ঢাকা , শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার স্বপ্ন

সীমিত সম্পদ সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে নতুন বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেটের আকার হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোট টাকা। ‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা’ এ স্লোগান ধারণ করে বিশাল আকারের এ বাজেট গতকাল জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মানুষের আয় ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে সীমিত আয়ের বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে চান অর্থমন্ত্রী। এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছন। সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কেটে যাচ্ছে; যার ফলে সমতার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের অর্থনীতি আজ এক সুদৃঢ় অবস্থানে পৌঁছেছে। সমৃদ্ধির আরও উচ্চতর সোপানে পৌঁছাতে হলে আমাদের মানব যোগাযোগ, পরিবহন, সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে চলতি অর্থবছর ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আগামী বছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে প্রথমবারের মতো এবার শিশু বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত নতুন বাজেটের মূল আকার ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি। অনুন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। বিশাল আকারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। ঘাটতির এ চাহিদা মেটাতে সরকার বৈদেশিক খাত থেকে ঋণ নেবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। আর বাকি ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটের আয় : প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে আদায় করা হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের বাজেট চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর থেকে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এবার এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেবা ফি বা করবহির্ভূত উৎস থেকে আয় করা হবে ৩২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করছে সরকার। বাজেটের অর্থায়নে সরকার আগামী বছর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ব্যয়ের খাত : ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে মোট উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপি ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি, এডিপিবহির্ভূত উন্নয়ন ব্যয় ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) উন্নয়ন ব্যয় ১ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। বাজেটে মোট অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব ব্যয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ৩৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ১ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। খাদ্য ক্রয়, ঋণ পরিশোধ, অগ্রিমসহ অন্যান্য ব্যয় ৩৫ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।

ঘাটতি বাজেট : প্রস্তাবিত বিশাল আকারের বাজেটে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক অনুদান না পেলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপি ১৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭ কোটি টাকার ৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈদেশিক অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৩৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্য থেকে আগে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৮ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। ফলে বৈদেশিক উৎস থেকে নতুন অর্থবছরে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া দেশের ভিতর থেকে নতুন অর্থবছরে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি ও অন্যান্য উৎস থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট বরাদ্দ : প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ খাতে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৫২ হাজার ৩৩১ কোটি, কৃষি খাতে ২২ হাজার ৭১২ কোটি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১৫ হাজার ৩৬ কোটি, বিনোদন ও সংস্কৃতিতে ২ হজার ৭০৬ কোটি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে ৩ হাজার ৮১৯ কোটি, গৃহায়ণে ৩ হাজার ১২০ কোটি, স্বাস্থ্য খাতে ১৭ হাজার ৫১৬ কোটি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ১৯ হাজার ২৯১ কোটি, প্রতিরক্ষায় ২২ হাজার ১৪৪ কোটি, জনশৃঙ্খলা নিরাপত্তায় ২১ হাজার ৭২ কোটি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ২৩ হাজার ৫৪৩ কোটি এবং সরকারের যে খাতে সবচেয়ে বেশি অনুন্নয়ন ব্যয় হয়ে থাকে সেই জনপ্রশাসন খাতে ৯৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ভ্যাট ও করসংক্রান্ত : নতুন ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে অবশেষে আইনটির বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে জুলাই-২০১৭ নির্ধারণ করেছে সরকার। বাজেটের বিশাল অঙ্কের অর্থের সংস্থান করতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে করপোরেট কর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমাও অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন মুহিত। এদিকে মুঠোফোন সিম ব্যবহার করে কথা বলাসহ অন্যান্য সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে মুঠোফোন সিমভিত্তিক সব ধরনের সেবার ওপর গ্রাহকের খরচ আরেকটু বাড়বে। তবে মুঠোফোনের সিম কার্ডের দাম গত অর্থবছরের মতোই ১০০ টাকা বহাল রাখা হয়েছে। ভ্যাট থেকেই সবচেয়ে বেশি ৭২ হাজার কোটি টাকার আয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ২২ হাজার ৪৫০ কোটি, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ৭৫, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৪৪ কোটি, আবগারি শুল্ক থেকে ৪ হাজার ৪৪৯ কোটি এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া সবাইকে করের আওতায় আনতে ন্যূনতম কর দেওয়া এবং ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পান এমন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে দেশীয় শিল্পের বিকাশে এবং রপ্তানি বাড়াতে তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট করহার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

