ঢাকা , শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজয়ের পতাকা যেন বিজয়ী জাতির হাতে থাকে

১৯৭১ ছিল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অনন্য বছর। ধর্মনির্বিশেষে সব বাঙালি, এমনকি এ অঞ্চলে বসবাসরত সব জাতিসত্তার মানুষ সেদিন স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শামিল হয়েছিল। মানুষ ছিল অনুপ্রাণিত, ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ। অথচ বাঙালি কখনও মার্শাল বা সামরিক জাতি ছিল না, বরং তাদের বদনাম ছিল ঘরকুনো কলহপ্রিয় ভেতো বাঙালি হিসেবে। জাতির এই যে রূপান্তর, তার পেছনে ছিল মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তৎকালীন নেতৃত্ব।

একাত্তরের বিজয়ের পেছনে এই যে জনযুদ্ধ, তা থেকে মানুষের কাম্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণ, দুর্নীতিমুক্ত সবার অংশগ্রহণে সবার বিকাশের নিশ্চয়তাসম্পন্ন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়নি। প্রাথমিক কিছু বাধা তো ছিলই, দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, কৃষি উৎপাদন হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত, ছিল কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ। এর বাইরেও জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার মতো পরিকল্পনা নেওয়া যায়নি। দেশে বিশৃঙ্খলা, বিভক্তি এবং সংঘাত ও হানাহানি শুরু হয়েছিল অচিরেই। এর প্রেক্ষাপটে ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়েছে সরকার, তাতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে এই ধারাই চলেছে দশকের পর দশক। অথচ স্বাধীন দেশে যে পুরনো ধারার পরিবর্তে নতুন ধারার রাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা তরুণদের নানারকম কাজে প্রকাশ পেয়েছে। এক পর্যায়ে ছাত্র-তরুণদের সূচিত আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে, তখন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছিল। কিন্তু তার পর যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো, তা আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাল। গণতান্ত্রিক কিছু প্রতিষ্ঠান কার্যকর হলেও সরকারের হাতে, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই বহাল থেকেছে এবং জনমানুষ কোনোভাবে শাসনের ভাগীদার হতে পারেনি। এটাই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি এবং বিরোধী মতামতকে দমনপীড়ন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

এর মধ্যে একটা পর্যায়ে আমরা লক্ষ করি, ছাত্র-তরুণরা প্রথাগত রাজনৈতিক ধারার বাইরে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে নানা ধরনের আন্দোলন করেছে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে এ রকম কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। স্কুলছাত্ররাও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করেছিল এবং সাধারণ মানুষ সেটিকে সমর্থনও জানিয়েছিল। এ ধারারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল ২০২৪-এ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে, যার প্রবল জোয়ারে সরকারের পতন ঘটল এবং নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল।

সম্ভাবনা আমাদের সামনে বারবারই এসেছে। ১৯৭১-এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন দেশে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্বের প্রজ্ঞার অভাবে জাতি তা কাজে লাগাতে পারল না। দ্রুতই সরকার নানান সমস্যার আবর্তের মধ্যে পড়ে গেল। সংকট থেকে ষড়যন্ত্র এবং তার ফলাফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যার ঘটনা ঘটল। এখন বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন এত দৃশ্যমান ও এতই বেগবান, তাকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। তবে এরশাদের পতনের পরে ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে নতুনভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু করার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম দুই বড় দল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য এমন সব পন্থা অবলম্বন করল, যা সংঘাতময় পরিবেশের জন্ম দিয়েছিল। ফলে মাঝপথে আবার হস্তক্ষেপ হলো, দুই বছরের জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে একটি মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাতে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তারা সেই বিজয়কে ক্রমে দখলে রূপান্তর করল।

দীর্ঘ পনেরো বছরে অনেক প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলেও জবাবদিহিতাবিহীন দখলদারির ফল হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতিÑ তার মাত্রা এমন ছিল যে, এমনটা এ দেশের মানুষ আগে দেখেনি। কেবল দুর্নীতিই নয়, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য একদিকে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। বেপরোয়া লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের খেসারত দিল পতিত সরকার ও দল। তাদের পতনের মধ্য দিয়ে আবারও বাংলাদেশকে একাত্তরের বিজয়ের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে।

