একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শুধু বিশেষ কোনো শ্রেণি অংশ নেয়নি। বরং নারী-পুরুষ, বয়স্ক, শিশু, সব শ্রেণির মানুষই যে যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছিল। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃতই জনযুদ্ধ। পঁচিশ মার্চ থেকে পাকবাহিনী যখন দেশজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করল, ওরা নিরীহ মানুষের ওপর শুরু করল বর্বরোচিত নির্যাতন। বিশেষ করে নারীদের ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা, সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে শুরু করল। আর তাই নিজেকে, পরিবারকে তথা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুদ্ধে অংশ নিতে থাকে। ধীরে ধীরে সারাদেশের নারীরা যার যার জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ নানাভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। নারীরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি। কখনও তারা দূর থেকে সেবা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। কখনও বা আবার সরাসরি রণাঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধ করেছেন। যে নারীরা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে পারেননি তারা ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছেন, তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন। অসুস্থ হলে নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছেন। তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। কখনও কখনও পাকসেনাদের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। এর জন্য কখনও কখনও তাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। আত্মাহুতিও দিতে হয়েছে। তবু তারা পিছপা হননি।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক নারী অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধও করেছেন। যেমনÑ কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ। ভারতের গোবরা ক্যাম্পে অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কলকাতার পার্ক সার্কাসের কাছাকাছি গোবরা নামক স্থানে শুধু নারীদের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে নাম না জানা অনেক নারী যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে শত্রুকে হত্যাও করেছেন। নারীদের জন্য আরও তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। যুদ্ধে অসংখ্য নারী সেবিকা হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তারা নার্সের ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে, আশ্রয়কেন্দ্রে এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। সেখানেও ছিল অনেক নারীকর্মী। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে পথে, অলিগলিতে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন, যা তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তারা গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। বেতারে তারা সংবাদ পাঠ করেছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন। বীর নারীরা পাকসেনাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বহন করেছেন। পাগল সেজে, নানা কাজের বাহানায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে খবর সংগ্রহ করে এনেছেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তারা নিজের সন্তান, স্বামী বা নিকটজনকে শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের সমমনাদের হাতে প্রায় তিন লাখ নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পাকসেনারা অনেক নারীকে ক্যাম্পে আটকে রেখে মাসের পর মাস শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। সে নির্যাতনে কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ বা অমানসিক নির্যাতন সহ্য করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তবে যারা বেঁচে ফেরেন যুদ্ধের পর তাদের জীবনে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়েছিলেন, তাদের সংগ্রাম ছিল ভয়াবহ। ধর্ষিত নারীদের সমাজ ঘৃণার চোখে দেখে। অনেক নারী তাদের পরিবারে আশ্রয় পায়নি। জন্মদাতা বাবা-মাও সন্তানকে অস্বীকার করেছে। ফলে নানা আশ্রয়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। বছরের পর বছর তাদের এই কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যুদ্ধে নারীর বহুমাত্রিক অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।