১০ মেগা প্রকল্প : অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সরকারি-বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর অঙ্গীকার করেছেন। অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দ্রুত উন্নয়নে সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আটটি প্রকল্পের সঙ্গে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পকে যুক্ত করে কাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প : প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা নামে একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি। এতে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (রামপাল) ও এলএনটি টার্মিনাল প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া হবে বলে বক্তৃতায় উল্লেখ করেন মুহিত। এ ছাড়া বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩১ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা হবে। বিধবা ভাতার হার বৃদ্ধি করে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা, মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ লাখে উন্নীত করা। অসচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ভাতার হার ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমবারের মতো এবার শিশু বাজেটের ঘোষণা দিয়েছন তিনি।

রেকর্ড গড়লেন অর্থমন্ত্রী : অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা সর্বোচ্চ বাজেট দেওয়ার রেকর্ড গড়লেন গতকাল। এটা তার ব্যক্তিগত দশম বাজেট ঘোষণা। মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অষ্টম এবং এর আগে এরশাদ সরকারের সময় দিয়েছিলেন দুটি বাজেট। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা এতবার বাজেট আর কেউ দেননি। গতকাল হালকা টিয়া রঙের পাঞ্জাবির ওপর কালো রঙের মুজিবকোট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বাজেটের নথিভর্তি ব্রিফকেস শোভা পাচ্ছিল অর্থমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পরনে ছিল অফ হোয়াইট সিল্ক শাড়ি। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, প্রধান বিচারপরি এস কে সিনহা, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হক, বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল আবু ইসরার ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামুদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ কূটনীতিক ও দেশি-বিদেশি মেহমানরা উপস্থিত ছিলেন। পরে অবশ্য স্পিকারের পাশাপাশি ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াও অধিবেশন পরিচালনা করেন। বাজেট উপলক্ষে সংসদ ভবনসহ আশপাশ এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেওয়া হয়। প্রবেশপথে বসানো হয় অতিরিক্ত আর্চওয়ে। র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার বিপুলসংখ্যক সদস্য পুরো ভবনে নিরাপত্তা ঘেরাটোপ গড়ে তোলেন। বৈধ পাস ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি সংসদ ভবন এলাকায়। দর্শক গ্যালারির পাস ইস্যুতেও ছিল কড়াকড়ি। তার পরও সংসদ ভবনের ভিতরে ও বাইরে এ সময় দর্শনার্থীদের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা গেছে।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। এ সময় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল অধিবেশন কক্ষ, ভিআইপি, সাংবাদিক ও দর্শক গ্যালারি। ঘড়ির কাঁটায় ৩টা ৩২ মিনিটে বাজেট বক্তব্য শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমে নিজের আসনে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট উত্থাপন শুরু করেন। অর্থমন্ত্রীর পাশে ছিল পানিভর্তি ফ্লাস্ক ও কাচের গ্লাস। বাজেট বক্তৃতার শুরুতে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রতি আস্থা রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। পরে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে তিনি বসে বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন। ৬টা ৫৫ মিনিটে বাজেট বক্তৃতা শেষ হয়। এ সময় টেবিল চাপড়ে ‘২০১৬-১৭’ অর্থবছরের উত্থাপিত বাজেট সমর্থন জানায় রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। বাজেট বক্তৃতার প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ অর্থমন্ত্রী পড়ে শোনান। এ ছাড়া তৃতীয় অংশের কিছু অংশ ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়। বক্তৃতার চতুর্থ অংশের পুরোটাই স্ক্রিনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থ বিল, ২০১৬ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কিছু আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি আগামী ৩০ জুন পাস হবে। এর আগে জাতীয় সংসদের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভবনে এসে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন আজ : প্রতি বছরের মতো রীতি অনুযায়ী আজ বিকাল ৪টায় রাজধানীর আবদুল গনি রোডে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার স্বপ্ন