তবে মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে তিপ্পান্ন বছর অতিবাহিত হয়েছে। একাত্তরের স্বপ্নের যেমন বর্তমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের প্রয়োজন আছে, তেমনি এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন যেসব বিবেচ্য বিষয় সামনে হাজির হয়েছে, সেগুলোকেও ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে। পুরনো অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন যেমন জরুরি, তেমনি নতুনের তাগিদ ধরতে পারাও দরকার। তা না হলে আমরাই পিছিয়ে পড়ব। আদতে ১৯৭১-এ রাজনীতিকদের প্রধান ভুল ছিল পরিবর্তিত সময়ের চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থতা। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের উপযোগী রাজনীতি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদরা। সেই থেকেই এ দেশের রাজনীতি তামাদি হতে শুরু করেছিল। এখন বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন এত দৃশ্যমান ও এতই বেগবান যে, তাকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। তবে মানুষের অভ্যাস তো সহজেই পাল্টায় না। তারা অত্যন্ত গতানুগতিকতার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাই পরিবর্তনকে কেবল কর্মসূচিতে আবদ্ধ রাখলে চলবে না, আগে দরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন, এর জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, কৃষি উৎপাদন, সামাজিক নানা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তা তেমন দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা কেবল নিজেদের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন; তারা এর জন্য দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সংস্কারসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আরও যে সংস্কার প্রয়োজন, তার কথা তাদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। অথচ তারাই যখন সরকার পরিচালনার মূল কারিগর, তা হলে তাদের করণীয় কাজ অন্যদের কাছ থেকে আসা কি সম্মানজনক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? নিজেদের কাজটা আগেভাগে নিজেরা করে নেওয়াই ভালো।

কথা হলো, কোনো অবস্থায়ই ছাত্র-তরুণ এবং জনমানুষ বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করতে আর রাজি নয়। আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, একাত্তরই আমাদের ভিত্তিÑ বাংলাদেশের যাত্রার সূচনা। তা ছাড়া একাত্তরের মতো এমন বিজয় এ জাতি কখনও লাভ করেনি, এত শহীদ, এত রক্তপাত, এত বীরত্ব, এত দীর্ঘ লড়াই, এত ত্যাগ, এত-এত যুদ্ধ কখনও আমাদের ইতিহাসেই নেই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল অর্ধশত বছরেরও আগে। কিন্তু বিজয়ের প্রকৃত অর্জন বিজয়ী জাতির কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছিল। বারবার তা গোষ্ঠীবিশেষের হাতে চলে যাচ্ছিল ভোগের সামগ্রী হিসেবে চরম ক্ষমতার রূপ ধরে। এবারে গোটা বাংলাদেশকে, পুরো জাতিকেÑ বাঙালি-চাকমা-মার্মা-সাঁওতাল-বিহারিসহ সব নাগরিককেই বিজয়ী হতে হবে। সেটাই এবারের বিজয় দিবসের কামনা।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

বিজয়ের পতাকা যেন বিজয়ী জাতির হাতে থাকে

আপডেট টাইম : ০৪:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

১৯৭১ ছিল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অনন্য বছর। ধর্মনির্বিশেষে সব বাঙালি, এমনকি এ অঞ্চলে বসবাসরত সব জাতিসত্তার মানুষ সেদিন স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শামিল হয়েছিল। মানুষ ছিল অনুপ্রাণিত, ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ। অথচ বাঙালি কখনও মার্শাল বা সামরিক জাতি ছিল না, বরং তাদের বদনাম ছিল ঘরকুনো কলহপ্রিয় ভেতো বাঙালি হিসেবে। জাতির এই যে রূপান্তর, তার পেছনে ছিল মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তৎকালীন নেতৃত্ব।

একাত্তরের বিজয়ের পেছনে এই যে জনযুদ্ধ, তা থেকে মানুষের কাম্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণ, দুর্নীতিমুক্ত সবার অংশগ্রহণে সবার বিকাশের নিশ্চয়তাসম্পন্ন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়নি। প্রাথমিক কিছু বাধা তো ছিলই, দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, কৃষি উৎপাদন হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত, ছিল কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ। এর বাইরেও জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার মতো পরিকল্পনা নেওয়া যায়নি। দেশে বিশৃঙ্খলা, বিভক্তি এবং সংঘাত ও হানাহানি শুরু হয়েছিল অচিরেই। এর প্রেক্ষাপটে ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়েছে সরকার, তাতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে এই ধারাই চলেছে দশকের পর দশক। অথচ স্বাধীন দেশে যে পুরনো ধারার পরিবর্তে নতুন ধারার রাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা তরুণদের নানারকম কাজে প্রকাশ পেয়েছে। এক পর্যায়ে ছাত্র-তরুণদের সূচিত আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে, তখন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছিল। কিন্তু তার পর যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো, তা আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাল। গণতান্ত্রিক কিছু প্রতিষ্ঠান কার্যকর হলেও সরকারের হাতে, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই বহাল থেকেছে এবং জনমানুষ কোনোভাবে শাসনের ভাগীদার হতে পারেনি। এটাই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি এবং বিরোধী মতামতকে দমনপীড়ন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

