাধিকার ফোন করেও সাড়া মেলেনি। পরে তার ব্যবহৃত নম্বরে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে জানান, চেয়ারম্যান স্যার একটু অস্বস্তিতে রয়েছেন। সম্প্রতি যে চারজনকে বদলি করা হয়েছে, প্রতিটি আদেশ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়েছে। সেখানে রাজউকের কিছু করার ছিল না। আদেশ পাওয়ার পর রাজউক ওই চারজনকে রিলিজ করে দেয়।