আপডেট টাইম : ০৯:০৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জুন ২০১৬

সীমিত সম্পদ সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে নতুন বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেটের আকার হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোট টাকা। ‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা’ এ স্লোগান ধারণ করে বিশাল আকারের এ বাজেট গতকাল জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মানুষের আয় ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে সীমিত আয়ের বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে চান অর্থমন্ত্রী। এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছন। সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কেটে যাচ্ছে; যার ফলে সমতার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের অর্থনীতি আজ এক সুদৃঢ় অবস্থানে পৌঁছেছে। সমৃদ্ধির আরও উচ্চতর সোপানে পৌঁছাতে হলে আমাদের মানব যোগাযোগ, পরিবহন, সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে চলতি অর্থবছর ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আগামী বছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে প্রথমবারের মতো এবার শিশু বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত নতুন বাজেটের মূল আকার ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি। অনুন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। বিশাল আকারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। ঘাটতির এ চাহিদা মেটাতে সরকার বৈদেশিক খাত থেকে ঋণ নেবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। আর বাকি ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটের আয় : প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে আদায় করা হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের বাজেট চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর থেকে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এবার এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেবা ফি বা করবহির্ভূত উৎস থেকে আয় করা হবে ৩২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করছে সরকার। বাজেটের অর্থায়নে সরকার আগামী বছর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ব্যয়ের খাত : ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে মোট উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপি ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি, এডিপিবহির্ভূত উন্নয়ন ব্যয় ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) উন্নয়ন ব্যয় ১ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। বাজেটে মোট অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়নমূলক রাজস্ব ব্যয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ৩৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ১ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। খাদ্য ক্রয়, ঋণ পরিশোধ, অগ্রিমসহ অন্যান্য ব্যয় ৩৫ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।

ঘাটতি বাজেট : প্রস্তাবিত বিশাল আকারের বাজেটে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক অনুদান না পেলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপি ১৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭ কোটি টাকার ৫ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈদেশিক অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৩৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্য থেকে আগে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৮ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। ফলে বৈদেশিক উৎস থেকে নতুন অর্থবছরে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া দেশের ভিতর থেকে নতুন অর্থবছরে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি ও অন্যান্য উৎস থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট বরাদ্দ : প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলিয়ে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ খাতে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৫২ হাজার ৩৩১ কোটি, কৃষি খাতে ২২ হাজার ৭১২ কোটি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১৫ হাজার ৩৬ কোটি, বিনোদন ও সংস্কৃতিতে ২ হজার ৭০৬ কোটি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে ৩ হাজার ৮১৯ কোটি, গৃহায়ণে ৩ হাজার ১২০ কোটি, স্বাস্থ্য খাতে ১৭ হাজার ৫১৬ কোটি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ১৯ হাজার ২৯১ কোটি, প্রতিরক্ষায় ২২ হাজার ১৪৪ কোটি, জনশৃঙ্খলা নিরাপত্তায় ২১ হাজার ৭২ কোটি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ২৩ হাজার ৫৪৩ কোটি এবং সরকারের যে খাতে সবচেয়ে বেশি অনুন্নয়ন ব্যয় হয়ে থাকে সেই জনপ্রশাসন খাতে ৯৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ভ্যাট ও করসংক্রান্ত : নতুন ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে অবশেষে আইনটির বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে জুলাই-২০১৭ নির্ধারণ করেছে সরকার। বাজেটের বিশাল অঙ্কের অর্থের সংস্থান করতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে করপোরেট কর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমাও অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন মুহিত। এদিকে মুঠোফোন সিম ব্যবহার করে কথা বলাসহ অন্যান্য সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে মুঠোফোন সিমভিত্তিক সব ধরনের সেবার ওপর গ্রাহকের খরচ আরেকটু বাড়বে। তবে মুঠোফোনের সিম কার্ডের দাম গত অর্থবছরের মতোই ১০০ টাকা বহাল রাখা হয়েছে। ভ্যাট থেকেই সবচেয়ে বেশি ৭২ হাজার কোটি টাকার আয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ২২ হাজার ৪৫০ কোটি, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ৭৫, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৪৪ কোটি, আবগারি শুল্ক থেকে ৪ হাজার ৪৪৯ কোটি এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া সবাইকে করের আওতায় আনতে ন্যূনতম কর দেওয়া এবং ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পান এমন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে দেশীয় শিল্পের বিকাশে এবং রপ্তানি বাড়াতে তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট করহার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