এর মধ্যে একটা পর্যায়ে আমরা লক্ষ করি, ছাত্র-তরুণরা প্রথাগত রাজনৈতিক ধারার বাইরে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে নানা ধরনের আন্দোলন করেছে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে এ রকম কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। স্কুলছাত্ররাও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করেছিল এবং সাধারণ মানুষ সেটিকে সমর্থনও জানিয়েছিল। এ ধারারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল ২০২৪-এ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে, যার প্রবল জোয়ারে সরকারের পতন ঘটল এবং নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল।

সম্ভাবনা আমাদের সামনে বারবারই এসেছে। ১৯৭১-এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন দেশে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্বের প্রজ্ঞার অভাবে জাতি তা কাজে লাগাতে পারল না। দ্রুতই সরকার নানান সমস্যার আবর্তের মধ্যে পড়ে গেল। সংকট থেকে ষড়যন্ত্র এবং তার ফলাফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যার ঘটনা ঘটল। এখন বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন এত দৃশ্যমান ও এতই বেগবান, তাকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। তবে এরশাদের পতনের পরে ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে নতুনভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু করার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম দুই বড় দল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য এমন সব পন্থা অবলম্বন করল, যা সংঘাতময় পরিবেশের জন্ম দিয়েছিল। ফলে মাঝপথে আবার হস্তক্ষেপ হলো, দুই বছরের জন্য সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে একটি মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাতে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তারা সেই বিজয়কে ক্রমে দখলে রূপান্তর করল।

দীর্ঘ পনেরো বছরে অনেক প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলেও জবাবদিহিতাবিহীন দখলদারির ফল হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতিÑ তার মাত্রা এমন ছিল যে, এমনটা এ দেশের মানুষ আগে দেখেনি। কেবল দুর্নীতিই নয়, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য একদিকে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। বেপরোয়া লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের খেসারত দিল পতিত সরকার ও দল। তাদের পতনের মধ্য দিয়ে আবারও বাংলাদেশকে একাত্তরের বিজয়ের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে।

তবে মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে তিপ্পান্ন বছর অতিবাহিত হয়েছে। একাত্তরের স্বপ্নের যেমন বর্তমানের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের প্রয়োজন আছে, তেমনি এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন যেসব বিবেচ্য বিষয় সামনে হাজির হয়েছে, সেগুলোকেও ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে। পুরনো অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন যেমন জরুরি, তেমনি নতুনের তাগিদ ধরতে পারাও দরকার। তা না হলে আমরাই পিছিয়ে পড়ব। আদতে ১৯৭১-এ রাজনীতিকদের প্রধান ভুল ছিল পরিবর্তিত সময়ের চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থতা। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের উপযোগী রাজনীতি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদরা। সেই থেকেই এ দেশের রাজনীতি তামাদি হতে শুরু করেছিল। এখন বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন এত দৃশ্যমান ও এতই বেগবান যে, তাকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। তবে মানুষের অভ্যাস তো সহজেই পাল্টায় না। তারা অত্যন্ত গতানুগতিকতার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাই পরিবর্তনকে কেবল কর্মসূচিতে আবদ্ধ রাখলে চলবে না, আগে দরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন, এর জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, কৃষি উৎপাদন, সামাজিক নানা খাতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তা তেমন দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা কেবল নিজেদের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন; তারা এর জন্য দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সংস্কারসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আরও যে সংস্কার প্রয়োজন, তার কথা তাদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। অথচ তারাই যখন সরকার পরিচালনার মূল কারিগর, তা হলে তাদের করণীয় কাজ অন্যদের কাছ থেকে আসা কি সম্মানজনক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? নিজেদের কাজটা আগেভাগে নিজেরা করে নেওয়াই ভালো।

কথা হলো, কোনো অবস্থায়ই ছাত্র-তরুণ এবং জনমানুষ বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করতে আর রাজি নয়। আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, একাত্তরই আমাদের ভিত্তিÑ বাংলাদেশের যাত্রার সূচনা। তা ছাড়া একাত্তরের মতো এমন বিজয় এ জাতি কখনও লাভ করেনি, এত শহীদ, এত রক্তপাত, এত বীরত্ব, এত দীর্ঘ লড়াই, এত ত্যাগ, এত-এত যুদ্ধ কখনও আমাদের ইতিহাসেই নেই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল অর্ধশত বছরেরও আগে। কিন্তু বিজয়ের প্রকৃত অর্জন বিজয়ী জাতির কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছিল। বারবার তা গোষ্ঠীবিশেষের হাতে চলে যাচ্ছিল ভোগের সামগ্রী হিসেবে চরম ক্ষমতার রূপ ধরে। এবারে গোটা বাংলাদেশকে, পুরো জাতিকেÑ বাঙালি-চাকমা-মার্মা-সাঁওতাল-বিহারিসহ সব নাগরিককেই বিজয়ী হতে হবে। সেটাই এবারের বিজয় দিবসের কামনা।