১০ মেগা প্রকল্প : অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সরকারি-বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর অঙ্গীকার করেছেন। অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দ্রুত উন্নয়নে সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আটটি প্রকল্পের সঙ্গে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পকে যুক্ত করে কাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প : প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা নামে একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি। এতে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (রামপাল) ও এলএনটি টার্মিনাল প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া হবে বলে বক্তৃতায় উল্লেখ করেন মুহিত। এ ছাড়া বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩১ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা হবে। বিধবা ভাতার হার বৃদ্ধি করে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা, মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ লাখে উন্নীত করা। অসচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ভাতার হার ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমবারের মতো এবার শিশু বাজেটের ঘোষণা দিয়েছন তিনি।

রেকর্ড গড়লেন অর্থমন্ত্রী : অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা সর্বোচ্চ বাজেট দেওয়ার রেকর্ড গড়লেন গতকাল। এটা তার ব্যক্তিগত দশম বাজেট ঘোষণা। মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অষ্টম এবং এর আগে এরশাদ সরকারের সময় দিয়েছিলেন দুটি বাজেট। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা এতবার বাজেট আর কেউ দেননি। গতকাল হালকা টিয়া রঙের পাঞ্জাবির ওপর কালো রঙের মুজিবকোট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বাজেটের নথিভর্তি ব্রিফকেস শোভা পাচ্ছিল অর্থমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পরনে ছিল অফ হোয়াইট সিল্ক শাড়ি। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, প্রধান বিচারপরি এস কে সিনহা, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হক, বিমানবাহিনী প্রধান মার্শাল আবু ইসরার ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামুদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ কূটনীতিক ও দেশি-বিদেশি মেহমানরা উপস্থিত ছিলেন। পরে অবশ্য স্পিকারের পাশাপাশি ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াও অধিবেশন পরিচালনা করেন। বাজেট উপলক্ষে সংসদ ভবনসহ আশপাশ এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেওয়া হয়। প্রবেশপথে বসানো হয় অতিরিক্ত আর্চওয়ে। র‌্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার বিপুলসংখ্যক সদস্য পুরো ভবনে নিরাপত্তা ঘেরাটোপ গড়ে তোলেন। বৈধ পাস ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি সংসদ ভবন এলাকায়। দর্শক গ্যালারির পাস ইস্যুতেও ছিল কড়াকড়ি। তার পরও সংসদ ভবনের ভিতরে ও বাইরে এ সময় দর্শনার্থীদের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা গেছে।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। এ সময় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল অধিবেশন কক্ষ, ভিআইপি, সাংবাদিক ও দর্শক গ্যালারি। ঘড়ির কাঁটায় ৩টা ৩২ মিনিটে বাজেট বক্তব্য শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমে নিজের আসনে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট উত্থাপন শুরু করেন। অর্থমন্ত্রীর পাশে ছিল পানিভর্তি ফ্লাস্ক ও কাচের গ্লাস। বাজেট বক্তৃতার শুরুতে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রতি আস্থা রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। পরে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে তিনি বসে বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন। ৬টা ৫৫ মিনিটে বাজেট বক্তৃতা শেষ হয়। এ সময় টেবিল চাপড়ে ‘২০১৬-১৭’ অর্থবছরের উত্থাপিত বাজেট সমর্থন জানায় রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। বাজেট বক্তৃতার প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ অর্থমন্ত্রী পড়ে শোনান। এ ছাড়া তৃতীয় অংশের কিছু অংশ ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়। বক্তৃতার চতুর্থ অংশের পুরোটাই স্ক্রিনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। বাজেট বক্তৃতা শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থ বিল, ২০১৬ সংসদে উত্থাপন করেন। সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কিছু আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিলটি আগামী ৩০ জুন পাস হবে। এর আগে জাতীয় সংসদের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভবনে এসে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন আজ : প্রতি বছরের মতো রীতি অনুযায়ী আজ বিকাল ৪টায় রাজধানীর আবদুল গনি রোডে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।